লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) মাধ্যমে গত বছরের মার্চ থেকে জুন চার মাসে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৩৭ লাখ ৯১ হাজার ৩৪২ টন। চলতি বছরের মার্চ-মে তিন মাসে পণ্য হ্যান্ডলিং নেমে আসে ১৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯৩২ টনে। জুন-জুলাই মাসে এই সংস্থার মাধ্যমে এক টন পণ্যও হ্যান্ডলিং হয়নি। এতে করে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটের পণ্য পরিবহনের অন্যতম নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলে স্থবিরতা দেখা দেয়। চার শতাধিক লাইটারেজ জাহাজের বহর অলস বসে রয়েছে কর্ণফুলী নদীতে। নাজুক এই অবস্থার অবসান ঘটাতে গতকাল শনিবার চট্টগ্রামে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠক থেকে লাইটারেজ জাহাজ চলাচলে গতি আনতে অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয়।
সূত্র জানিয়েছে, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাতে বছরে অন্তত চার কোটি টন পণ্য লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে হ্যান্ডলিং করা হয়। ডব্লিউটিসির নিয়ন্ত্রণাধীন দেড় হাজার এবং বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকাধীন প্রায় আড়াইশ লাইটারেজ জাহাজ রয়েছে। এর বাইরে চারশর মতো ভাড়া করা জাহাজে কারখানা মালিকেরা পণ্য হ্যান্ডলিং করেন। এর বাইরে অবৈধ এবং অননুমোদিত একশটির মতো ভলগেটও বহির্নোঙর থেকে পণ্য পরিবহন করে। ডব্লিউটিসির তালিকাভুক্ত ৮০ জন লোকাল জাহাজের এজেন্ট এবং ৩২ জন পণ্যের এজেন্ট আমদানিকারকদের প্রতিনিধি হিসেবে কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করেন।
ডব্লিউটিসি মার্চ থেকে মে প্রায় ১৫ লাখ টন পণ্য হ্যান্ডলিং করেছে। পরবর্তী দুই মাসে এক টন পণ্যও পায়নি। ডব্লিউটিসি পণ্য হ্যান্ডলিং করতে
না পারলেও বহির্নোঙর থেকে ঠিকই নানা গন্তব্যে লাখ লাখ টন পণ্য পরিবাহিত হচ্ছে। প্রচলিত নিয়মে আমদানিকারকদের পণ্য পরিবহনে ডব্লিউটিসি থেকে জাহাজ ভাড়া নেওয়ার কথা। কিন্তু তা না করে গোপনে এবং নানা অবৈধ পন্থায় পণ্য পরিবাহিত হচ্ছে।
ডব্লিউটিসির তালিকাভুক্ত জাহাজ পণ্যের অভাবে বসে থাকলেও অবৈধ ভলগেট লাখ লাখ টন পণ্য নিয়ে সাগর পাড়ি দিচ্ছে। অবৈধ এসব তৎপরতা ঠেকাতে নানাভাবে চেষ্টা করেও কাজ হয়নি। ডব্লিউটিসির ভাড়া বেশি বলে অভিযোগ করে আমদানিকারকরা ভিন্ন পথে পণ্য পরিবহন করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধভাবে চলাচলকারী জাহাজ ও ভলগেটগুলো মাইনাস-১০০, মাইনাস-১৫০ বলে উল্লেখ করে ভাড়া দাবি করে। মাইনাস দিয়ে ডব্লিউটিসির নির্ধারিত ভাড়া থেকে টনপ্রতি ১০০ বা ১৫০ টাকা কম বোঝায়। ডব্লিউটিসি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পণ্য পরিবহনের নির্ধারিত ভাড়া ৫৪৮ টাকা। গত কয়েক মাস ধরে এর চেয়ে কম ভাড়ায় অবৈধভাবে পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে।
এদিকে কারখানা মালিকদের জাহাজগুলো শুধুমাত্র কারখানার আমদানিকৃত কাঁচামাল পরিবহনের কথা। কিন্তু কিছুদিন ধরে কারখানা মালিকদের জাহাজগুলোও সাধারণ আমদানিকারকদের পণ্য কম ভাড়ায় পরিবহন করছে। এতে করে ডব্লিউটিসি অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাতের পণ্য পরিবহনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ডব্লিউটিসির ভাড়া কমানোর প্রস্তাব করা হলেও একটি মহল তা কমাতে দিচ্ছে না উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, ডব্লিউটিসি ভাড়া কমালে অবৈধভাবে চলাচলকারী জাহাজগুলো আর মাইনাস ১০০ বা মাইনাস-১৫০ বলতে পারবে না। ডব্লিউটিসির ভাড়া বাজারে যে প্রভাব রেখেছে সংস্থাটি ভাড়া কমালে তা থাকবে না। এদিকে অলস বসে থাকা জাহাজের মালিকরা নাবিকদের বেতন-ভাতা যোগাতে পারছেন না।
অভ্যন্তরীণ নৌ রুটে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে গতকাল হোটেল আগ্রাবাদের কনফারেন্স রুমে ডব্লিউটিসি, জাহাজ মালিকদের বিভিন্ন সংগঠন, পণ্যের এজেন্ট এবং লোকাল এজেন্টদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগং (আইভোয়াক), ডব্লিউটিসি কার্গো এজেন্ট এসোসিয়েশন (ডব্লিউটিসিএএ) ও ডব্লিউটিসি লোকাল এজেন্ট এসোসিয়েশনের (ডব্লিউটিসিএলএ) নেতৃবৃন্দ অংশ নেন। বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমদ (বীর বিক্রম), মাদারীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুনির চৌধুরী, বিসিভোয়ার নবনির্বাচিত সভাপতি ইকবাল হোসেন, ডব্লিউটিসির উপদেষ্টা মো. তৌহিদুল আনোয়ার, বিসিভোয়ার নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুরুল হক, সহসভাপতি নাজমুল হোসাইন হামদু, সাংগঠনিক সম্পাদক জি এম ছারোয়ার, আইন বিষয়ক সম্পাদক কাজী আব্দুল করিম, নির্বাহী সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবির, মোহাম্মদ খুরশিদ আলম, একেএম শামসুজ্জামান রাসেল, ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগংয়ের সভাপতি শফিক আহম্মেদ, ডব্লিউটিসি কার্গো এজেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি বেলায়েত হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ মো. জাহাঙ্গীর আলম, ডব্লিউটিসি লোকাল এজেন্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নরোত্তম চন্দ্র সাহা এবং ডব্লিউটিসির নির্বাহী সদস্য মো. জাহাঙ্গীর আলম দোভাষ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
তিন ঘণ্টা ধরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বর্তমান অচলাবস্থার অবসান ঘটিয়ে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আলোচনা হয়। সভায় সবগুলো সংগঠনের পক্ষ থেকে ডব্লিউটিসির পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করা হয়। অবৈধ ভলগেট এবং অননুমোদিত জাহাজে যাতে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য বোঝাই দেওয়া না হয় তা নিশ্চিত করতে অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী, বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, কোস্টগার্ডের ডিজিসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সবগুলো জাহাজ ডব্লিউটিসির সিরিয়ালে চলা এবং পণ্য পরিবহন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার পর ডব্লিউটিসির ভাড়া কমিয়ে সমন্বয় করা হবে বলে জানা গেছে।
সবগুলো জাহাজ সিরিয়ালে চলাচলের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে বিসিভোয়ার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুরুল হক আজাদীকে জানান। তিনি বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যা করার দরকার করা হবে। আমরা সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেছি। কোনো অনিয়ম আর মেনে নেওয়া হবে না। সব অবৈধ কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।