মায়ের বিসর্জন

গৌরী সর্ববিদ্যা | বুধবার , ৫ অক্টোবর, ২০২২ at ৮:৩১ পূর্বাহ্ণ

চারপাশে হৈহৈ রব। আকাশে নীল শাদা খণ্ডমেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। ভোরের হালকা কুয়াশায় ভিজে যাওয়া ঘাস সকালের মিষ্টি রোদে চিকচিক করছে। উঠোনের কোণায় শিউলি ঝরে সাদা হয়ে আছে। গাছে গাছে কিচিরমিচির করছে রঙবেরঙের পাখি। দূর থেকে মাইকের শব্দে ভেসে আসছে লতা মুঙ্গেশকর আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান।
সুনেত্রা দেবীর শরীর ভালো লাগছে না। বিছানায় শুয়ে আছেন। কোনোভাবেই শরীরটাকে হালকা করে মাটিতে পা বসাতে পারছেন না। তাঁর খুব খারাপ লাগছে পুজোয় যুক্ত হতে পারছেন না বলে। অথচ গেলো বছরগুলোতে মায়ের আগমনী থেকে বিসর্জনের সব কাজ তিনি নিজের হাতে করেছেন। ভোগ রান্না থেকে চণ্ডীপাঠ সব একা সামলিয়েছেন। ত্রিণয়নী, জয়া, বাকিরা এসে শুধু সব্জিগুলো কেটে টুকটাক কাজ করে দিতেন।
সন্ধ্যা হয়েছে। পশ্চিমের আকাশ যেন সিঁদুর লালে সজ্জিত। মাঝে মাঝে শাদা মেঘ তুলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। সুনেত্রা দেবী সামনের খোলা জানালা দিয়ে সব দেখছেন। মা আসছেন, ঢাকের শব্দ শোনা যাচ্ছে। উলুধ্বনি, শঙ্খ বাজার শব্দ শুনে প্রতিবছরের মতো ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে তাঁর। পুরো ঘর ফাঁকা। সবাই মা’কে নিয়ে ব্যস্ত। সুনেত্রা দেবীর মনে হচ্ছে পা থেকে আস্তে আস্তে কোমরও অবশ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বিছানায় পড়াতে ছেলে-মেয়ে, স্বামী কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না সুনেত্রা দেবীর শরীর খারাপের দিকে যাচ্ছে। সবাই ভাবছে দুইদিন বিশ্রাম নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
উমাকে দেখে ত্রিণয়নী, জয়া সবাই জিগ্যেস করছে কিরে উমা! তোর মা কই? এবার তোর মা’কে দেখছি না।
মায়ের একটু শরীর খারাপ মাসী। ব্যথার জন্য বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। বিশ্রাম নিচ্ছে। এভাবে সপ্তমী, অষ্টমী শেষ হয়ে আজ নবমী।
আজ দশমী। সবাই পুজো নিয়ে খুব ব্যস্ত। সুনেত্রা দেবী রমাকে ডেকে জিগ্যেস করে তোর কর্তাবাবু কোথায় রে? কর্তা তো নিচে বসে সবার সাথে গল্প করছেন গিন্নিমা।
ছেলে মেয়ে দুইজন নিচে আরতি, গান নিয়ে নাচানাচি করছে। আমি আপনার জন্য প্রসাদ নিয়ে এসেছি, খেয়ে নিন।
সুনেত্রা দেবীর সারা শরীর খুব ভারি ভারি লাগছে। মনে হচ্ছে প্রেসার, কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিক সবকিছু বেড়েছে।
শরীরটা খুব খারাপ লাগছে রে। তোর কর্তাবাবুকে একটু ডেকে দিবি? তাইলে তো সারছে গিন্নিমা। কোনোদিন কি আপনার ডাকে আসছেন কর্তা? সুনেত্রাদেবী মনে মনে ভাবলেন ঠিকই তো! তিনদিন ধরে বিছানায় টানা পড়ে আছি কই কেউ আমার কাছে আসলো না তো খবর নিতে! ঘর, সংসার, ছেলেমেয়ে সবাইকে সময় দিতে দিতে নিজের দিকে খেয়ালই করিনি।
কখন যে এতো রোগকে শরীরে আমন্ত্রণ জানিয়েছি টেরই পেলাম না। ভাবতে ভাবতে চোখের দু’পাশ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অভিমানী সুনেত্রা দেবীর। মনে মনে মা দুর্গাকে প্রণাম করে বলতে লাগলো….মা এই জন্মের মতো পরজন্মেও যেন তোমার পুজোর কাজ করার সুযোগ পাই এবং আমার সেবা যাতে কাউকে করতে না হয়, একটু দেখো মা। বলে একটা নিঃশ্বাস ফেললো সুনেত্রা দেবী।
দশমীতে সবাই সিঁদুর খেলা খেলছে। মিষ্টিমুখ করছে। হৈচৈ করে সবাই গেছে মা’য়ের বিসর্জনে। সুনেত্রা দেবীর স্বামী, দুই ছেলেমেয়ে বিসর্জনে যা দেখেছে বিশ্বাস করতে পারছে না! তারা দেখে প্রতিমার সাথে সুনেত্রা দেবীরও বিসর্জন হচ্ছে। সবাই সুনেত্রা দেবীকেও কপালে সিঁদুর পরিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে মা দুর্গার সাথে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। ছেলেমেয়ে দু’জন মা’ মা’ করতে করতে বাসায় ছুটে এসে দেখে, সুনেত্রা দেবী আর নেই! বিছানায় পড়ে আছে তাঁর নিথর দেহ! সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে.. হঠাৎ শূন্য ঘরে বেজে ওঠে। যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইবো না মোর খেয়া তরী এই ঘাটে…যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকী যে আনন্দ —
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষিত হওয়ার চেয়ে মানুষ হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