শিক্ষিত হওয়ার চেয়ে মানুষ হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ

সুব্রত কুমার নাথ | বুধবার , ৫ অক্টোবর, ২০২২ at ৮:৩১ পূর্বাহ্ণ

কথায় আছে, প্রাণ থাকলে প্রাণী হয়, মন না থাকলে মানুষ হয় না। মানুষের মন তৈরী থাকে না। মনকে সৃষ্টি করে নিতে হয়। মনকে মানবিক মূল্যবোধে সৃষ্টি করতে পারলে তবেই সে মানুষ। এ বিশ্বসংসারে সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে মানুষই শ্রেষ্ঠ। বিবেক, বুদ্ধি, আত্মসংযম ও মনুষ্যত্ববোধের কারণে মানুষ সেরা। মানুষ হলে মানবিকতা থাকবে, অন্যের অনুভূতি বুঝবে, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করবে, এটাই সত্য। এরূপ মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষা লাভ একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষের ইতিবাচক আচরণিক পরিবর্তন ঘটে। একজন শিশু জন্মের পর থেকেই শিক্ষা লাভ শুরু করে। প্রথমত পারিবারিক শিক্ষা দ্বিতীয়ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। নেপোলিয়ান বলেছেন, মায়ের শিক্ষাই শিশুর ভবিষ্যতের বুনিয়াদ। এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, একজন শিশুর পারিবারিক শিক্ষা তার জীবনের মূলভিত্তি। এখান থেকেই তার সততা, নৈতিকতাবোধ, মনুষ্যত্ববোধ ইত্যাদি গুণাবলি তৈরী হতে থাকে। শিশুর মানবিকতা বিকাশে পারিবারিক শিক্ষা অপরিহার্য। পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করে সার্টিফিকেট অর্জনপূর্বক একজন শিশু শিক্ষিত মানুষে পরিণত হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান উপলব্ধি না করে যারা কেবল সার্টিফিকেট অর্জনে ব্যস্ত থাকে তাদেরকে শিক্ষিত বলা হয়। অন্যদিকে, যারা নিরন্তর অধ্যয়ন সহ বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পারে, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে জানার আকাঙ্ক্ষায় নিরন্তর উন্মুখ হয়ে থাকে, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকতা ও প্রযুক্তিকে গ্রহণ করে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে পারে তারাই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়। সুশিক্ষায় শিক্ষিত লোক সমাজের মূল্যবান সম্পদ। কারণ তাঁদের দ্বারা দেশ আলোকিত হয়। একজন শিশুর জীবনে সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো তার পরিবার। যেখানে বাবা-মা, পরিবার-পরিজন প্রত্যেক সদস্যই শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারে। এজন্য পরিবারের সদস্যদেরও নৈতিক গুণাবলি সম্পন্ন হওয়া খুবই জরুরি।
মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা ব্যক্তির সামগ্রিক বিকাশ ও সামাজিক উন্নয়নের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। একজন ব্যক্তি যে পরিবেশের সদস্য ওই পরিবেশের উন্নতি, অবনতি বা যে-কোনো ধরনের পরিবর্তন বা অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে পারার সক্ষমতা অর্জন হলো শিক্ষা। অর্থাৎ শিক্ষা হলো একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। নৈতিকতা, সামাজিকতা, সততা, মানবিকতা এসব গুণাবলি সামাজিক প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আত্মোপলব্ধি ও আত্মপ্রকাশ সহ মানবীয় আচরণই হলো যথার্থ শিক্ষা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজ যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত লোক তেমন একটা চেখে পড়ে না। অথচ, শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে। বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৫. ৬ শতাংশ। শিক্ষাব্যবস্থার কারণে বর্তমানে নারী-পুরুষের সমঅধিকারও অনেকাংশে প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষাক্ষেত্রে এসব ঈর্ষণীয় সাফল্যের প্রেক্ষিতে দেশে শিক্ষিত মানবসম্পদ তৈরি হচ্ছে কিন্তু নৈতিক, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষিত মানুষ তৈরি হচ্ছে না। হার্বাট স্পেনসার বলেছেন, শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য মানুষের চরিত্র গঠন করা। তাই মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হতে হলে পরিবারিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেও অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য শিক্ষার্থীদের নৈতিক, মানবিক ও সামাজিক বিকাশ ঘটানোর জন্য শিক্ষকদেরও মানবীয় আচরণ করতে হবে এবং সকল শ্রেণির পাঠ্যসূচীতে মানবিক মূল্যবোধ সংক্রান্ত বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
