জীবন খালিদের প্রতি সুবিচার করেনি

মিনার মনসুর | বুধবার , ২৪ মার্চ, ২০২১ at ৮:১৩ পূর্বাহ্ণ

[খালিদ আহসান (১৯৫৭-২০২১) চলেই গেলেন। বড় নিভৃতে। বড় বেদনাময় এই মৃত্যু। অপূরণীয় এই ক্ষতি। কী হারালাম আমরা তা হয়ত আমাদের অজানাই থেকে যাবে বহুকাল। কোনো সান্ত্বনার খুড়কুটোও খুঁজে পাচ্ছি না হাতের কাছে। ভয়াবহ সেই সংবাদটি শোনার পর থেকে এক অন্তহীন শোক ও শূন্যতার তীব্র খলজলে ভেসে যাচ্ছি। জীবদ্দশায়, এমনকী নিজের জন্মশহর চট্টগ্রামেও (যে-শহরটিকে তিনি ভিন্নতর এক উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন তাঁর অনন্য শিল্পপ্রতিভার জাদুকরী ছোঁয়ায়), ন্যূনতম স্বীকৃতিটুকুও জোটেনি তাঁর ভাগ্যে। ব্যতিক্রম নয় মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর গত কয়েক সপ্তাহের রুদ্ধশ্বাস দ্বৈরথও। বলতে গেলে একাই লড়তে হয়েছে তাঁকে। প্রিয়তমা স্ত্রী ও কন্যার সর্বস্ব উজাড় করা ভালোবাসার শিশিরটুকুই হয়ত আজন্ম তৃষ্ণার্ত এই কবির অনন্ত যাত্রার পাথেয় হয়ে থাকবে। আর মূল্যায়নের কথা যদি বলি, নিজের চেয়ে বড় মাপের মানুষকে মূল্যায়নের মতো মহত্ব আমরা কবে অর্জন করতে পারবো জানি না। আর এ মুহূর্তে সেটা সম্ভবও নয়। ২০১৬ সালে খালিদ আহসানের জীবদ্দশায় লেখা আমার এ সামান্য রচনাটি তাঁকে খুব আলোড়িত করেছিল। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে আমার সঙ্গে তাঁর যখন শেষ কথা হয় তখনও তিনি সে প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। যাঁরা খালিদ আহসান সম্পর্কে তেমন অবহিত নন, তাঁরা এতে শিল্পের জন্যে নিবেদিতপ্রাণ এ মানুষটির একটি নিখুঁত না হলেও নির্ভরযোগ্য রেখাচিত্র পাবেন বলে আমার বিশ্বাস। প্রিয় বন্ধু ও সারথির জন্যে আপাতত এটুকুই আমার বিনম্র নিবেদন।-মিম]
কবুল করতে দ্বিধা নেই যে খালিদ আহসান আমার জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগেই তাঁকে ঘিরে এক ধরনের মুগ্ধতা জন্ম নিয়েছিল আমার মধ্যে। সেই মুগ্ধতার কেন্দ্রে ছিল একটি প্রকাশনা এবং একটি গল্প। প্রকাশনাটির নাম ‘চোখ’। সেটা ছিল সিসার টাইপ আর কাঠের ব্লকের যুগ। মাকড়সার জালেভর্তি অন্ধকার প্রেসের মধ্যে বাদুড়ের মতো সন্তর্পণে আমরা বিচরণ করতাম। দেশি কালিতে নিম্নমানের কাগজে লিটলম্যাগগুলো ছাপা হতো। আমাদের জামাকাপড়ে তো বটেই, অনেক সময় মুখেও লেপ্টে থাকতো সেই কালি। সেই যুগে এত চমৎকার একটি পত্রিকা বের করা যায়- এটা ছিল আমাদের কল্পনারও অতীত।
আপাদমস্তক কালোর ভেতরে ফুটে আছে আশ্চর্য মায়াময় একটি চোখ। সম্ভবত সেটি ছিল একটি গল্প পত্রিকা। অফসেট কাগজে ছাপা। কী অপরূপ তার অঙ্গসৌষ্ঠব। চমক শুধু নামেই নয়, ফোল্ডার আকারে ছাপানো পত্রিকাটির সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে ছিল তার দ্যুতি। তার পর কর্ণফুলির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে চার চারটি ঝড়ো দশক। কিন্তু আমি এখনো মনে মনে সেই কাগজটি খুঁজি। অনন্য সেই ছোটকাগজটির নির্মাতা ছিলেন খালিদ আহসান।
