সদ্যই প্রয়াত হলেন বিখ্যাত আলোকচিত্রী শিল্পী সেবাস্তিও সালগাদো। গত ২৩ মে ২০২৫–এ প্যারিসে পরলোকগমন করেন এই শিল্পী, জন্ম ১৯৪৪, ব্রাজিলের এমোরেস–এ। বিশ্বের প্রায় ১২০টি দেশে ভ্রমণ করেছিলেন আলোকচিত্রের বিভিন্ন প্রকল্পভিত্তিক কাজে। প্রথম জীবনে সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে যোগ দেন ইন্টারন্যাশনাল কফি অর্গানাইজেশনে, অর্থনীতিবিদ হিসেবে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হয়ে বেশ ক’বার অফ্রিকায় ভ্রমণে যান, ভ্রমণকালীন সময়েই আলোকচিত্রের নেশা মাথায় চাপে। ১৯৭৩–এ এসে সোনার টুকরোর মতো দামি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর আলোকচিত্রী বনে যান। একে একে কাজ করতে থাকেন স্বনির্বাচিত কিছূ আলোকচিত্র প্রকল্পে যা একাধারে পরিবেশবাদী আন্দোলন ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ তাকে স্বীয় দেশ ব্রাজিল হতে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করে। কপর্দকশূন্য হয়েও থামেননি সালগাদো। স্ত্রী লায়লাকে নিয়ে যুক্ত হন বহুমুখি কাজে। তার সিরিজ কাজগুলোর প্রতিটি পরে বই আকারে বিশ্বের স্বনামধন্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। সিরিজগুলো হচ্ছে ওয়ার্কার্স, জেনেনসিস, সাহেল: দ্য এন্ড অব দ্য রোড, আফ্রিকা, দ্য চিলড্রেন: রিফিউজিস এন্ড মাইগ্রেন্টস এবং মাইগ্রেশন। অন্যান্য রচনার মধ্যে দ্য আদার আমেরিকাস্, এন আনসার্টেন গ্রেস, ফ্রম মাই ল্যাণ্ড টু দ্য প্লানেট ইত্যাদি। আলোকচিত্রে অসাধারণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বহু পুরস্কার, এর মধ্যে ‘হ্যাসলবল্ড এওয়ার্ড’, ‘রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটি এওয়ার্ড’, ‘অস্কার বার্নাক এওয়ার্ড’ প্রণিধানযোগ। ১৯৯০ সাল থেকে যুক্ত ছিলেন ব্রাজিলের আটলান্টিক ফরেস্টের কিয়দংশকে নতুন বনায়নের কাজে। ‘ইন্সটিটিউটো তেরো’ নামের ওই ক্ষুদ্র বনাঞ্চলটি এখন সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষিত এবং প্রাণী বৈচিত্র্যে ভরপুর হয়ে উঠেছে।
সালগাদোর সিরিজ কাজগুলো নিয়ে তিনি একটি গবেষণা করছিলেন সেভেরিন মাতুসেক। তিনি একজন ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রী । লেখার বাকী অংশটুকু সেভেরিনের ব্যক্তিগত ব্লগ থেকে নেওয়া।
লণ্ডনে সালগাদোর এক প্রদর্শনীর উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্বে এক তরুণ তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই সময়ে যারা ভাবছেন, ক্যারিয়ার হিসেবে ফটোগ্রাফিটাকে বেছে নেওয়া যায় তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?’ উত্তরে সেবাস্তিও বললেন-‘তুমি যদি বয়েসে তরুণ হও আর হাতে যথেষ্ট সময় থাকে তাহলে পড়তে শুরু কর। নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে পড়তে পার। পড়ো কেননা তাতে করে তুমি সত্যিকারভাবেই বুঝতে পারবে যে কিসের ছবি তুলছ, কি তুলছ। কোন বিষয়ের ছবি তুমি তুলছ আর কোন বিষয়টি তোমার অবশ্যই তোলা উচিৎ…এইসব তোমার জানা থাকতেই হবে।’
উত্তরটা বেশ চিত্তাকর্ষক। ওই প্রশ্নের উত্তর প্রায় সব আলোকচিত্রীদেরই দিতে হয়, আমি নিজেই তা বহুজনকে জিজ্ঞেস করেছি। সবচে কমন যে উত্তরটা আমি পেয়েছি তা ছিল, ‘ছবি তোলার জন্য বেরিয়ে পড়ো, ছবি তুলতে থাক’ অথবা ‘আলোকচিত্রের পথিকৃৎদের রচনা পড়ে নাও’। কিন্তু এদের কেউই বলেননি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাও, সেখানে গিয়ে নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান,অর্থনীতি ইত্যাদির ওপর উচ্চতর পড়াশোনা করো। ব্যতিক্রম কেবল সালগাদো! সালগাদো এটা বলে আদতে কি বোঝাতে চাইলেন?
