শাহানশাহ্‌ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারীকে (ক) যেমন দেখেছি

মোঃ গোলাম রসূল | সোমবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:২২ পূর্বাহ্ণ

শাহানশাহ্‌ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী () ১৯২৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডার শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সনের ১২ অক্টোবর দিবাগত রাত ১২টা ২৭ মিনিটে চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালে ওফাতপ্রাপ্ত হন। তাঁর ৬০ বছরের জীবনে মহান আল্লাহ্‌র তপস্যায় নিজ জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। দুনিয়ার ভোগবিলাস তাঁকে আকর্ষণ করতে পারেন। কারণ খোদাভীতির জ্বলন্ত উদাহরণ হিসাবে বিরাজিত ছিলেন। তাই এই বিশ্বওলির জন্ম পৃথিবীতে সুসংবাদ নিয়ে আসে। আল্লাহ্‌র ওলির জন্ম হলে বিশ্বের গাছপালাপশুপাখি ও সকল সৃষ্টি আনন্দ করতে থাকে। তিনি সকল সৃষ্টির জন্যই মঙ্গল বয়ে আনেন। আবার এ ধরনের আওলিয়াদের ওফাত হলে সৃষ্টির সকল কিছুই শোকে মুহ্যমান থাকে।

তিনি বলতেন “I have my administration. I administer the whole world এই জন্যেই তিনি বিশ্বওলি। স্বর্গীয় নূরের ঝলক তাঁর উপর নিপতিত হয়েছিল এবং এলহামের মাধ্যমে তাঁর সকল কার্য পরিচালিত হতো। তাই আল্লাহ্‌র নির্দেশের বাইরে তিনি কোন কাজ করতেন না। ১৯৮৭ সালে আমার খুব বড় ধরনের অসুখ হয়েছিল। আমি বাবাজানের কাছে গেলাম এবং দোয়া চাইলাম। তিনি বললেন, “নামাযকালাম পড়েন। অসুখ ভাল হয়ে যাবে।” একবার আমার মেজ ছেলের ছোট অবস্থায় খুব জ্বর হলো। ঐদিন সৌভাগ্যক্রমে তিনি আমার বাসায় এলেন এবং ছেলেকে ধরে খাড়া করলেন এবং বললেন, “আপনার আম্মাকে একটু দুধ খাওয়াতে বলুন”। তখন তার মা দুধ খাওয়ানোর সাথে সাথে জ্বর ছেড়ে গেল।

শাহানশাহ্‌ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারীর () ব্যক্তিত্ব এত বিশাল ছিল যে, আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। তিনি ছোট বড় সকলকে আপনি বলে ডাকতেন। একবার তিনি আমাকে তাঁর গাড়িতে বেতবুনিয়া নিয়ে গেলেন। তিনি তাঁর পাশে বসতে বললেন। কিন্তু ভয়ে আমার গা শিউরে উঠল। বেতবুনিয়া যাবার পর তিনি বললেন– “Look at these hills. we celebrate Zikr over these hills at dead of night.” আমি বললাম বাবাজান, আপনার কোন ভয় হতো না। তিনি বললেন, বাঘ, ভালুক, সর্প, পশুপাখি সব কিছুই আল্লাহ্‌তায়ালা ওলিদের তাঁবেদার করে দেন। ফলে তারা ওলিদের সেবায় নিয়োজিত থাকে।

চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের মান্নান সাহেব একবার গভীর রাতে বাবাজানের দরবারে হাজির। বাবাজান আল্লাহ্‌তায়ালার জিকরে রত ছিলেন। একটু পরে উঠে বসে বললেন, “মামু সাব, সবাই আমার কাছে দুনিয়ার ধনদৌলত, ছেলেমেয়ে, পদোন্নতি ইত্যাদি চায়। কিন্তু তারা আখেরাত চায় না। এই বলে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। বাবাজানের সাথে আমার একবার দেখা হয় ১৯৮৬ সালে সিডিএ আবাসিক এলাকায় জনাব মীর হোসেনের বাসায়। আমি দেখলামকম্বল গায়ে দিয়ে তিনি জিকরে রত। আমরা চুপ করে বসে রইলাম। সকালে তিনি উঠে আমাকে কাছে ডাকলেন এব তাঁর সাথে কেরম বোর্ড খেলতে বললেন। তারপর কিছুক্ষণ পর ৭ গ্লাস পানি খাওয়ালেন এবং বললেন, “আলী নবী মামা, গোলাম রসূল সাবের পরিচালক পদে প্রমোশন আদেশ জারী করে দিন।” তারপর কিছুদিনের মধ্যে ২৬//৮৬ তারিখে আদেশ হলো।

