স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রত্যাশা প্রাপ্তি ও আগামীর চ্যালেঞ্জ

কায়েস চৌধুরী | বুধবার , ২৪ মার্চ, ২০২১ at ৮:১২ পূর্বাহ্ণ

দীর্ঘ নয় মাসের অভূতপূর্ব রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। মহান স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছরে হাজারো সমস্যার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের সাফল্য নিতান্ত কম নয়। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ ছিল আপারভোল্টা, যেটা বর্তমানে বুর্কিনা ফাসো নামে পরিচিত। আর, তারপরেই ছিল বাংলাদেশ। সেই পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশ এখন অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। ১৯৭০ সালে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল শুধু ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে তা দাঁড়ায় ৩০০ বিলিয়ন ডলারের উপরে। ৫০ বছরে যা বৃদ্ধি পায় প্রায় ৩৩ গুণের বেশি। ১৯৭০-এ মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১৪০ ডলার, ২০২০-এ তা ২০৬৪-এ উন্নীত হয়। তাহলে ১৯৭২-১৯৭৩ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ গুণ। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি, ২০২০-২০২১ সালের বাজেট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ১৯৭২-১৯৭৩ সালের তুলনায় বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ৭২২ গুণ। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে উন্নয়ন বাজেটের আকার ছিল ৫০১ কোটি টাকা, যা বেড়ে ২০২০-২০২১ সালে হয়েছে ২ লাখ কোটির উপরে, যা প্রায় ৪০০ গুণের বেশি। এসব কিছুর প্রতিফলন দেখা যায় বিদ্যুতায়ন, গ্রামীণ সড়কের উন্নয়ন, শিল্পায়ন, গৃহায়ণ, নগরায়ণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, দারিদ্র্য বিমোচন প্রভৃতি ক্ষেত্রে। সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আমাদের ৫০ বছরের অগ্রগতি স্বস্তিদায়ক। যেমন সার্বিক সাধারণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, গড় আয়ু, ইপিআই, নারীর ক্ষমতায়ন, জন্ম ও মৃত্যুহার হ্রাস ইত্যাদিতে অগ্রগতির উল্লেখ করা যেতে পারে।
পাশাপাশি, এ মুহূর্তে করোনা ভাইরাস মহামারী মোকাবেলাসহ আর্থসামাজিক নানা সংকট সমাধানের চ্যালেঞ্জ আছে বাংলাদেশের সামনে। দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে ৫ লাখের বেশি মানুষ এবং আট হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ ভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশের মানুষের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ তো রয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত সরকার বেশ সফলতার সাথে এ কাজ বাস্তবায়ন করছে। অন্যদিকে, এই মহামারির কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কর্মসংস্থান, ব্যবসা বাণিজ্য। দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক স্থবিরতা। ২০২১ সালে এটা হয়তো কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে না। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প কল-কারখানায় যথাযথ প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে সংকট উত্তরনে সহায়তা করা প্রধান চ্যালেঞ্জের অন্যতম। আবার, এই মহামারিতে নতুন কিছু সুযোগেরও সৃষ্টি হয়েছে, যা কাজে লাগাতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সফলতা এলে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে, তা আপাতদৃষ্টিতে বলা যায়।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ বর্তমানে চমৎকার। করোনা’র ভ্যাকসিন প্রাপ্তি, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা, সীমান্ত হত্যা, এনআরসি ও তিস্তা চুক্তি সহ অন্যান্য ইস্যুতে সরকার কতটুকু সফল হয়, তার উপর বাংলাদেশের আগামী দিনের অগ্রগতি নির্ভর করে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নেয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের মতো চ্যালেঞ্জও রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। আমাদের মেধাবী উদ্যোক্তা আছে। শ্রমজীবী শ্রেণী আছে। প্রবাসীরা প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন। প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তির পরও কৃষক শ্রেনী উৎপাদন সচল রেখেছে। নারী সমাজ গ্রামীণ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বৈষম্যই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতের প্রায় সব সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি সন্তোষজনক। এমনকি মানব উন্নয়ন সূচকের কিছুক্ষেত্রে ভারতের চেয়েও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে, অপরাজনীতি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। সুশাসন নেই। দুর্নীতি, অপরাধ ও মিথ্যা আমাদের সমাজে ছেঁয়ে গেছে। স্বাধীনতার মূলমন্ত্র, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন ও শোষণমুক্ত সমাজ কি আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? অর্থনীতির সূচক যা-ই বলুক, দেশে ধনী-গরীবের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। ধনীরা হচ্ছেন আরো ধনী। আর গরীবরা হচ্ছেন আরো গরীব।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হতে চললেও বাস্তবতা হচ্ছে দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। দুর্নীতিপ্রবণ দেশ দারিদ্র্য বিমোচনে সফলতা অর্জন করতে পারে না। এক্ষেত্রে সুশাসনের বিষয়টি জড়িত। দশ বছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে বলে কিছুদিন আগে জানিয়েছিলো বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে টিআইবি বলছে, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা; এর সঙ্গে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ ৫৪ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা।
আমি, আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন- এই আমাদের জীবনের গণ্ডি। দেশ নিয়ে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নাই। আমরা সাহসী জাতি কিন্তু দেশপ্রেমের বড়ই অভাব। দেশপ্রেম জাগ্রত না হলে দেশ এগুবে না, অন্যায় অত্যাচার, গুম, খুন, ইয়াবা চলতেই থাকবে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, শ্রেণী বৈষম্য নিরসন, সম্পদের সুষম বন্টন, অর্থনৈতিক মুক্তি, উন্নয়ন ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য আরো একটি যুদ্ধ প্রয়োজন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগীতশিল্পী, ব্যাংক কর্মকর্তা

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
পরবর্তী নিবন্ধজীবন খালিদের প্রতি সুবিচার করেনি