সালগাদোর নিজের জীবনই এই প্রশ্নের ওপর আলো ছড়াতে পারে। এক কৃষক পরিবারে সাত বোনের (আশ্চর্জজনকভাবে সবার নামই ‘মারিয়া’! সে গল্প আরেকদিন) এক ভাই, আট সন্তানের সংসারে সালগাদোর বেড়ে ওঠা। সামরিক জান্তার কোপানলে পুড়ছে ব্রাজিল, নিজে অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন, দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন প্যারিসে, কাজ করেছেন ইন্টারন্যাশনাল কফি অর্গানাইজেশনে, সেইসূত্রে আফ্রিকা ভ্রমণ।
একুশ বছর বয়সে এসে হাতে ক্যামেরা পান, তারপর থেকেই ছবি তোলার শুরু। কফি কোম্পানির চাকরি ছেড়ে বিশ্বভ্রমণে বেরোন আলোকচিত্রের জন্য। মাসের পর মাস, হাজার হাজর মাইল ঘুরে, স্ত্রী–সন্তানের কাছ থেকে দূরে…নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন আলোকচিত্রের প্রতি। ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার বা ফটো সাংবাদিক, নামের সাথে লাগানো ইত্যাকার তকমা ছুড়ে ফেলেছেন সালগাদো। নিজেই বলেছেন, আমার গোটা জীবনই আলোকচিত্র।
সালগাদোর শুরুর দিক্কার ছবিগুলো কিসে অনন্য হয়ে উঠল? তাতে মিশে ছিল সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য অন্তর্গত আর্তনাদ, যেখানে কোনও প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছুরই স্থান নেই। মানে তিনি যা–যেভাবে বিশ্বাস করতেন সেটাই আলোকচিত্রে ধরা পড়ত। তাঁর ছবিগুলোর ভাষা বেশ শক্তিশালী কারণ তিনি কি করতে চাইছেন সেটা ঠিকঠাক জানতেন। ধরা যাক একজন আমআদমি একটা ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে, এখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ওই ঘটনাটা ওই লোকটির কাছে সালগাদোর মতোন করে ধরা পড়বে না। হতে পারে তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী, একজন ভ্রমণপিয়াসী কিন্তু তিনি ঘটনাটার অন্দর–বাহির বলতে পারবেন না, সালগাদোর মতো।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, তাঁর ‘জেনেসিস’ সিরিজটির কথা। এই সিরিজের কাজ সম্পর্কে খানিকটা বোঝাপড়া জরুরি। আপনি হয়তো প্রর্দশনীতে এলেন, দেখে ভাবলেন ‘আহা! প্রকৃতির কি অপার লীলা…কতই সুন্দর!’ অথবা এ–ও ভাবতে পারেন, সালগাদো হয়তো জীবনভর পৃথিবীর যাবতীয় অনাচার দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে বুড়ো বয়সে এসে প্রকৃতির ভেতর শান্তি খুঁজতে চাইছেন! কিন্তু সেবাস্তিও’র ভাবনা খানিকটা অন্যরকম, বিপরীত বলতে পারেন। তিনি বোঝেন, আমাদের জন্য এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং তা সার্বজনীন। আর ‘জেনেসিস’ তাঁরই প্রতিচ্ছায়া। যদি এভাবে ভাবতে পারেন, তাহলেই বুঝবেন এটিও সালগাদো সবচেয়ে প্রভাববিস্তারি, অর্থপূর্ণ আর শক্তিশালী কাজ।
একজন উদীয়মান–উচ্চাকাঙ্ক্ষি আলোকচিত্রীর জন্য এর থেকে শিক্ষনীয় তাহলে কি? বুঝতে চেষ্টা করুন আপনি কিসের ছবি তুলতে চান। বুঝতে চেষ্টা করুন আপনার তোলা আলোকচিত্রের প্রভাব কি বা কতটুকু (যদি থাকে)। পৃথিবী কোন নিয়ামকের দ্বারা পরিচালিত হয় তা ধরতে চেষ্টা করুন। কেবলমাত্র একজন ক্যামেরাঅলা হওয়ার কিছু নেই, কারণ আমরা সকলে কমবেশি তা–ই। সালগাদো কথাচ্ছলে বলেছিলেন, একদিন তিনি পেরুর এক পর্বতচূড়ায় উঠে ডাক ছেড়ে কান্না করেছিলেন। কেন? কারণ তিনি দীর্ঘদিন স্ত্রী লায়লা আর সন্তানকে ছেড়ে এমন পাথুরে পর্বতে পড়ে আছেন কেবল ছবির জন্য! পড়েই বা রইলেন কেন! পকেটে টাকা নেই, যাতায়াত করেন হেঁটে নয়তো লক্করঝক্কর লোকাল বাসে…আর কাজটা শেষ না হলে মিলবে না খোরাকিও। সুতরাং যতই হৃদয়ে বেদনা জাগুক হাতের কাজ শেষ করা চাই।
এমন আত্মউৎসর্গই পারে একজন সেবাস্তিও সালগাদোকে তৈরি করতে। এখন যখন আমরা ফটাফট ছবি তুলে বেড়াই এদিক–সেদিক তখন এমতন আত্মত্যাগের কথা রূপকথার মতো শোনায়। তবে এ–ও সত্য, এখনও এমন কাউকে কাউকে পাওয়া যায় যারা চান ঘটনার ভেতরকার আপ্তগল্পটার ছবি তুলে আনতে। তাদের লাল সেলাম।