মূল্যবোধসম্পন্ন মানবসম্পদ একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। আজকাল দেখা যায়, কোমলমতি শিশু ও যুবসমাজের নৈতিকতা ও মানবিকতা চর্চার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই যে কারণে তারা অন্ধকার জগতে পা বাড়াচ্ছে। তারা জঙ্গিবাদ, খুন, মাদকাসক্তি, ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন পেশাজীবী ঘুষ দুর্নীতির মতো অনৈতিক কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা সহ প্রশাসন দুর্বৃত্তায়নের পথে হাঁটছে। সুশিক্ষার অভাবে মানুষও হয়ে যাচ্ছে আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। এমনকি তারা জন্মদাতাদের নিয়ে পর্যন্ত ভাবে না। তাদের এ স্বার্থপরতা আত্মীয়- স্বজন থেকে পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে দেয়। প্রায়ই দেখা যায় উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চপদে আসীন চাকরিজীবী সন্তানের বাবা- মায়েরও স্থান হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে, এটা সত্যিই দুঃখজনক। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত শিক্ষার প্রতি মনোযোগ দিলে হবে না, সাথে সাথে ধর্ম, নৈতিকতা ও সামাজিকতাবোধ চর্চার প্রসার ঘটাতে হবে। এর ফলে প্রত্যেকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবে। সুশিক্ষিত হলে অন্যায় ও অসৎ পথে কখনো কেউ পা বাড়াবে না, সর্বদা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে দ্বিধাবোধ করবে না। নিজ সত্তাকে জানার চেষ্টা করবে এবং মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করবে। চার্চিল বলেছেন, একজন মানুষের কাছে তার একমাত্র পথপ্রদর্শক হচ্ছে তার বিবেক, তার মরণোত্তর খ্যাতির একমাত্র ধর্ম হচ্ছে তার সততা এবং তার আচরণের আন্তরিকতা। বিবেক মানুষকে আত্মোপলব্ধি করতে শেখায়। সততা দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায় আর আন্তরিক আচরণে মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায়।
বিবেক, সততা ও আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ মানবিক আচরণের পূর্ব শর্ত। শিক্ষা ও নৈতিকতা একটি আরেকটির পরিপূরক। মানবিক গুণাবলি ব্যতীত অর্জিত শিক্ষা কুশিক্ষা পর্যায়ে পড়ে। আর এ কুশিক্ষা মানুষকে পশুর চেয়েও অধম করে দেয়। যারা অহংবোধে মত্ত হয়ে ক্ষমতার দাপট দেখায়, প্রশাসনে যারা অধস্তনদের প্রতি সর্বদা মেজাজ দেখায় ও দুর্ব্যবহার করে তারা সুশিক্ষিত নয় বলে মানতে হবে। দুর্ব্যবহার ও দুর্নীতি একই সূত্রে গাঁথা। তাই দুর্ব্যবহারকারীও অপরাধী বলে মানতে হবে। মানুষ হলে সদ্ব্যবহার করবে, জ্ঞানী ও বিনয়ী হবে, উদারতা ও সততার পরিচয় দেবে, মনুষ্যত্ববোধ থাকবে। তারাই পৃথিবীকে মানবিক চেতনায় সাজিয়ে তুলবে।
এজন্য প্রয়োজন সুশিক্ষায় শিক্ষিত মানবিক প্রজন্ম। তারা অন্ধকার ও দুর্দশাগ্রস্ত জাতিকে অনির্বাণ আলোর ঠিকানায় পৌঁছে দেবে। জাতি একটি স্বপ্নের সোনার বাংলা খুঁজে পাবে। যেখানে থাকবে মানবিকতার ছোঁয়া, সত্য ও সুন্দরের চর্চা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও মহৎ প্রাণের আদর্শ। প্রকৃত মানুষ তৈরী হলেই সুশোভিত সমাজ ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাবে। তাই প্রত্যেকের শিক্ষিত হওয়ার চেয়ে মানুষ হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাদশা মিয়া চৌধুরী ডিগ্রি কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধমায়ের বিসর্জন
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে