কিছুদিন আগেও যে চেরাগী চত্বর ঘিরে দোকানগুলোতে কাঁচা ফুল বিক্রি হতো, সে দোকানগুলো আজকাল ভরে গেছে কাগজ-কাপড়-প্লাসটিকের সব নকল ফুলে। বিয়ের গাড়ি সাজানো হতো আসল ফুলে, এখন তা সাজানো হয় নকল ফুল দিয়ে, এমন কি ফুলশয্যার খাটও অনেক জায়গায় নকল ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে। খোঁপায় এখন আমরা রজনীগন্ধা, গোলাপ, বেলি, কিংবা জুঁই না লাগিয়ে পরছি নকল ফুল। বিয়ে বাড়ি সাজাতে এমনকি শোক জানাতেও অনেকক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে এই নকল ফুল। আমরা আসল থেকে ধীরে ধীরে অনেক দূরে সরে এসেছি। চারদিকে সব মেকি। স্বামীর সাথে স্ত্রীর সম্পর্ক মেকি, বন্ধুত্বের সম্পর্ক মেকি, পাড়া প্রতিবেশীর সাথে এমন কি মা-বাবার সাথে ছেলে মেয়েদের সম্পর্কও মেকি! সবসম্পর্কে স্বার্থের গন্ধ। খুব বেশী বাস্তববাদী হয়ে উঠেছি আমরা যেখানে ইমোশানের কোন মূল্য নেই। কারো বিপদে সহজে কেউ এগিয়ে আসিনা, নিজেকে বাঁচিয়ে পাশ কাটিয়ে সরে পড়ি। পাশের ফ্ল্যাটে কেউ মারা গেলেও আমরা খবর পাইনা। সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করলে সে খবর পাওয়া যায় বটে আর তাকে কলমের ক’টা দাগ কেটে সমবেদনা জানানোও যায়। পাশে দাঁড়ানোর মত সুহৃদ খুঁজে পাওয়া দায়। ‘মানবিকতা’ শব্দটা নিঁখোজ। স্বার্থপর মনোভাবের কারণেই সমাজে বাড়ছে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি। মানুষ খুন হচ্ছে তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর কারণে। আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে আশংকাজনক হারে। এর একমাত্র কারণ আমাদের মন থেকে মায়া মমতা প্রায় বিদায় নিতে বসেছে। পরিবারের সদস্যদের বন্ডিং আগের মত নেই। বন্ডিং নেই ভাই-বোনে, আত্মীয়তা কিংবা বন্ধুত্বে। প্রগাঢ় বন্ধুত্ব অতি তুচ্ছ কারণে শত্রুতে রুপান্তরিত হচ্ছে। কিন্তু কেন ?
আমরা এমনটা হয়ে যাচ্ছি কেনো? আমাদের ছোটবেলার সাথে তুলনা করলে আমরা আর আমাদের সন্তানেরা তো এখন অনেক ভালো থাকছি, ঘুরছি, খাচ্ছি, পড়ছি, আমাদের জীবন যাত্রার মান বেড়েছে। তবুও কেন আজ সম্পর্কগুলো কমজোর হয়ে পড়েছে? এর কারণ উন্নতির সাথে সাথে বেড়েছে আমাদের মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ততা, অস্থিরতা। স্ত্রীকে সময় দিতে পারছেনা স্বামী, সন্তানদের সময় দিতে পারছেনা মা-বাবা, আবার অন্যদিকে ডিপেন্ডেন্ট মা-বাবাকে সময় দিতে পারছে না সন্তান। শিক্ষকের সময় নেই ছাত্রছাত্রীদের কথা শোনার, ডাক্তারদের সময় নেই ধৈর্য ধরে রোগীর কথা শোনার, কিছুটা সময় চুপ করে বসে ভাববার সময় আমাদের কারোরই নেই। ভাববার সময়টা কেড়ে নিয়েছে প্রযুক্তি। ছোট বাচ্চা জন্মের পর বছর তিন যেতে না যেতেই তাকে নিয়ে মা-বাবার ছোটাছুটি শুরু। ছোট্ট বাচ্চাটা সেই যে ছুটতে শুরু করে এরপর আর থামাথামি নেই!
কী একটা সময় পার করছি। সময়ের ব্যবধানে আমাদের সন্তানের হারিয়েছে খেলার মাঠ, ভুলেছে সংস্কৃতি চর্চা, বোঝে না সৌহার্দ্য, সমপ্রীতি, শ্রদ্ধাবোধ, আত্মতৃপ্তি। নিজের যা আছে আমরা তা নিয়ে তৃপ্ত নই। শুধু চাই চাই আরোও চাই।
পাশ্চাত্যের দেশগুলোর অনুকরণে সন্তান একটু বড় হওয়ার পর মা-বাবা হারাচ্ছে সন্তানকে শাসন করার অধিকার, কিন্তু ওই দেশের মত সুশিক্ষার ব্যবস্থা তো নেই দেশে। সন্তান একটু বড় হওয়ার পর মা-বাবাকে চিন্তাভাবনা করে কথা বলতে হচ্ছে সন্তানের সাথে। অন্যায়গুলোকে সাথে সাথে বকা দিয়ে ভুল শুধরে দেয়া যাচ্ছে না। ভেবে চিন্তে পন্থা বের করতে হয় সন্তানকে বোঝাবার, বলাতো যায় না কোন কথায় সন্তানের মনে আবার আঘাত লেগে যায়! তারপর রাগের মাথায় সন্তান যদি কোন অনর্থ করে বসে! এই চিন্তায় মা-বাবা সবসময় আস্থির। সন্তানকে সন্তুষ্ট রাখতে ব্যস্ত মা-বাবাকে। হারিয়েছে শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধাবোধ। সব রকম সম্পর্ক হারিয়েছে গভীরতা, মমত্ব, শ্রদ্ধাবোধ, সমপ্রীতি।
‘সমপ্রীতি’ সামপ্রতিক সময়ে বহুল উচ্চারিত একটা শব্দ। কিন্তু যাদের কণ্ঠ থেকে শব্দটা উচ্চারিত হচ্ছে সংখ্যায় তারা খুব বেশী নয়। এবছর দুর্গাপূজার সময়ে ঘটে যাওয়া অঘটন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সমাজে পচন ধরেছে, পচন ধরেছে আমাদের মন মানসিকতায়। একদিনে এমনটা হয়নি, অসমপ্রীতির বীজ বপিত হয়েছে অনেক সময় আগে। এরপর জল, সার ব্যবহারে বীজ থেকে চারা, চারা থেকে শাখা প্রশাখা বিস্তার লাভ করতে সময় লাগেনি কারণ সার আর বীজের সাথে সাথে আবহাওয়াও অনুকূলে ছিল ! বর্তমানে এদের সংখ্যা আমাদের শুধু চিন্তিতই করে না, করে আতঙ্কিত। এই হীন মানসিকতা থেকে যদি বের হতে না পারি তাহলে কেউই শান্তিতে থাকতে পারবে না দেশে। প্রথমেই হাত দিতে হবে চারা গাছে। অর্থাৎ চারা’র যত্ন যদি সঠিকভাবে না নিতে পারি তাহলে সে গাছ থেকে যেমন ভালো ফুল ও ফল আশা করতে পারি না, আমাদের কোমলমতি শিশুদেরও যদি আমরা শুরু থেকে সঠিক শিক্ষা দিতে না পারি, তাহলে দেশের চেহারা দিন দিন আরোও খারাপ হবে। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে মানবিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে, আর এ লক্ষ্যে পরিবর্তন আর পরিবর্ধন প্রয়োজন পাঠ্যপুস্তকের। প্রায় ‘নেই’ হয়ে যাওয়া সংস্কৃতি চর্চা বাড়াতে হবে বাড়ি, স্কুল-কলেজ, আর পাড়ায় পাড়ায়। আগে স্কুল, কলেজে, পাড়ায় সংস্কৃতি চর্চার প্রচলন ছিল নিয়মিত। উপস্থাপিত হতো গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য। পাড়ার ছোট ছোট ক্লাবগুলো আয়োজন করতো বিভিন্ন প্রতিযোগিতার। পাঠ্যবইয়ে ছিল দেশের কথা, বীরের কথা, নদীর কথা, কৃষকের কথা, বন্ধুত্বের কথা, সাঁপুড়ের কথা, পায়রার কথা, পিঁপড়ার কথা, খোকার কথা, সম্পর্কে কথা, দাদীর কবরের কথা, তালগাছের কথা ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এখন?
যাই হোক এখনো সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। এখনও যদি আমরা নিজেকে ভালোভাবে গড়ে তোলার পাঠদানে মনযোগী হই, যদি আমরা আমাদের চারাগুলোর যত্ন নেই বাড়িতে বিদ্যালয়ে, যদি অনুকূল আবহাওয়া গড়ে তুলতে পারি তাহলে জীবনচিত্র বদলে যাবে। আমরা মুখিয়ে থাকবোনা আমাদের মেধাবী সন্তানদের দেশের বাইরে পাঠাতে কিংবা আমাদের সন্তানেরা চাইবেনা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর সে দেশেই বসত করতে। আমরা কেউই ছুটে যাবো না আমাদের নিজের দেশ ত্যাগ করে পরদেশে পরজীবী হয়ে নিরাপদ জীবন কাটাতে।
আমি থেকেই শুরু হতে হবে। আমার মানসিকতা আমার সন্তান আর পরিবারকে প্রভাবিত করবে, সন্তানের মানসিকতা তার সঙ্গীদের, এভাবেই পরিবার থেকে পাড়া, পাড়া থেকে সমাজ, সমাজ থেকে পুরো দেশ প্রভাবিত হবে। জায়গা করে নেবে সবার মাঝে ‘সমপ্রীতি’। লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার