সাধকের বংশে সাধক : সব্যসাচী সুফি সাধক ও সুফিতত্ত্ব বিশ্লেষক দরবেশ মাওলার স্মরণে

ড. সেলিম জাহাঙ্গীর | সোমবার , ১৩ অক্টোবর, ২০২৫ at ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ

[যুগপৎ সংসারীগৃহী ও বনবাসী, সুফি সাধক ও পীর, মৌলিক গবেষক ও তাসাউফকেন্দ্রিক তাত্ত্বিক বিশ্লেষক আলী রজা কানুশাহের শ্রেষ্ঠতম প্রতিনিধির জীবন কর্ম ও মর্মের উৎস সন্ধানে।]

সাধারণভাবে আড়াইশত বছরের ইতিহাসে বাংলা সাহিত্যের মধ্য ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণের কবি আলী রজা কানুশাহ (১৭৬০১৮৩৮) যে আকর্ষণীয় মাত্রিক স্বতন্ত্র সত্তার অনবদ্য যুগের জন্ম দিয়েছিলেন তা প্রায় বিস্মৃত পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। প্রাতঃস্মরণীয় আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের অনুসন্ধানী গবেষণায় তা উঠে এসেছে তাৎপর্যপূর্ণভাবে। ফলে কানুশাহের যে বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায় তা বাংলা সাহিত্যের সুফি ঘরানায় ইতিহাসের চর্চায় আকর্ষণীয় গবেষণার বিষয়ে পরিগণিত হয়ে উঠছে ক্রমসম্প্রসারমান ধারায়। প্রাচীন যুগের মধুরামী ও দেবনাগরী লিপিতে তাঁর “জ্ঞান সাগর” সহ সমগ্র সৃষ্টি ছিল মূলত সুফিতত্ত্বের তাসাউক জগতের কথকতায় ভরপুররীতিমতো টইটম্বুর। ফলে সাধারণ্যে এগুলো বিস্ময় সৃষ্টি করলেও এর মর্মার্থ উদ্ধারের বিষয়টি ততবেশী পর্যালোচিত হয়ে ওঠেনি।

আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ এবং বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটো পর্যবেক্ষণে এ বিশেষত্ব উঠে এসেছে “বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের” মতো

) আলী রজার জ্ঞান সাগর একটি দরবেশী গ্রন্থ। গুরুর উপদেশ ছাড়া এ রূপ গ্রন্থের মর্ম উপলব্ধি কঠিন। এ রূপ গ্রন্থে স্বভাবতই দুর্বোধ্য হয়ে থাকে। কবির ভাষায়ও অনেক স্থলে অস্পষ্টতা ও জটিলতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। তা ভাষা যেমনই হউক বঙ্গ সাহিত্যে এ শ্রেণীর গ্রন্থ আর নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয়না।

[আলী রজা ওরফে কানু ফকির, ১৩৪২ ব, জ্ঞান সাগর, মুন্সী শ্রীযুক্ত আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ (সম্পা) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, পৃ]

) অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনায়: আলী রজা শুধু পদকর্তা হিসেবে নয়, তাত্ত্বিক সাধক রূপেও এক যুগে বিশেষভাবে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি দরবেশ শাখা ভুক্ত হলেও হিন্দুর তন্ত্র ও যোগ শাস্ত্রে বিশেষ অভিজ্ঞ ছিলেন। এ জন্য হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই তাঁর শিষ্য হয়েছিল। …. এই সমস্ত দৃষ্টান্ত থেকে আলী রজাকে এক অসাধারণ ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছে। এ রকম অসাম্প্রদায়িক, উদার ও অধ্যাত্মমার্গের কবি ও সাধক মধ্যযুগের মুসলমান এবং হিন্দু সমাজে খুব সুলভ নয়।

[অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০০৬, বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, মডার্ন বুক এজেন্সী প্রাঃ লিঃ কলিকাতা, পৃ১৮২]

উচ্চতর গবেষণার আলোকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে উল্লিখিত দুই বিজ্ঞ পন্ডিতের পর্যবেক্ষনের সারাংশ হলোঃ () এটি একটি দরবেশী গ্রন্থ, () ভাষায়ও অনেক স্থলে অস্পষ্টতা ও জটিলতা পরিলক্ষিত হয়, () তিনি দরবেশ শাখাভুক্ত হলেও হিন্দুর তন্ত্র ও যোগশাস্ত্রে বিশেষ অভিজ্ঞ ছিলেন। এজন্য হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই তাঁর শিষ্য হয়েছিল। এরকম অসাম্প্রদায়িক উদার ও অধ্যাত্ম মার্গের কবি ও সাধক মধ্যযুগের মুসলমান ও হিন্দু সমাজেও খুব সুলভ নয়।