বাবাজান একবার আমার বাসায় কয়েকদিন ছিলেন। এসেই বললেন, “পানির ট্যাপগুলো খুলে দিন।” আমি বললাম, “বাবাজান সব পানি পড়ে গেলে বাসার কাজকর্ম কীভাবে চলবে? তিনি বললেন, “কাছড়া যাক।” তারপর কয়েকদিন যাবত পানি পড়লেও পানির ট্যাংক সর্বদা পরিপূর্ণ থাকল এবং পানির কষ্ট মোটেই হয় নাই। তারপর বললেন, “রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে সবচেয়ে বড় মাছটা কিনে আনুন।” তিনি টাকা দিলেন। চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত নূর মোহাম্মদ সাব এবং আমি একটা খুব বড় কাতলা মাছ আনলাম। তিনি বললেন, রান্না করে টেবিলে তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রাখবেন। শহর থেকে যত লোক আসবে, তাদের সকলকে খাওয়াবেন। আমরা ৪০ জনের জন্য খানা পাক করলাম। কিন্তু সেই খানা প্রায় ২৫০ জন খাওয়ার পরেও শেষ হলো না। তারপর তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জনাব মিজানুর রহমান সাবকে ফোন করে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। প্রধানমন্ত্রী সাব বিকেলেই চট্টগ্রাম এলেন এবং আমার বাসায় বাবাজানের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বাবাজান বললেন, “আল্লাহ্‌র ওলি যেখানেই যায়, সেটাই তাঁর দরবার হয়। আপনি মাইজভাণ্ডার গিয়ে জিয়ারত করুন।” তারপর রাতে জনাব আলী নবী বললেন, বাবাজান, আমি ফ্রিজ কিনব, আমাকে দয়া করুন। তখন বাবাজান তাঁকে ১৮ হাজার টাকা দিলেন এবং বললেন, মামু সাব দুনিয়া চায়। আমার বাসায় বাবাজানের জন্য আলাদা বিছানা করে দিলাম। কিন্তু তিনি সে বিছানায় না গিয়ে আমার ছোট বাচ্চারা যে বিছানায় থাকে সেখানেই কয়েকদিন থাকলেন। সারারাত মহান আল্লাহ্‌র জিকর করতেন। ভোরে কেবল এক কাপ চা খেতেন। দুপুরে এক লোকমা ভাত ড্রাইভার রফিক বা আমার স্ত্রী মুখে দিতেন। এই ছিল নিদ্রাহীন ও খাবারবিহীন জীবন। এসব দেখে আমি বিস্মিত না হয়ে পারিনি।

জ্ঞানের ৪টি স্তর আছে। শরীয়ত, তরীকত, হাকিকত ও মারেফাত। শরীয়তকে প্রাথমিক স্কুলের জ্ঞান, তরীকতকে হাই স্কুলের জ্ঞান, হাকিকতকে কলেজের জ্ঞান এবং মারেফাতকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানের সঙ্গে তুলনা করা হয়। বাবাজানের জ্ঞান সকল স্তরেই পরিপক্ব ছিল। তিনি মারেফাতের চরম উপরের স্তরে পৌঁছে ফানাফিল্লাহ্‌, বাকাবিল্লাহ্‌ অর্জন করেছিলেন। তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “বাবাজান, নামায না পড়লে কি হয়? তিনি বললেন, “হেকমতের ক্ষতি হয়”। তিনি কেবল মানুষের কল্যাণই করেন নি, জীবজন্তু ও পশুপাখি সকলের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। মহান আল্লাহ্‌র অনন্ত স্থায়িত্ব তাঁর উপরই বিরাজমান ছিল। আমীন!

পূর্ববর্তী নিবন্ধসঞ্চয়পত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিল নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধসরকারের সমস্ত অর্জন বিফলে যাবে, যদি প্রকৃত শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতি না পায়