সোনালি রোদ্দুরের আশায়

রেজাউল করিম | বুধবার , ৬ জানুয়ারি, ২০২১ at ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ

‘আর কতদিন স্কুল বন্ধ থাকবে, কতদিন স্কুল মাঠে খেলিনা, দেখা হয় না কারো সাথে, ভাল্লাগে না কিছুই’ -শিশু-কিশোরদের এমনই কথা। আরও একটি বছর চলে গেল। স্বাগত ২০২১। এ বছর সব দুঃখ বেদনার মাঝে নতুন বছরকে আমরা বরণ করেছি। এরপরেও সবার মাঝে জাগায় প্রাণের স্পন্দন। সূর্য ওঠে, সূর্য ডোবে। আশা-আকাঙ্ক্ষার দোলাচলে প্রবাহিত হয় মানুষের জীবন। তেমনই আরও একটি লাল সূর্যের আভায় আলোকিত জগৎ। কিন্তু এই সূর্যের তাৎপর্য পুরো পৃথিবীর কাছেই অন্যরকম। কেবল রাতের অন্ধকার নয়, বিগত বছরের জরা, ক্লেদ, আতঙ্ককেও হয়তো বিদায় দেবে নতুন সূর্য। সূর্যের আলোর কাছে প্রত্যাশা এমনই। বিশেষ করে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষে নীল যে বিগত বছর, সেই মৃত্যু-উপত্যকা পাড়ি দিয়ে নতুন জীবনের আহ্বানে ছুটে চলার প্রত্যয় নিয়েই হাজির নতুন এই সূর্য। ‘হে সূর্য! শীতের সূর্য/ হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়/ আমরা থাকি/ যেমন প্রতীক্ষা ক’রে থাকে কৃষকদের চঞ্চল চোখ/
ধানকাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্যে/ হে সূর্য, তুমি তো জানো/ আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব/ সারারাত খড়কুটো জ্বালিয়ে/ এক-টুকরো কাপড়ে কান ঢেকে/ কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই/ সকালের এক-টুকরো রোদ্দুর/ এক টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামী/ ঘর ছেড়ে আমরা এদিক ওদিকে যাই/ এক-টুকরো রোদ্দুরের তৃষ্ণায়/ হে সুর্য/ তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে/ উত্তাপ আর আলো দিও/ আর উত্তাপ দিও/
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে…।’
নতুন আশা নিয়ে বরণ করেছে ২০২১ খ্রিস্টাব্দকে। নববর্ষ মানেই সবার মাঝে জাগায় প্রাণের নতুন স্পন্দন, নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা। বিগত বছরের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা পেছনে ফেলে নতুন বছরে অমিত সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাওয়া। নতুন বছর নিয়ে এবার মানুষের প্রত্যাশা একটি করোনামুক্ত বিশ্ব। তবে, করোনাভাইরাসের টিকা ছাড়াও অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনাসহ মানবসম্পদ তৈরির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হচ্ছে এই বছরের বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে, এটাই নতুন বছরে সবার প্রত্যাশা।
বিষাদের বছর হিসেবে ২০২০ ইতিহাসে থেকে যাবে। অভিশপ্ত এ বছরটিকে বিদায় দেওয়ার জন্য সবাই যেন উন্মুখ হয়েই ছিল। অনেকেই মনে করেন, জীবন ও জীবিকার ওপর আঘাতের যে চিত্র বছরজুড়ে মানুষ দেখেছে, গত শতবর্ষে তা দেখা যায়নি। কোভিড-১৯-এর আগের বিশ্ব আর পরের বিশ্বের মধ্যে মিল কোনো দিনই হবে না।
অনেকে এ বছরটিকে একটি বিধ্বংসী বছর বলে উল্লেখ করেছেন। কোভিড-১৯ মহামারিতে লাখ লাখ মানুষ এরই মধ্যে মারা গেছেন। সেই সঙ্গে কয়েক কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং অর্থনৈতিক খাতে ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। ১৫০ কোটির বেশি শিশু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে স্কুলে যেতে পারেনি। কয়েকটি দেশ মাঝখানে খুলে দিয়ে আবারও বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। ওসব দেশে সাথে সাথে আক্রান্ত ও মৃত্যু দুটোই বেড়ে গিয়েছিল।
চীনের উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। ক্রমেই মহামারি আকারে সংক্রমণ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তবে, বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত অনেক দেশের তুলনায় ভালো। করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করছেন ব্লুমবার্গ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে তা প্রকাশ পেয়েছে।
গেল বছরটি সারা পৃথিবীতেই বিষাদের বছর হিসেবে ইতিহাসে থেকে যাবে। বছরটিতে করোনাভাইরাসে দেশের অনেক সূর্যসন্তানকে হারিয়েছি। বিপুল প্রাণসংহারের বছর হলেও এর বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রা ও গতিও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কোভিড- ১৯ এর কারণে বিশ্বে যে পরিমাণ বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি হয়েছে, অন্য কোনো রোগের ক্ষেত্রে এক বছরে মানুষ এতটা এগোতে পারেনি। সাধারণ সময়ে, একটি টিকা তৈরি করতে ১০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এবার এক বছরের কম সময়ে একাধিক করোনার টিকা তৈরি করা হয়ে গেছে, অনেক দেশে প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশ টিকা এনে প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত।
বিশ্ব অর্থনীতি করোনাকালে তছনছ হয়ে গেলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চিত্রটা ভিন্ন।
সিইবিআরের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, আর মাত্র সাত বছর পরেই চীন হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০৩০ সালে ভারত হবে তৃতীয়। আর ২০৩৫ সাল নাগাদ ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বহু ধাপ উপরে উঠে পৌঁছে যাবে ২৫ নম্বরে।
সিইবিআর তাদের রিপোর্টে বলছে, কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর আগের বছরগুলোতে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল বেশ ভালো। যদিও এই মহামারির কারণে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ছিল সীমিত, তা সত্ত্বেও অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করেছে এটি। তবু এসব পূর্বাভাসে নতুন করে প্রত্যাশাও তৈরি হয়েছে। নতুন সূর্যের কাছে আশা একটু সোনালি রোদ্দূর। যেখানো আবার লুটোপুটি করবে শিশুরা। বদ্ধ ঘরে আলো প্রবেশ করবে। আবার হাটে-মাঠে-ঘাটে-স্কুলে তারা স্বাভাবিকভাবে যাবে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলবে-গুমোট ও বিষাদে ভরা বিশ্ব আমরা চাই না। সোনালি দিনের আশায় স্বাগত ২০২১।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআর কত দিবি ফাঁকি?
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় নিখোঁজ জাপা নেতাকে ফিরে পেতে স্বজনদের আকুতি