অসংখ্য কালজয়ী গানের সুরের জাদুকর সঙ্গীতজ্ঞ আলী হোসেন। বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র আলী হোসেন। কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা শুধু কাজ করতেই ভালোবাসেন। সেই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ কী পেলেন, কী পেলেন না, তা নিয়ে কখনোই ভাবেন না। আলী হোসেন ঠিক তেমনই একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি দেশের চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে কিন্তু কখনোই নিজের প্রচারণা নিয়ে ভাবেননি। প্রচণ্ড রকমের অন্তর্মুখী–প্রচারবিমুখ একজন মানুষ ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ আলী হোসেন। বহু জনপ্রিয় কালজয়ী গানের সুরস্রষ্টা হয়েও ছিলেন নিরহঙ্কারী, সহজ–সরল, উদার মনের মানুষ।
পাঁচ দশকের কর্মজীবনে তিনি অসংখ্য জনপ্রিয় গানের সুর ও সঙ্গীতায়োজন করেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের অসংখ্য কালজয়ী গান তাঁর হাত দিয়ে সৃষ্টি। মাত্র ২০ বছর বয়সে উর্দু ছবি ‘প্রেসিডেন্ট‘এ তিনি প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬৬ সালে মোস্তাফিজ পরিচালিত ‘ডাক বাবু’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে তাঁর। এই চলচ্চিত্রেই তিনি জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহকে দিয়ে ‘হলুদ বাটো মেন্দি বাটো…’ গানটি গাওয়ান। ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখা ‘হলুদ বাটো মেন্দি বাটো…’ গানটি যেন গ্রামীণ বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রাণ। আমাদের দেশে গ্রামগঞ্জে বিয়েবাড়িতে এই গানটি আজও শোনা যায়, আগামীতেও শোনা যাবে। হাজার বছরেও এই গানের আবেদন মুছে যাবার নয়। এই গান ছাড়া যেন বাঙালিদের বিয়ের আয়োজনই জমে ওঠে না। এই গানটির জন্য কিংবদন্তি সুরকার আলী হোসেন হাজার বছর বেঁচে থাকবেন বাঙালিদের হৃদয়ে। একই চলচ্চিত্রে আরেক জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীকে দিয়ে ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখা ‘চাতুরী জানে না, মোর বধূয়া…’ গানটি গাওয়ানো হয়। ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান চলচ্চিত্রের জন্য প্রথম গান লিখেন ‘ডাক বাবু’ ছবিতে। শাহনাজ রহমতুল্লাহ ও সৈয়দ আব্দুল হাদী আলী হোসেন‘র হাত ধরেই চলচ্চিত্রের গানে অভিষেক ঘটে। ‘ডাক বাবু’ চলচ্চিত্রের নায়ক নায়িকার অভিনয় করেছিলেন তখনকার জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী সুজাতা ও আজিম। চলচ্চিত্রটি সেই সময় আলী হোসেনের সুর করা ও সঙ্গীত পরিচালনায় গানগুলো খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই থেকে একজন সুরকার ও সঙ্গীতপরিচালক হিসেবে তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
