প্রায় ৮০০ শূন্যপদ পূরণে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পৃথক ছয়টি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এতে ৫০ হাজারের অধিক আবেদন জমা পড়ে। ওই বিজ্ঞপ্তির শর্তে বলা হয়েছিল, চসিকে অস্থায়ী ভিত্তিতে কর্মরতদের বয়স শিথিল করার পাশাপাশি অগ্রাধিকার দেয়া হবে। ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত প্রায় চার হাজার অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীও আবেদন করেন। দীর্ঘ দেড় বছর অতিবাহিত হলেও ওই বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি।
সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ১৩ পদে ৬০ জন নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দেয় চসিক। সেখানে ২০২০ সালের পদগুলোও রয়েছে। তবে এবার বয়সের শর্ত দেয়া হয়। ফলে আবেদনের সুযোগ হারান দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে অস্থায়ী ভিত্তিতে কর্মরতরা। যাদের মধ্যে এক যুগেরও বেশি অস্থায়ীভাবে কর্মরতও আছেন। এছাড়া কয়েকদিনের মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদের বিপরীতেও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের গুঞ্জন আছে। এ অবস্থায় স্থায়ী হওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কায় টাইগারপাসস্থ নগর ভবনের সামনে পৌনে চারঘণ্টা অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কমর্চারীরা। বিকেল তিনটার দিকে সংঘবদ্ধভাবে তারা নগর ভবন আসেন। প্রথমে তারা দ্বিতীয় তলায় মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষের সামনে অবস্থান নেন। এসময় তারা চাকরি স্থায়ী করার দাবি জানান। অন্যথায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতির হুমকি দেন। এরপর চারটার দিকে মেয়র নিচতলার কনফারেন্স রুমে একটি মিটিংয়ে যোগ দিলে বাইরে অবস্থান নেন তারা। এসময় কয়েকবার স্লোগানও দেন। ছয়টার দিকে মিটিং শেষে মেয়র ও প্রধান নির্বাহী বের হলে কর্মচারীরা তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। এসময় মেয়র নিজ কক্ষে চলে গেলে কর্মচারীরা আবার তার কক্ষের সামনে অবস্থান নেন। শেষে চসিক সংগঠনের (সিবিএ) পাঁচজন প্রতিনিধি মেয়র ও প্রধান নির্বাহীর সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে মেয়র জনবল কাঠামোর বিপরীতে শূন্যপদে অস্থায়ীদের স্থায়ী করার আশ্বাস দেন। এরপর সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় চসিক কাউন্সিলর মোবারক আলী মেয়রের অবস্থান তুলে ধরলে কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন শ্রমিকরা।
মোবারক আলী আন্দোলনরতদের উদ্দেশ্যে বলেন, মেয়র মহোদয়ের পক্ষ আমি আপনাদের সু-সংবাদ দিচ্ছি। আপনাদের শঙ্কিত হওয়ার কারণ নাই। আপনাদের দাবির প্রতি মেয়র মহোদয় আন্তরিক। ইতোমধ্যে যে সার্কুলার দেয়া হয়েছে সেখানে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির পদ নাই। সামনেও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির পদের বিপরীতে সার্কুলার হবে না। বিষয়টি নিশ্চিত করে মোবারক আলী আজাদীকে বলেন, আলাপ-আলোচনা বিষয়টি করে সমাধানের পক্ষে রয়েছেন আমাদের মেয়র। তাদের প্রতিনিধিরা সবসময় আলোচনা করতে পারবেন। বিক্ষোভ করলে মেয়র মহোদয় বিব্রত হবেন।
চসিক শ্রমিক ও কর্মচারী লীগ সভাপতি ফরিদ আহমেদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ১৫-১৮ বছর চাকরি করেও অনেকে স্থায়ী হতে পারে নি। ২০২০ সালের বিজ্ঞপ্তির আলোকে তাদের স্থায়ী হওয়ার সুযোগ ছিল। এখন যে সার্কুলার দিয়েছে সেখানে বয়সের শর্ত দেয়ায় অস্থায়ীরা আবেদনও করতে পারবে না। কয়েকদিনের মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির সার্কুলার দেয়া হবে বলে শ্রমিকরা জানতে পেরেছে। তাই তারা তাদের বক্তব্য জানিয়েছেন। বিষয়টি আমরা মেয়রকে বুঝাতে পেরেছি। মেয়র মহোদয় আশ্বাস দিয়েছেন, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে না। অস্থায়ীদের জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে স্থায়ী করবেন। প্রয়োজনে সাধারণ সভা বা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে হলেও স্থায়ীকরণের উদ্যোগ নিবেন।
চসিক অস্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মো. সালাহউদ্দিন আজাদীকে বলেন, এক যুগের বেশি চাকরি করেও স্থায়ী না হওয়া অমানবিক। আমাদের বিশ্বাস, মেয়র মহোদয় কর্মচারীদের কষ্টটা বুঝবেন।