গল্পটির নাম এখন আর মনে নেই। তবে আমি চোখ বন্ধ করলেই এখনো স্পষ্ট দেখতে পাই, মধ্যবয়সী ক্লান্ত একজন মানুষ একটি লালবাসের পেছনে ছুটছেন। কী চমৎকার তার ভাষাভঙ্গি! তার পর ছিল টাইপ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা। কোথাও বড় বড় টাইপে বোল্ড, কোথাও ইটালিকস, কোথাও-বা সিঁড়ির মতো তার বিন্যাস। নিরীক্ষা শুধু প্রকরণেই নয়, গোটা গল্পের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে ছিল অদ্ভুত এক বিষাদ আর সেই বিষাদ থেকে মুক্তির আকুতি। আর বিস্ময়করভাবে সর্বত্রই একটা লালরঙের ব্যাপারও ছিল প্রচ্ছন্নভাবে। মনে রাখতে হবে সেই যুগটি ছিল বিপ্লবের। আর এ গল্প এবং ‘চোখ’ নামক আশ্চর্য সুন্দর প্রকাশনাটির যিনি নির্মাতা তাকে যদি আমরা বিপ্লবী না বলি, তবে কাকে বলবো! শুধু মুগ্ধতাই নয়, খালিদ আহসান নামের অদেখা অচেনা মানুষটিকে ঘিরে- যার বয়স তখনো ২০ পার হয়নি- এক ধরনের গভীর মমত্ববোধও তৈরি হয়েছিল আমার মধ্যে। আমার মনে হতো, তার গল্পের নায়কের মতো তিনিও আত্মবিনাশপ্রবণ এক চরিত্র। তারপর তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। গড়ে উঠেছে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। কিন্তু আমার সেই ধারণা পাল্টায়নি। চেইন স্মোকার ছিলেন। এখনো সম্ভবত তাই আছেন। প্রেম করে বিয়ে করেছেন। চমৎকার একটি কন্যার জনক। কিন্তু কোথায় যেন জীবন ও জগতের সঙ্গে তার একটা বিচ্ছিন্নতা আছে। তারপরও খালিদ আহসানের সঙ্গে আমার অদ্ভুত এক আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়েছিল। পঁচাত্তরপরবর্তী সেই অন্ধকার দিনগুলোতে এক সঙ্গে দীর্ঘ পথ হেঁটেছি আমরা। মনোমালিন্যও হয়েছে। কিন্তু অন্তর্গত সেই বন্ধন কখনোই ছিন্ন হয়নি।

খালিদ আহসানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় কখন কীভাবে আজ আর মনে নেই। কিন্তু সেটা আমাদের মধ্যে এমন এক অচ্ছেদ্য বন্ধন রচনা করে দিয়েছিল যে চার দশকের দূরত্বে বসে আমি এখনো তার সুঘ্রাণ পাই। সকালে দেখা হতো। মধ্যরাত অবধি চলতো আড্ডা। শুরুটা সম্ভবত ১৯৭৬ সালের শেষের দিকে। ১৯৮৫ সালে আমি স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম ছেড়ে আসার আগে অবধি তাতে দীর্ঘ কোনো ছেদ পড়েছে বলে মনে পড়ে না। ঢাকায় আসার অর্ধযুগ পরে আমি এপিটাফ-এর যে সর্বশেষ সংখ্যাটি প্রকাশ করি, তারও প্রচ্ছদ করেছিলেন খালিদ। চট্টগ্রামে আত্মীয় পরিমণ্ডলের বাইরে এখন আমার যোগাযোগ নেই বললেই চলে। বলতে দ্বিধা নেই যে তারপরও মাঝেমধ্যে যেটুকু আড্ডা হয় কিংবা নাড়ির টান অনুভব করি তার প্রায় সবটুকুই আবর্তিত হয় খালিদকে ঘিরে। দেওয়ানহাটের মোড়ে সিটি কর্পোরেশনের একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ের প্রধান ছিলেন খালিদ আহসানের নিভৃতচারী চিকিৎসক পিতা। সপরিবারে থাকতেনও হলুদ রঙের সেই ভবনটির দোতলায়। তার থেকে অল্প দূরে ‘শেখ মুজিব সড়কে’ (আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, স্বৈরশাসনামলের সেই অবজ্ঞাপূর্ণ নামটি ইতোমধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু সড়কে’ পরিণত হয়েছে। কিন্তু সেলুকাস…) নিবেদন