পরপর কয়েকটি মাতৃমৃত্যু আমাদের সকলকে ভাবিয়েছে। এই যুগে এসে এমনটা হওয়ার কথা নয়। অথচ এমনভাবেই হচ্ছে। এই দেখে রীতিমতো প্রসূতি ও তার আত্মীয়স্বজন ভীতিকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন। পেইন নিয়েই ডেলিভারিতে যাচ্ছেন মা। অনেকের লেবার পেইন কম থাকে বিধায় সময় নিয়ে অপেক্ষা করেন, স্যালাইন পুশ করে। অনেকের আবার অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে। অপারেশনে সন্তান জন্মের পর ২৪ ঘন্টার মধ্যে মায়ের শরীর খারাপ করছে। এমনকি মৃত্যুও হচ্ছে। অথচ এই যুগে কোনো প্রসূতি বা তার আত্মীয়স্বজন কোনোরকম অবহেলা করছেন না রোগীর। কারণ যুগ পাল্টেছে। প্রতি মাসে গাইনির চিকিৎসা নিচ্ছে। শেষের দিকে এসে মাসে দু’বারও চেকআপে যাচ্ছে। তবুও কেন এতো মৃত্যু!
এই দু’মাসের মধ্য চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে পরপর কয়েকটা মাতৃমৃত্যু দেখতে হয়েছে। এছাড়া সিলেট, কুমিল্লা ঢাকায়ও এমনটা হচ্ছে। এবার নড়ে–চড়ে বসলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মাতৃমৃত্যু ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। স্ত্রীরোগ ও মাতৃস্বাস্থ্য বিশেজ্ঞদের সংগঠনও পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে। এমনকি স্বাস্থ্যমন্ত্রীও অবগত আছেন, তদন্ত চলছে জানালেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চট্টগ্রামের হাসপাতালের মাতৃমৃত্যু ঘটনা তদন্তে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে এবং সাতদিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলেছে। স্ত্রীরোগ ও মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞজনের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনেকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও ঘটনা পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন। জানা গেছে অপারেশনের কয়েক ঘন্টার পর প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এবং রক্তচাপ কমে যাচ্ছে। কিডনি অকেজো হয়ে পড়ছে। রোগীর শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে এবং হার্টফেল করছে।
প্রতি মাসে ডাক্তারের চেকআপে থাকার পরও যদি এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় রোগীকে তাহলে আমাদের দেশে সাধারণ যারা, যারা গ্রামে থাকেন, যাতায়াতের ব্যবস্থা খারাপ তারা তো প্রতি মাসে চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে আসতে পারছে না। গরীব, অসহায় মায়েদের তো আরো করুণ পরিণতি। যারা রুটিন চেকআপে আছেন, তাহলে কেন এমনটা হচ্ছে এটা তো ভাববার বিষয়। এখানে যে ওষুধগুলো প্রয়োগ করা হচ্ছে এতে সন্দেহ করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
সারাবছর নকল ওষুধ ধরাধরি করছে। বাজার নকল ওষুধে সয়লাব। এসব ওষুধের কারখানা একদিনে গড়ে ওঠেনি। ধীরে ধীরে এদের শাখা বেড়েছে। কিছু টাকা জরিমানা নিয়েই এদের ছেড়ে দিচ্ছে। অথচ এদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্রয়োজন। ওষুধ কারখানা সিলগালা করে দেয়া দরকার।
এই নকল ওষুধের কারণে আমার ব্লাড প্রেসার হাই ছিলো। এতো ওষুধের পরেও কেন কমছে না তা জানার জন্য ওষুধের গায়ে লেখা চেক করতে গিয়ে দেখতে পাই প্রতিটা ওষুধে ‘ফাঙ্গাস’।
দু’দিন হলো আমার পরিচিতার লেবারপেইন শুরু হওয়ার পর রোগীর মা ডাক্তারের পরামর্শে মেমন হসপিটালে ভর্তি করালেন। একবেলা রাখার পর রোগীকে মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। কারণ কি জানতে চাইলে বললেন, রোগীর জ্বর। এখানে পারবে না। ওনারা যথারীতি মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। ওখানেও ঘন্টা দু’তিনেক রাখার পর ডিসচার্জ করে দিয়ে বললেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে। রোগীর মা দিক্বিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে আমাকে ফোন দিয়ে বললেন কী করবে বুঝতে পারছে না। তারা পরিষ্কার করেও কিছু বলছেন না। পরে মেডিকেলে নিয়ে ভর্তি করালেন। চট্টগ্রাম মেডিকেলে যারা গিয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতা থাকার কথা ওখানের পরিস্থিতি নিয়ে। আয়া, দারোয়ান, নার্স সকলেই এমন ভীতিকর পরিস্থিতি করে রাখেন, যেন মনে হয় কোন অপরাধী ওখানে গিয়েছেন। বাচ্চা নেয়াটা মহাঅপরাধ। তাদের ব্যবহার এতো এতো খারাপ বলে বোঝানো যাবে না। এসব ভাষা এখানে লেখাও যাবে না।
এতে রুগীনির পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে। রোগী ও তার স্বজনরা আয়া, নার্সের কাছে জিম্মি হয়ে থাকেন। এদের সাথে কথাও বলা যায় না। রাত যত গভীরে যাচ্ছে রোগীর অবস্থা ততই খারাপ হচ্ছে। রোগীর হাত, পা শীতল হয়ে প্রলাপ বকছেন। তার মা কান্নাকাটি করে, হাতে পায়ে ধরে নার্সের মন কিছুটা নরম করতে পেরেছেন। তারপর জানানো হলো রক্ত লাগবে। অপারেশন লাগবে। এবার বুঝুন এতো রাতে মহিলার অবস্থা! ততক্ষণে মেয়ে আধমরা। মায়ের বুকফাটা আর্তনাদে লেবার রুমে নিয়ে যাওয়ার পর নরমাল ডেলিভারি হলো। বাচ্চাটার সুস্থভাবে জন্ম হলো।
একজন হার্টের রোগী, আর ডেলিভারি রোগী দু’জনেই আদর, ভালো ব্যবহারে শান্তি পায়। অথচ এরাই অবহেলার শিকার। সরকারি হসপিটালগুলোতে কেন ভালো ব্যবহার করা হয় না, জানি না।
এবার আসি ওষুধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে। সাধারণত সন্তান জন্মে অস্ত্রোপচারে তিন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। চেতনানাশক, ব্যথানাশক, স্যালাইন। বিশেজ্ঞরা ধারণা করছেন এই তিনটির কোনো একটির জটিলতার জন্য সামপ্রতিক মাতৃমৃত্যুহার বাড়তে পারে।
একটা অস্ত্রোপচারে কার কতটুকু ভূমিকা পালন করা হয় তা দেখারও প্রয়োজন। এখন তো ভুয়া ডাক্তার, এনেস্থেশিয়াসিস্ট ভুঁড়ি ভুঁড়ি। পোস্ট– অপারেটিভ ওয়ার্ডে সেবার মান কেমন তাও দেখার বিষয়। কারণ সেখানে চিকিৎসক থাকেন না।
একজন বা দু’জন নার্সের অধীনে অনেক রোগী থাকেন। তারা কেমন সেবা দিচ্ছেন তা জানা দরকার। অন্য যে কোনো রাষ্ট্রে প্রসূতির সাথে লেবার রুমে তার স্বামীকে রাখে। এতে প্রসূতির মনের জোরটা বাড়ে। আর যারা লেবার রুমের কাজে থাকে তারাও সতর্ক থাকবে। আমাদের দেশেও এমনটা হওয়া জরুরি।
এখন প্রশ্ন চট্টগ্রামে এসব রোগীদের ক্ষেত্রে কোন ধরনের, কোন মানের ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে? তা হয়তো তদন্তে বেরিয়ে আসবে অথবা ধামাচাপা পড়ে যাবে। কিন্তু যে সন্তান জন্ম নিয়েই মায়ের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো তার জবাব কী হবে? সেই পরিবারকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সন্তান জন্ম দিতে এসে হাসপাতালে কোনো মায়ের মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না কোনোভাবেই। এর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য বিভাগকে বিশেষ করে নার্স, আয়া তাদের ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন। মান যাচাই–বাছাই করে, যত্রতত্র হাসপাতাল বন্ধ করা প্রয়োজন। তবেই আমরা মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে পারবো।