বাংলদেশের স্বাধীনতা এসেছে অনেক ও রক্তের বিনিময়ে। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা/ তোমাকে পাওয়ার জন্যে/ আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়/ আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন/ তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা/ সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো/ সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর/ তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা/ শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো/ দানবের মতো চিৎকার করতে করতে/ তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা/ ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েলস রাইফেল/ আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র/ তুমি আসবে ব’লে ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম/ তুমি আসবে ব’লে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার/ ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর/ তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা/ অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতা-মাতার লাশের ওপর।’
সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম ছিল বহুবিধ ঘটনা, বিরূপ পরিস্থিতি, অসম আর্থিক বণ্টন ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কর্তৃত্বের বঞ্চনাসহ গুরুতর বিষয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের ক্রমাবনতির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর থেকেই পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যেসব ইস্যুতে সম্পর্কের অবনতি ঘটে, তার মধ্যে ছিল ভূমি সংস্কার, রাষ্ট্রভাষা, অর্থনীতি ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে দুই প্রদেশের মধ্যে বৈষম্য, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের ১৬৭টিতেই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তাানের জনগণের একক প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনিই হন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখাগরিষ্ঠ দলের নেতা। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ ও এর নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ শেখ মুজিব যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, তাতেই পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কাছে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ইতোমধ্যে সমস্যা নিরসনের জন্য মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা শুরু হয়। সেসাথে চলে বাঙালি নিধনের ষড়যন্ত্র। আলোচনা ব্যর্থ হয় এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। যা অপারেশন সার্চলাইট হিসেবে পরিচিত। ইয়াহিয়া আলোচনার ফাঁকে ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে অপারেশন সার্চলাইটের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। তার আগেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে থাকেন। রসদবাহী জাহাজ সোয়াত চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়ে।
২৫ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাঙালিদের উপর আক্রমণ শুরু করে। অপারেশন সার্চ লাইটের পরিকল্পনা অনুযায়ী দুটি সদরদপ্তর স্থাপন করা হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর তত্ত্বাবধানে প্রথম সদরদপ্তরটি গঠিত হয়। এখানে ৫৭তম ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার আরবাবকে শুধু ঢাকা নগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় এবং মেজর জেনারেল খাদিম রাজাকে প্রদেশের অবশিষ্টাংশে অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। অপারেশনের সার্বিক দায়িত্ব থাকেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান। ছাত্র-জনতা ক্যান্টনমেন্টের বাইরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের অভিযান ঠেকাতে রাস্তায় প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করা হয়। ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা ওয়ারলেস বসানো জিপ ও ট্রাকে করে ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়ে। সেনাবহর শুরু করে গণহত্যা। পাকিস্তানি সৈন্যরা রাস্তায়-ফুটপাতে যাকে দেখতে পায় তাকেই হত্যা করে। সরকারি-বেসরকারি সব ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত করে চষে বেড়ায় ট্যাঙ্ক। কামান ও বন্দুকের গোলায় ধ্বংস করে বহু আবাসিক এলাকা, আগুন ধরিয়ে দেয় বাড়িঘরে। নিরস্ত্র জনগণের উপর এই হামলা ও নির্বিচার গণহত্যা অভিযান বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয়। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তনি সৈন্যরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে।
বাঙালি নিধনযজ্ঞের পরও দাবিয়ে রাখতে পারেনি। মরণপণ লড়াই করে অবশেষে মাত্র নয় মাসে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলাদেশের। সবুজের বুকে রক্তিম সূর্য খচিত মানচিত্র এল। এবছর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছে বাঙালি জাতি। আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের সরকার প্রধানরা দশদিনের অনুষ্ঠানমালায় সামিল হয়েছেন। বীর বাঙালির অর্জনকে সাধুবাদ জানাতে কার্পণ্য করছেন না। স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, আর তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গড়ে উঠছে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উত্তরণ সবচেয়ে বড় অর্জন।
স্বাধীনতার পর ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ দেশ আখ্যা দিয়ে যারা অপমান-অপদস্থ করেছিল, সেই তাদের কণ্ঠেই এখন বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা। অনেকর জন্য রোল মডেল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে বাঙালির বহু ত্যাগ ও নির্যাতনের ইতিহাস। তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সেই স্বজন হারানো, সম্ভ্রম হারানোর শোক ও লজ্জাকে শক্তিতে পরিণত করে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে এই দেশের মানুষ। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে তিনি অনন্য দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ঘাতকের বুলেট ঝাঁজরা করে দেয় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে। তবে আজকের অবস্থানে আসা সহজ ছিল না। ‘স্বাধীনতা তোমার আগমন দেখিনি আমি/ তবে তোমার অস্তিত্ব অনুভব করি/ কিভাবে এসেছিলে আর কোথায় ছিলে তুমি/ সবটুক জানি যখন ইতিহাস পড়ি।’
করোনাকালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছি স্বাস্থ্যবিধি মেনে। পৃথিবীতে কোনো দুর্যোগই স্থায়ী হয় না। এই অমস্যার পর পূর্ণিমা আসবেই। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।