প্রেসে আমরা কাজ করতাম। যাত্রাপথে দিনের পর দিন সেই বাসায় গিয়েছি। খেয়েছি। বাসা থেকে প্রেস। প্রেস থেকে ৩৮৬ সিরাজুদ্দৌলা রোডে এপিটাফ-এর আড্ডা। ক্রমেই রাত গভীর হতো। চা-সিগ্রেট ফুরিয়ে যেত। কিন্তু আমাদের আড্ডা শেষ হতো না। কতো তরুণ-প্রবীণ সেখানে ঢুঁ মেরেছেন! তারা আসতেন যেতেন। কিন্তু প্রায় গভীর রাত অবধি থেকে যেতাম আমি ও খালিদ আহসান। কদাচিৎ দিলওয়ারও। সেটা ছিল মিলিটারি শাসনের কাল। ক্ষমতার প্রয়োজনে মস্তানদের সঙ্গে তাদের সখ্য বাড়ছিল। তার ভিকটিমও হতে হয়েছে আমাদের একাধিকবার।
আমি সবেমাত্র কলেজের গণ্ডি অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়েছি। বাংলা বিভাগে খালিদ আহসান ছিলেন আমার এক ক্লাস ওপরে। বয়সের হিসাবে অবশ্য দু বছরের বড়ো। আজ আমি ভাবি সেই বয়সে কী নিয়ে এত কথা বলতাম আমরা? আমাদের মধ্যে নানা বিষয়ে মিল ছিল, আবার অমিলও ছিল বড় ধরনের। আমি ছিলাম পঁচাত্তরপরবর্তী ঝড়ো রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে, আর খালিদ ছিলেন রাজনীতি থেকে শত হাত দূরে। তার মধ্যে ঋষিসুলভ একটা ব্যাপার ছিল। ছিল দেবদত্ত বিরল কিছু মাধুর্যও। নানা বয়সী নারীরা পতঙ্গের মতো তার প্রতি আকৃষ্ট হতো। আর খালিদও প্রেমের জন্যে যেন সর্বক্ষণ সর্বস্ব পেতে বসে থাকতেন। প্রেমে পড়েছেন একের পর এক। বিচ্ছেদে বিদীর্ণও হতে দেখেছি। বস্তুত প্রেমই ছিল তার প্রাণরস।
এটা খুব বিস্ময়কর ব্যাপার যে আমরা দুই বিপরীত মেজাজের মানুষ দীর্ঘদিন এতটা কাছাকাছি অবস্থান করতে পারলাম কীভাবে? কী সেই রহস্য বা রসায়ন? আমার মনে হয়, দুটি বিষয় এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। প্রথমত, স্বভাবের দিক থেকে আমরা দুজনেই ছিলাম প্রচারবিমুখ, নিভৃতচারী এবং অনেকটা ছন্নছাড়া প্রকৃতির। দ্বিতীয়ত, খালিদ আহসানের মধ্যে শিল্পের জন্যে এক ধরনের আগ্রাসী ক্ষুধা ছিল। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক নিরীক্ষাপ্রবণ এক মানুষ। আমাদের অদম্য প্রাণশক্তি ও প্রতিবাদী চরিত্র এক্ষেত্রে হয়তো তার সহায় হয়েছিল। প্রায় সব বিষয় নিয়েই আমরা আলাপ করতাম। নারী, প্রেম, যৌনতা- কিছুই বাদ যেত না। তবে আমাদের আলাপের মূল বিষয় ছিল শিল্পসাহিত্য ও প্রকাশনা।
আমরা ‘এপিটাফ’ বের করতাম। এ নিয়ে তাঁর আগ্রহ কতোটা ব্যাপক ছিল তা বোঝা যায়- পত্রিকাটির প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা দেখলে। নিজেকে উজাড় করে দিতেন। খালিদের করা ‘এপিটাফ’ দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে শেষ সংখ্যা অবধি প্রতিটি প্রচ্ছদই ছিল ঝাঁকুনি দেওয়ার মতো। শুধু কি ‘এপিটাফ’? এপিটাফ প্রকাশনী থেকে আমরা ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’, ‘আবার যুদ্ধে যাবো’, মহাদেব সাহার কাব্যগ্রন্থ ‘তোমার পায়ের শব্দ’ এবং আমাদের বন্ধু নাজিম হাসানের গল্পগ্রন্থ ‘শিহরায় রডোডেনড্রন’সহ বেশকিছু বই ও পত্রপত্রিকা প্রকাশ করি। সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে তাঁর জাদুকরী হাতের ছাপ।
এতেও তাঁর ক্ষুধা পুরোপুরি মিটতো না। নিরন্তর নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে আসতেন। তাগাদা দিতেন আরও লিটল ম্যাগ করার জন্যে। ‘এপিটাফ’কে ঘিরে যে আড্ডা ছিল সেখান থেকে পরে ‘একজন’, ‘আঠারো’ ‘কাঠঠোকরা’ও ‘বৃক্ষ’ নামে আরও কিছু ছোট কাগজ প্রকাশিত হয়েছে নানা জনের সম্পাদনায়। সবকটি প্রকাশনার নেপথ্যে ছিল তাঁর শৈল্পিক প্রণোদনা। এ ছাড়া রাজনীতি-সম্পৃক্ততার কারণে সারা চট্টগ্রামের রাজনৈতিক-সামাজিক ও ছাত্র সংগঠনের নেতারা প্রকাশনা-সংশ্লিষ্ট যেকোনো কাজের জন্যে ছুটে আসতেন আমাদের কাছে। খালিদ আহসান হাসিমুখে সব কাজ করে দিতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা সমিতির সাহিত্য সম্পাদক এবং চাকসুর বার্ষিকী সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম। বাংলা সমিতির প্রকাশনা ‘নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে’ এবং চাকসু বার্ষিকীরও প্রচ্ছদ করেছিলেন খালিদ আহসান। ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক নানা ধরনের প্রকাশনার সঙ্গেও আমরা যুক্ত ছিলাম। মনে পড়ছে, ‘ক্যাম্পাস-সাহিত্য’ নামে যে প্রকাশনাটি তখন খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তাতেও খালিদ আহসানের হাতের ছোঁয়া ছিল।

আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক ঘটনার সঙ্গেও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছেন খালিদ আহসান। তার মধ্যে সবার আগে উল্লেখ করতে হয় ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’-এর কথা। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে আমরা যখন এ ধরনের একটি প্রকাশনার উদ্যোগ নেই তখন অনেকেই ভয় পেয়ে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিলেন নিরাপদ দূরত্বে। ব্যতিক্রম ‘আপাদমস্তক প্রেমিক ও রাজনীতিবিমুখ’ খালিদ আহসান। তিনি শুধু যে সর্বক্ষণ পাশে ছিলেন তাই নয়, এমনকি নামটিও ছিল তাঁরই দেওয়া। অল্পদিনের ব্যবধানে আমি যখন চাকসু নির্বাচনে বার্ষিকী সম্পাদক পদপ্রার্থী হই, তখন আমার প্রচারের সব দায়িত্ব তিনি তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। স্টুডিওতে গিয়ে নিজে নির্দেশনা দিয়ে আমার ছবি তুলে এক রঙের অভিনব যে-সব ক্ষুদ্রাকৃতির প্রচারপত্র তিনি করেছিলেন তা সারা দেশের ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচনী প্রচারণার ধরনই বদলে দিয়েছিল।
আমার জীবনের খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি প্রাপ্তি হলো সিকদার আমিনুল হকের বন্ধুত্ব। সেখানেও খালিদের হাত ছিল প্রচ্ছন্নভাবে। এমনিতে আমি খুব ভেতরঘোঁজা মানুষ। নিজে থেকে কারো সঙ্গে মিশতে পারি না। আর সিকদার ভাইয়ের মতো মানুষের সঙ্গে এ জীবনে আমার হয়তো মেশাই হতো না। মূলত খালিদ আহসানই আমাকে প্রলুব্ধ করেছিল। এজন্যে আমরা উভয়েই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলাম। খুবই ব্যক্তিগত হলেও না বলে পারছি না যে আমার বিয়েতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল খালিদের। যদিও মূল ভূমিকাটি ছিল সিকদার ভাইয়ের। খালিদ আহসানের গভীর গহন কিছু বেদনার সঙ্গী ছিলাম আমি। একইভাবে আমারও বিক্ষত হৃদয় নিবিড় শুশ্রূষা পেয়েছে তাঁর কাছে।

জীবন সবার প্রতি সুবিচার করে না। এ কথাটি আমি প্রায়শ বলে থাকি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে জীবন খালিদের প্রতিও সুবিচার করেনি। চট্টগ্রামের শুধু নয়, বাংলাদেশেরও তাঁর প্রজন্মের অন্যতম সেরা প্রতিভাবান সব্যসাচী লেখক তিনি। কবিতা, গল্প এবং শিল্পকর্ম- সর্বত্রই তিনি ছিলেন অন্য সবার কাছ থেকে আলাদা। সেই তরুণ বয়সেই দেখেছি, তাঁর হাতের স্পর্শে তুচ্ছ জিনিসও শিল্প হয়ে উঠতো। তাঁকে দেখে সবসময়েই আমার মনে হয়েছে যে শিল্পের ঈশ্বর যেন নিজের হাতে তৈরি করেছেন এ মানুষটিকে। বুদ্ধদেব বসু একটি অসাধারণ কথা বলে গেছেন তাঁর ‘দারিদ্র্যের ঐশ্বর্য ঐশ্বর্যের দারিদ্র্য’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে। একের পর এক দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে ঈশ্বর যাঁকে কবি বা শিল্পীর শিরোপা দেবেন বলে সাব্যস্ত করেছেন, তার জন্যে তিনি আগেই পথ পরিষ্কার করে রাখছেন। নির্দয়ভাবে তুলে নিচ্ছেন তাঁর যোগ্যতম প্রতিদ্বন্দ্বীটিকে। আমি জানি না খালিদের ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে কিনা।
মাঝে মাঝে আমার এমনও মনে হয় যে খালিদ তাঁর ঈশ্বরদত্ত প্রতিভার প্রতি সুবিচার করেননি। নানা ধরনের কাজ করতে গিয়ে (প্রধানত জীবিকাধর্মী) তাঁর মূল্যবান সময় শুধু নয়, প্রতিভারও ব্যাপক অপচয় হয়েছে বলে আমার ধারণা। ধনী চিকিৎসক পিতার একমাত্র সন্তান খালিদের জীবিকা নিয়ে খুব একটা সমস্যা থাকার কথা নয়। তা ছাড়া আমি যতদূর জানি, তাঁর স্ত্রী আইভি ভাবীও উপার্জনশীল মানুষ। আসলে বাইরে থেকে অন্যের সমস্যা বোঝা কঠিন শুধু নয়, অসম্ভবও বটে। যে-কারণেই হোক, খালিদ হয়তো শিল্পের জন্যে সর্বস্ব উজাড় করে দিতে পারেননি। যদি পারতেন, আমি নিশ্চিত যে বাংলা সাহিত্য তাঁকে নিয়ে গর্ব করতো। আপাতত শুধু এটুকু বলি, চট্টগ্রাম ছেড়ে এসেছি দীর্ঘদিন। কিন্তু অদ্যাবধি তাঁর সমতুল্য বহুমাত্রিক কোনো প্রতিভার দ্যুতি আমার চোখে পড়েনি।

আগামী প্রকাশনী থেকে ২০১৩ সালে প্রকাশিত ‘কবি ও কবিতার সংগ্রাম’ নামে একটি প্রবন্ধের বই আমি খালিদকে উৎসর্গ করেছি। উৎসর্গপত্রে তাঁর সম্পর্কে আমি লিখেছিলাম, তিনি ‘আমার অস্থির অনিশ্চিত শিল্পযাত্রার সূচনালগ্নের সঙ্গী, সহযাত্রী ও সারথি’। মহাবীর অর্জুনের সারথি ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। আমার জীবনের উষালগ্নে খালিদ আহসানের ভূমিকাও ছিল তাই। তিনি ছিলেন একাধারে আমার বন্ধু, বড়ভাই ও উপদেষ্টা। পঁচাত্তরপরবর্তী কালের অগ্নিগর্ভ সেই দিনগুলোতে পরিশীলিত ব্যক্তিত্বের আপাদমস্তক শিল্পমগ্ন এ মানুষটি পাশে না থাকলে ভেতরের পুঞ্জীভূত বারুদ নিয়ে আমি হয়তো বহ্নিমুখ পতঙ্গও হতে পারতাম। ১৬ আগস্ট ২০১৬
লেখক : কবি; পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রত্যাশা প্রাপ্তি ও আগামীর চ্যালেঞ্জ
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