আলী হোসেন ১৯৪০ সালে ২৩শে মার্চ কোলকাতায় এক সঙ্গীত পিপাসু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুষ্টিয়ায়। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী। তাঁরা ছিলেন ছয় ভাই দুই বোন। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। সেই সুবাদে পাকিস্তান চলে যান, তখন তাঁর বয়স চার/পাঁচ বছর এবং পাকিস্তানের করাচিতে পড়াশোনা করেন। তাঁর বাবা ভীষণ সঙ্গীত অনুরাগী। বাড়িতে নিয়মিত জলসা বসতো। সঙ্গীত পিপাসু বাবার উৎসাহেই গানের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর আরো দু‘ভাই সঙ্গীতের সাথে জড়িত। পাকিস্তানে একসময় নজরুল একাডেমিতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে তাঁর চাকরি হয়। তবে নজরুল একাডেমিতে চাকরির সুবাদে একই প্রতিষ্ঠানের উচ্চাঙ্গ সংগীতের জনপ্রিয় শিক্ষক পিয়ারে খানের কাছে তিনি গান শিখেছেন। এভাবেই ধীরে ধীরে গানের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৩ সালে আলী হোসেন দেশে চলে আসেন। দেশে আসার পর গান নিয়েই সময় কেটে যায় তাঁর। তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছে দেশের অনেক গুনী শিল্পীর সঙ্গীত জীবন।
প্রায় দুইশত বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন আলী হোসেন। একের পর এক জনপ্রিয় সব গান উপহার দিয়েছেন শ্রোতাদের। ‘অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান…’, শিল্পী– সাবিনা ইয়াসমিন, ১৯৭২ সাল, রাজ্জাক ও সুজাতা অভিনীত ছায়াছবি ‘অশ্রু দিয়ে লেখা‘। ‘আরে ও প্রাণের রাজা তুমি যে আমার…’, শিল্পী– প্রবাল চৌধুরী ও উমা খান, গীতিকবি– ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আকবর কবির পিন্টু পরিচালিত শাবানা ও খসরু অভিনীত ‘বাদশা‘ চলচ্চিত্রের গান, প্রবাল চৌধুরী ও উমা খান দুজনেরই চলচ্চিত্রে গাওয়া এটাই ছিল প্রথম গান। ‘এ আকাশকে সাক্ষী রেখে…’, শিল্পী– খুরশিদ আলম, গীতিকবি– ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, রাজ্জাক ও ববিতা অভিনীত ‘সোহাগ‘ ছবির গান। ‘ও দুটি নয়নে স্বপনে চয়নে…’, রাজ্জাক ও সুজাতা অভিনীত ‘অশ্রু দিয়ে লেখা‘ ছবির গান, শিল্পী– খুরশিদ আলম, গীতিকবি– ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। ‘কে তুমি এলে গো আমার এ জীবনে…’, শিল্পী– আহমেদ রুশদী, কথা– আহমেদ জামান চৌধুরী, সুচন্দা ও সরকার কবীর উদ্দিন অভিনীত ছায়াছবি– ‘নতুন নামে ডাকো‘। ‘কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো…’, শিল্পী– সুবীর নন্দী, কথা– নজরুল ইসলাম বাবু, জাফর ইকবাল ও দিতি অভিনীত ছায়াছবি ‘উসিলা‘। এই গানটি ছিল সুবীর নন্দীর গাওয়া প্রথম চলচ্চিত্রের গান, সুবীর নন্দী তখন রেডিওতে গান গাইতেন। ‘হায়রে কি সৃষ্টি দেখে এ দৃষ্টি…’, শিল্পী– খুরশিদ আলম, গীতিকার– ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ছায়াছবি– ঘর সংসার। ‘আমার স্বপ্নে দেখা সেই তোমাকে….’, শিল্পী– সাবিনা ইয়াসমিন, গীতিকবি– মাসুদ করিম, শাবানা ও আলমগীর অভিনীত ছায়াছবি–ব্যথার দান। ‘নতুন নামে ডাকো আমায় এই তো ছিল বাসনা…’, শিল্পী– নাহিদ নিয়াজী, গীতিকবি– আহমেদ জামান চৌধুরী, সুচন্দা ও সরকার কবির উদ্দিন অভিনীত ছবি ‘নতুন নামে ডাকো‘। ‘চোখ ফেরানো যায় গো, তবু মন ফেরানো যায় না…’, শিল্পী– বশির আহমেদ, গীতিকবি– ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আজিম ও সুজাতা অভিনীত ছবি– অবাঞ্ছিত। ‘কেহই করে বেচাকেনা কেহই কান্দে রাস্তায় পড়ে‘, শিল্পী– আবদুল আলীম, গীতিকবি– সাধক জালাল উদ্দিন খাঁ, ছায়াছবি– অবাঞ্ছিত। উপমহাদেশের অনেক খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী তাঁর সুরে গেয়েছেন। ‘ঢাকো যত না নয়নও দুহাতে বাদলও মেঘ ঘুমাতে দেবে না…’, গানটি উপমহাদেশের গজলসম্রাট মেহেদী হাসান গেয়েছিলেন বাংলাদেশের ছায়াছবি ‘রাজা সাহেব‘ এর জন্য ১৯৮২ সালে। গানটির গীতিকবি ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। এমনই অসংখ্য কালজয়ী স্মৃতি জাগানিয়া গানের সুরস্রষ্টা আলী হোসেন।
চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে যে সব ছবিতে কাজ করেছেন, তার মধ্যে– ‘ডাক বাবু‘, ‘অবাঞ্ছিত‘, ‘নতুন ফুলের গন্ধ‘, ‘দাগ‘, ‘ছোটে সাহাব‘, ‘আনাড়ি‘, ‘কুলি‘, ‘নতুন নামে ডাকো‘, ‘অধিকার‘, ‘একই অঙ্গে এতো রূপ‘, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা‘, ‘জীবন নিয়ে জুয়া‘, ‘বাদশা‘, ‘খান্দান‘, ‘সোহাগ‘, ‘বিজয়িনী সোনাভান‘, ‘জানোয়ার‘, ‘রাজা সাহেব‘, ‘আমির ফকির‘, ‘আলতাবানু‘, ‘সানাই‘, ‘কালো গোলাপ‘, ‘ঈমান‘, ‘ঘর সংসার‘, ‘বউরাণী‘, ‘ব্যথার দান‘, ‘ধন–দৌলত‘, ‘উসিলা‘, অন্যতম। তিনি ঢাকায় বাংলা চলচ্চিত্রের কাজ করার পাশাপাশি উর্দু ‘ছোট সাহেব’, ‘দাগ’, ‘আনাড়ি’, ‘কুলি’ সহ আরো অনেক ছবি।
তিনি শুধু আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনাই করেননি, পরম নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছেন বেতার ও টেলিভিশনেও। ‘কেনো কথা দিয়ে তুমি তবু কথা রাখো না…’, শিল্পী– ফেরদৌসী রহমান, গীতিকবি– ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। এমনসব গানের যাদুকরী সুরকার আলী হোসেন বাংলা সঙ্গীতের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে গেছেন অবিস্মরণীয় কালজয়ী গানের মাধ্যমে।
তিনি মিউজিক কম্পোজার্স সোসাইটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। ১৯৮৯ সালে কামাল আহমেদ পরিচালিত ‘ব্যথার দান’ চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনার জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন আলী হোসেন।
ব্যক্তিজীবনে আলী হোসেন, সালেহা খাতুন–এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের একমাত্র ছেলে আসিফ হোসেন। তাঁর স্ত্রী ও ছেলে আমেরিকায় থাকেন। তিনিও আমেরিকায় থাকতেন, তবে দেশে যাওয়া আসার মধ্যে থাকতেন। আলী হোসেন দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছিলেন। ১৭ই ফেব্রুয়ারি ২০২১ সাল বাংলাদেশ সময় বুধবার ভোরবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই গুনী সঙ্গীতজ্ঞ। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তাঁর ছেলে আসিফ যেহেতু পরিবার নিয়ে বোস্টনে থাকেন, তাই তাঁর বাবাকে সেখানেই দাফন করা হয়।
শ্রদ্ধেয় আলী হোসেন তাঁর এক টিভি সাক্ষাৎকারে খুব দুঃখ করে বলেছিলেন ‘কেন আমি এই দেশে জন্মালাম। এত কাজ করার পরে যদি বলে আলী হোসেন নাম চেনে না, জানেনা কি করেছে এর চেয়ে বড় দুঃখ আর লজ্জার কিছু থাকে না‘। এটা আসলে আমাদেরই লজ্জা আমরা পারিনি ঐ যোগ্য সম্মানটুকু দিতে, আমরা গুণীজনের কদর করতে জানি না। এই জন্যই বোধ হয় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন– ‘যে দেশে গুণীর কদর নেই সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।’
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগীত বিষয়ক গবেষক।