এদিকে গতকাল প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত পদগুলোর মধ্যে রয়েছে জনসংযোগ কর্মকর্তা, চিকিৎসক, প্যাথলজিস্ট, ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা, সহকারী প্রকৌশলী, সহকারী এস্টেট অফিসার, উপ সহকারী প্রকৌশলী। এসব পদে আগামী ৭ অক্টোবর পর্যন্ত আবেদন করা যাবে। পদগুলোর বিপরীতে বর্তমানে দীর্ঘ ১২ বছরের বেশি সময় ধরে অস্থায়ীভাবে কর্মরত আছেন। তারা কয়েকদিনে মধ্যে চসিকের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা আজাদীকে জানিয়েছেন। এছাড়া কয়েক মাস পর একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর অবসরে যাওয়ার কথা রয়েছে। ওই পদেও জ্যেষ্ঠতা লক্সঘন করে একজন ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীকে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেখানেও বঞ্চিতরা উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
চসিকের সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চসিকে ৯ হাজারের বেশি জনবল কর্মরত। সংস্থাটি বর্তমানে ১৯৮৮ সালের জনবল কাঠামো ধারায় পরিচালিত হয়। এতে সৃজিত পদের সংখ্যা ৩ হাজার ১৮০ জন। এর বিপরীতে প্রায় ৯০০ পদ খালি আছে। এছাড়া ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে এক হাজার ৪৬ নতুন পদ সৃষ্টির অনুমোদন দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বিভিন্ন ক্যাটাগরির এক হাজার ১৪৮টি পদে নিয়োগের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব করে চসিক। পরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ৬১২ পদের বিপরীতে সরাসরি ও ৫৩৬ পদে আউটসোর্সিং নীতিমালায় ছাড় দেয় মন্ত্রণালয়। এর প্রেক্ষিতে ২০২০ সালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে চসিক।
এদিকে গত ২৩ মার্চ নিয়োগের বাছাই কমিটিতে স্থানীয় সরকারের দুইজন প্রতিনিধিও মনোনয়ন দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এছাড়া ১৫ মার্চ প্রধান নির্বাহীকে আহ্বায়ক ও চসিক সচিবকে সদস্য সচিব করে তৃতীয়-চতুুর্থ শ্রেণির এবং মেয়রকে আহ্বায়ক ও প্রধান নির্বাহীকে সদস্য সচিব করে দুটো নিয়োগ কমিটিও গঠন করে চসিক। এরপরও নতুন করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সংস্থাটি। এক্ষেত্রে বর্তমান প্রধান নির্বাহীকে দায়ী করেছেন আন্দোলনকারীরা।
এদিকে অস্থায়ীভাবে কর্মরতদের স্থায়ী করতে গত ১৩ জুলাই চসিক সচিবকে আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল আলম। গত ৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত এ কমিটির কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত কর্পোরশেনের যেসব অস্থায়ী কর্মচারী তাদের চাকুরি স্থায়ীকরণে উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন তাদের চাকুরি স্থায়ীকরণে রায় হয়েছে। অন্য অস্থায়ীরাও আদালতে গেলে রায় একই রায় হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। এতে আরো বলা হয়, বেশিরভাগ অস্থায়ী কর্মচারীর চাকুরিকাল ১৫-২০ বছর। পূর্বে বিভিন্ন সময়ে চসিক সম পর্যায়ের সহস্রাধিক অস্থায়ী কর্মচারীর চাকুরি স্থায়ী করেছে। প্রচলিত বিধি-বিধান, কর্পোরেশনের প্রয়োজনীয়তা, মানবিকতা-সবগুলো সমন্বয় করে অস্থায়ী কর্মচারীদের স্থায়ীকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে বলেও এতে উল্লেখ করেন চসিকের আইন কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন।
এদিকে গতকাল আন্দোলনরতরা অভিযোগ করেন, অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত কর্মীদের বিষয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কোনো কিছু বলা হয়নি। এমনকি তাদের স্থায়ীকরণের বিষয়েও কোনো পদক্ষেপ নেই। এই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী নিয়োগ করা হলে অস্থায়ীভাবে কর্মরতরা বাদ পড়ে যাবেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী বলেন, প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাস্তবায়িত হলে আমরা বিপদে পড়ব। কেননা পরবর্তী সময়ে অন্যান্য পদেও এই ধারা বজায় থাকবে। তখন আর স্থায়ী হতে পারব না। তাই বিজ্ঞপ্তির শর্ত পরিবর্তন করতে হবে। ১৭ বছর ধরে কর্মরত এক কর্মচারী বলেন, দীর্ঘদিন স্থায়ী করেনি সেটা চসিকের ব্যর্থতা। স্থায়ী হওয়ার জন্য করা মামলায় কর্মচারীর পক্ষে রায় আসে। কিন্তু মামলা করে মেয়র মহোদয়কে বিব্রত করতে চাই না।