বাংলাদেশের বাজার ছোট বলে ‘ক্লিন ফিড’ সরবরাহ করবে না ব্রডকাস্টাররা (চ্যানেল কর্তৃপক্ষ), ফিড ‘ক্লিন’ করার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নেই দেশের পরিবেশক ও ক্যাবল অপারেটরদের। অন্যদিকে ক্লিন ফিড ছাড়া বিদেশি চ্যানেল বন্ধ রাখার সরকারি নির্দেশনার মধ্যে অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে হাঁটছে দেশের ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রি।
সরকারি নির্দেশনা মানতে গিয়ে এখন অনুষ্ঠানের ফাঁকে বিজ্ঞাপন প্রচার করে এমন বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সমপ্রচার বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশের পরিবেশক ও ক্যাবল অপারেটররা। তবে সংকট নিরসনে সরকারের কাছে আরও সময় চেয়ে আবেদন করেছেন পরিবেশক ও অপারেটররা। খবর বিডিনিউজের।
ক্যাবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন, ২০০৬-এর ১৯(১৩) ধারায় বলা হয়েছে, বিদেশি কোনো চ্যানেলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন সমপ্রচার বা সঞ্চালন করা যাবে না। আইন ভেঙে ‘ক্লিন ফিড’ ছাড়া বিদেশি চ্যানেল সমপ্রচার বন্ধে পরিবেশক ও ক্যাবল অপারেটরদের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল সরকার। নির্ধারিত সময়ের পর ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের মধ্যে বিজ্ঞাপন ছাড়া বিদেশি চ্যানেল সমপ্রচারের প্রযুক্তি না থাকায় চ্যানেলই বন্ধ করে দিয়েছেন অপারেটর ও পরিবেশকরা।
বন্ধ থাকার মধ্যে বিবিসি, সিএনএন, স্টার স্পোর্টস, টেন স্পোর্টস, জি বাংলা, স্টার জলসা, সনি লিভসহ অন্তত ৬০টির মতো বিদেশি টিভি চ্যানেল রয়েছে; যে চ্যানেলগুলো বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়। বিষয়টি নিয়ে দর্শকদের মধ্যে আলোচনার মধ্যে তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রী পরিষ্কার বলছেন, সরকার কোনো চ্যানেল বন্ধ করেনি। বিজ্ঞাপন ছাড়া (ক্লিন ফিড) বিদেশি টিভি চ্যানেল সমপ্রচারে কোনো বাধা নেই।
টেলিভিশনের ফিড ক্লিন করবে কে : বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মহাপরিচালক হারুন-অর-রশিদ জানান, বিশ্বজুড়ে ক্লিন ফিড পাওয়ার প্রচলিত দুটি পন্থা রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে ব্রডকাস্টাররা আপ লিংকের সময় দেশভেদে আলাদা আলদা ফিড সরবরাহ করেন। ব্রডকাস্টারদের তরফ থেকে ক্লিন ফিড পেলে পরিবেশকরা কাঁটছাঁট ছাড়াই প্রচার করতে পারেন।
অন্যদিকে, ব্রডকাস্টারদের কাছ থেকে ক্লিন ফিড না পেলে পরিবেশকরাও ডাউন লিংকের পর সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুমে বিজ্ঞাপন ছেঁটে তা প্রচার করতে পারেন। কোনো বিদেশি চ্যানেল প্রচারের জন্য পরিবেশকদের প্রথমে তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হয়। দেশে সমপ্রচার কমিশন না থাকায় তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সেই বিদেশি চ্যানেল ডাউন লিংক করে উপযোগিতা যাচাই করে বাংলাদেশ টেলিভিশন। বিটিভির মতামতের ভিত্তিতেই পরিবেশকদের বিদেশি চ্যানেল ডাউন লিংকের অনুমতি দেয় সরকার।
ব্রডকাস্টাররা বাংলাদেশে ক্লিন ফিড দিচ্ছে না কেন : হারুন বলছেন, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচের সব দেশে ভারতীয় ব্রডকাস্টাররা ক্লিন ফিড সরবরাহ করে থাকে। মিডল ইস্টে ভারতের চ্যানেল চলছে, সেখানে ভারতের কোনো বিজ্ঞাপন নাই। মিডল ইস্টের বিজ্ঞাপন প্রচার হয়। এমনকি আরবি ভাষায় ডাব করেও চালাচ্ছে। বাংলাদেশ এত বড় একটা মার্কেট। তারা (ব্রডকাস্টার) সেখানে হুবহু ফিড দিবে, এটা তো হতে পারে না।
হারুন বলেন, তারা সৌদি আরবের দর্শকদের জন্য আপ লিংক দেয় তখন আরবি কনটেন্টকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের ফিড দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে ফিড দেওয়ার জন্য আলাদা করে বিজ্ঞাপন জুড়ে দেওয়া হয়; সেটা শুধু বাংলাদেশেই দেখা যায়; কলকাতায়ও সেটা দেখবেন না। মানে সে বিজ্ঞাপনটা দিচ্ছে বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য।
ব্রডকাস্টাররা অন্য দেশে ক্লিন ফিড দিলে বাংলাদেশে দিচ্ছে না কেন? এ প্রশ্নের জবাবে বিদেশি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের পরিবেশক প্রতিষ্ঠান ওয়ান এলায়েন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম সাইফুল হোসেন সোহেল বলেন, বাংলাদেশের মার্কেটের আকারের কারণে ব্রডকাস্টাররা ক্লিন ফিড দিচ্ছে না।
পরিবেশকরা পারছেন না কেন : সরকারের কাছ থেকে ডাউন লিংকের অনুমতি নিয়ে চারটি পরিবেশক প্রতিষ্ঠান বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৬০টির মতো টিভি চ্যানেল সমপ্রচার করে। এর মধ্যে জি নেটওয়ার্ক (জি টিভি, জি বাংলা, জি বাংলা সিনেমাসহ), সনি গ্রুপ (সনি টিভি, সনি লিভসহ), টেন স্পোর্টস, ডিসকোভারি গ্রুপের চ্যানেগুলোসহ সবচেয়ে বেশি বিদেশি টিভি চ্যানেলের বিপণন করে মিডিয়া কেয়ার লিমিটেড।
পরিবেশক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্রডকাস্টারদের কাছ থেকে বিদেশি চ্যানেল ডাউন লিংক করার পর ক্যাবল অপারেটরদের মাধ্যমে গ্রাহকের দোরগোড়ায় পৌঁছায়। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রডকাস্টারা ক্লিন ফিড না দিলে তা ক্লিন করার মূল দায়িত্ব বাংলাদেশি পরিবেশকদের ওপর বর্তায়। কারণ তারাই চ্যানেলগুলো আমদানি করে। তাদের মাঝখানে বাংলাদেশে আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; ক্যাবল অপারেটরা এখানে মাধ্যমমাত্র।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রীলংকা, নেপাল, পাকিস্তানসহ বিশ্বের অনেক দেশে পরিবেশকরা ফিড ক্লিন করে সমপ্রচার করেন। তাহলে বাংলাদেশে সম্ভব হচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে পরিবেশকরা বলছেন, প্রযুক্তিগত জটিলতার কারণে তারা চাইলেও ফিড ক্লিন করতে পারছে না। এই সেক্টর এখনও পুরোপুরি ডিজিটাল হয়নি। ডিজিটাল না হলে কাজটা তাদের জন্য কঠিন হবে। রাতারাতি কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না; তার জন্য সময় প্রয়োজন।
সরকার বলছে, সময় আগেই দেওয়া হয় : ২০১৯ সালের এপ্রিলে বিজ্ঞাপন ছাড়া বিদেশি চ্যানেল সমপ্রচারের বিষয়ে একটি নোটিস দিয়েছিল সরকার। ক্লিন ফিড প্রচারে ব্যর্থ হয়ে পরিবেশক জি নেটওয়ার্কের সব চ্যানেল একদিনের জন্য বন্ধ রেখেছিলেন। পরে বৈঠক শেষে পরিবেশকরা বলেছিলেন, বিজ্ঞাপন ছাঁটার প্রযুক্তি না থাকায় তারা বাধ্য হয়ে চ্যানেল বন্ধ রেখেছিলেন। পরে চ্যানেল খুলে দেওয়ার পর ক্লিন ফিড প্রচারের জন্য সেই বছরে জুলাই পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
পরিবেশক, ক্যাবল অপারেটরদের দাবি : ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রি এখনও অ্যানালগ পদ্ধতিতে চলছে। এই সেক্টর পুরোপুরি ডিজিটাল হলে কাজটা (ক্লিন ফিড) সহজ হবে। পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত সুবিধা পেলে গ্রাহকদের ঘরে সেটআপ বক্স বসিয়ে যে সিগন্যাল পাওয় যাবে তার মাধ্যমে বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বন্ধ করা যেতে পারে। এই কায়দায় বিজ্ঞাপন কেটে সেই সময়ে কিছু না কিছু সমপ্রচার করতে হবে। কারণ জায়গাটা তো খালি হয়ে যাবে। সেখানে অনুষ্ঠানের প্রমো দেওয়া যেতে পারে কিংবা সরকারি কোনো বিজ্ঞাপনও দেওয়া যেতে পারে। তার জন্য এই সেক্টরকে ডিজিটাল ঘোষণার পাশাপাশি ক্লিন ফিড বাস্তবায়নে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশগুলো বিনাশুল্কে কিংবা স্বল্পশুল্কে আমদানিরে অনুমতি দিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ করছেন পরিবেশক, ক্যাবল অপারেটররা।
দেশে ৫৭০টির মতো কন্ট্রোল রুম আছে, সেখানে ডিভাইসগুলো সরবরাহ করতে হবে। ক্লিন ফিড পেতে চিপ, ডিকোডার বক্স ও স্যাটেলাইট ট্রান্সপন্ডারের দরকার।
বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল বিদেশে কীভাবে সমপ্রচার হয় : ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে দূরদর্শন ডিটিএইচ-ডিডি ফ্রি ডিশের মাধ্যমে বাংলাদেশ টেলিভিশন আনুষ্ঠানিকভাবে সমপ্রচার শুরু করা হয়। সেই সময় বিটিভির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা হারুন-অর-রশিদ বলেন, ভারতে মূলত বিটিভি ওয়ার্ল্ড সমপ্রচার করা হয়। বাংলাদেশ থেকেই এর ক্লিন ফিড সরবরাহ করা হয়। বাংলাদেশের চ্যানেল বিদেশে সমপ্রচারের সময় বাংলাদেশের কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার হয় না।