আমার পর্যবেক্ষণে কানু ফকিরের সৃষ্টি কর্মের মর্ম উদ্ধারের চেষ্টায় সাহিত্য বিশারদ ও অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় এর যে আন্তরিক প্রচেষ্টা তাতে বিষয়টির গভীরতর তাৎপর্যের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে চলেছে। কিন্তু () দরবেশী ভাষা, () ভাষার অস্পষ্টতা ও জটিলতা, () হিন্দুর তন্ত্র ও যোগশাস্ত্র বিষয়ক মন্তব্যগুলো স্থান, কাল, পাত্রের আলোকে গভীর থেকে গভীরতর পর্যায়ে অনুসন্ধান করতে পারলেই কানু ফকিরকে পরিপূর্ণ মাত্রায় আবিষ্কার করা সম্ভব হয়ে উঠবে।

মুসলিম শিক্ষা দীক্ষায় বেড়ে উঠা আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের “দরবেশী ভাষা” শব্দের ব্যবহার মূলত ইসলামধর্মের আধ্যাত্মিক জগতের উচ্চতর জ্ঞান রাজ্যের তাসাউক পরিমন্ডলের প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। বলাবাহুল্য এ জগত সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার সাথেই এর মর্মার্থ উদ্ধার গভীরভাবে সম্পর্কিত।

হিন্দুধর্মীয় শিক্ষাদীক্ষায় বেডে উঠা অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেধা মননে হিন্দু ধর্মের তন্ত্র ও যোগশাস্ত্র প্রভাব বিস্তার করে আছে স্বাভাবিকভাবেই। তাই তিনি কানু ফকির এর এ ধারায় অনুসারী, অনুগামী হিসেবে বিবেচনা করেছেন অবলীলাক্রমে। যা পুনঃমূল্যায়ন অত্যাবশ্যক।

আমাদের সৌভাগ্য, “দরবেশী ভাষা” এবং “হিন্দু তন্ত্র ও যোগশাস্ত্র” এ দুই বিষয়ে কানু ফকিরের ৫ম উত্তর পুরুষ, এ সাধক বংশের সমকালের শ্রেষ্ঠতম প্রতিনিধি দরবেশ মাওলার লিখিত দলিলে এটি সুষ্পষ্টভাবে জানার ক্ষেত্রে গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে।

সময়কাল ১৯৯৫। ঢাকা বাংলা একাডেমী থেকে দরবেশ মাওলাকে প্রেরিত চিঠি এবং এতদউত্তরে দরবেশ মাওলার যে পরামর্শমূলক উত্তর তাতে দরবেশী ভাষা, দেহতত্ত্ব (মুসলিম সুফিদের দেহতত্ত্ব বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞানের জন্য শাহ সুফি আলী রজা কানু ফকিরের প্রতিষ্ঠিত, খাজা দরবেশ মাওলা (রহ.) এর পূর্ণপ্রাণ সঞ্চারিত ত্রিমাসিক ৩ দিন ব্যাপি বিষু মোবারকে উপস্থিতি ও বিষু সম্পর্কে পুর্ণাঙ্গ জ্ঞান থাকা অপরিহার্য্য।) ইত্যাদি বিষয়ে কানু ফকিরের দরবারের সার কথাগুলো উঠে এসেছে তাৎপর্যপূর্ণভাবে। যেমন :

() কানু ফকিরের সাহিত্য কর্মের উপর গবেষণা করার পূর্বে নিজেকে সুফি দরবেশগনের সোহবতে রেখে মুহাম্মদী যুগ সাধন পদ্ধতি ও শব্দ চয়ন সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। () সুফি দরবেশগনের ভাবমূর্তি ও সাধন পদ্ধতি সম্পর্কে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নিজেকে ঋদ্ধ করার বিকল্পহীন অনিবার্য প্রয়োজনে সুফি দর্শনের ঐতিহাসিক ধারার গ্রন্থগুলো সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান আবশ্যক। নচেৎ সুফি সাহিত্য বিষয়ক গবেষণা ও মূল্যায়ন পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে। () সুফি সাধকদের গ্রন্থ সমূহে রূপক শব্দ চয়ন ও ভাব ভাষাকে বুঝার জন্য স্থান, কাল, পাত্রের আলোকেই বিবেচনা করতে হবে। () আমি গ্রন্থ সমূহ মধুরামী বাংলা অক্ষর হতে জাতির স্বার্থে বাংলা অক্ষরে রূপান্তর করেছি।

বলাবাহুল্য, দরবেশ মাওলার প্রতি বাংলা একাডেমীর চিঠি, পরিপূর্ণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রিকতায় প্রত্যুত্তরে তাঁর দার্শনিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণগুলো আত্মস্থ করতে পারলেই কানু ফকিরের সাহিত্য পাঠ সার্থক হবেপরিপূর্ণতা অর্জন করবে।

এক্ষেত্রে দরবেশ মাওলার জীবনী গ্রন্থকে কেন্দ্র করে তদীয় পুত্র ও মনোনীত সাজ্জাদানশীন মাওলানা মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন নুরী আল কুরাইশী সম্পাদিত “নক্ষত্ররাজির অস্তাচল” গ্রন্থটি সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে, একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে কাজ দেবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক: নজরুল গবেষক; ফিনল্যান্ডের ফিনিস একাডেমীতে সুফিতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণায় রত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাওলানা সৈয়দ আবদুল গণি কাঞ্চনপুরীর ‘মাইজভাণ্ডারী গান’
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল