জয়নুল আবেদীন – আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী। তাঁর চিত্রকর্মের প্রধান অনুষঙ্গ প্রকৃতি ও মানুষ। একদিকে শোষকের নির্মম নিষ্ঠুরতা, অন্যদিকে নিপীড়িত মানবতার দুর্দশা, কষ্ট আর বিদ্রোহ জয়নুলের ছবিতে বাস্তব রূপ পেয়েছে।
জয়নুল আবেদীনের জন্ম ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে। বাংলাদেশে চিত্রশিল্পকে প্রাতিষ্ঠানিক ও আধুনিক শিল্পকলায় প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অনন্য। চিত্রকলায় জয়নুল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছেন কলকাতার তৎকালীন সরকারি আর্ট স্কুলে। এখান থেকেই ১৯৩৮ সালে চারুকলায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। ছাত্রাবস্থায় সর্বভারতীয় এক চিত্রপ্রদর্শনীতে শিল্পীর আঁকা ছয়টি জলরং শ্রেষ্ঠ চিত্র হিসেবে স্বর্ণপদক পেয়েছিল। প্রথম দিকে জয়নুলের চিত্রকলার বিষয়বস্তু ছিল রোমান্টিক ধারার। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় সারা বাংলা জুড়ে যে দুর্ভিক্ষ আর মহামারি ছড়িয়ে পড়ে তা তিনি নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলেন তাঁর ছবিতে। দুর্ভিক্ষ পর্যায়ের এইসব ছবি বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে এবং তিনি বিখ্যাত হয়ে যান। দেশ বিভাগের পর জয়নুল চলে আসেন ঢাকায়। তাঁরই নেতৃত্বে এবং কামরুল হাসান, শফিউদ্দিন আহমদ, আনোয়ারুল হক, শফিক-উল আমিন, খাজা শফিক আহমদ প্রমুখ শিল্পী বন্ধুর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা আর্ট স্কুল – বর্তমানে এটিই বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউট। সোনারগাঁয় লোকশিল্প জাদুঘর এবং জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একজন সক্রিয় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এই শিল্পী। দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষায় ছিলেন আপসহীন। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনির নির্যাতনের প্রতিবাদে বর্জন করেন তাঁকে দেওয়া ‘হেলাল ইমতিয়াজ’ উপাধি। পাকিস্তান সরকার রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার বন্ধের সীদ্ধান্ত নিলে তারও তীব্র প্রতিবাদ করেন জয়নুল। শিল্পীর আঁকা উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে: দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা, সংগ্রাম, গাঁয়ের বঁধূ, আদিবাসী রমনী, মনপুরা-৭০ প্রভৃতি। বাংলার মানুষ ভালোবেসে তাঁকে উপাধি দিয়েছিল ‘শিল্পাচার্য’। ১৯৭৬ সালের ২৮শে মে ফুসফুসের ক্যান্সারে এই মহান শিল্পীর মৃত্যু হয়।