পতেঙ্গা লালদিয়ার চরে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। ৬ জন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে প্রায় এক হাজার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছাড়াও যোগাড় করা হচ্ছে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক। আগামী ১ মার্চ উচ্ছেদ অভিযান হবে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার বিকল্প নেই বলে বন্দর কর্তপক্ষের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। গতকাল শনিবার স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং পুনর্বাসনের দাবিতে আন্দোলনরত নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। আন্দোলনকারীরা ৪ মার্চ পর্যন্ত সময় চান। বন্দর কর্তৃপক্ষ আদালতের রায়ের কারণে সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে ১ মার্চ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানায়। দুই ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠকের পর লালদিয়ার চর থেকে অনেককে অন্যত্র সরে যেতে দেখা গেছে। এদিকে আগামী ১ মার্চের উচ্ছেদ অভিযান ঘিরে স্থানীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা জারি করা হচ্ছে।
লালদিয়ার চরের ৫২ একর ভূমিতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে ম্যাজিস্ট্রেট, র্যাব, পুলিশ এবং আনসার সদস্য চেয়ে পত্র দেয়া হয়েছে। ১ মার্চ এক হাজারের বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ৬ জন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করবেন। এটি বন্দরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উচ্ছেদ অভিযান হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গতকাল জানিয়েছেন। অভিযান নির্বিঘ্ন করতে প্রচুর শ্রমিক যোগাড় করা হচ্ছে। ৮ মার্চের মধ্যে উচ্ছেদ অভিযানের বিস্তারিত প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করতে হবে। প্রতিবেদন জমা দেয়ার আনুষ্ঠানিকতা সারতে ৪/৫ তারিখের মধ্যে আদালতে প্রদান করতে হবে বলে বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে লালদিয়ার চর উচ্ছেদ বিরোধী নেতৃবৃন্দকে জানানো হয়েছে।
গতকাল সকাল ১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত বন্দর ভবনে বৈঠক হয়। বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহানের সভাপতিত্বে এতে বন্দরের সদস্য এবং শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পুনবার্সনের দাবিতে আন্দোলনরত লালদিয়ার চরের মানুষের পক্ষে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছালেহ আহমেদ চৌধুরী, সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ আসলাম, লালদিয়ার চর পুনর্বাসন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আলমগীর হাসানসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
উচ্ছেদ অভিযানের সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে জানানোর পর গতকাল বিকালে অনেকগুলো পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। ট্রাক ও ভ্যানে মালামাল নিয়ে বেশ কিছু পরিবার চলে যায়।
লালদিয়ার চর পুনর্বাসন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আলমগীর হাসান বলেন, লালদিয়ার চরে ১৪ হাজারের মতো মানুষ রয়েছেন। এদের বাপ-দাদার ভিটে থেকে সরিয়ে লালদিয়ার চরে রাখা হয়েছিল। এখন পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ হলে এতগুলো মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে বিমান ঘাঁটি সমপ্রসারণের কাজের কারণে ঘাঁটি সংলগ্ন এলাকা ছেড়ে আসা কয়েকশ পরিবার স্থায়ী বন্দোবস্তি পাওয়ার আশ্বাসের ভিত্তিতে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে লালদিয়ার চরে বসতি শুরু করে। এখন ওই এলাকায় ২৩০০ পরিবারের ১৪ হাজার মানুষের বসবাস। শুধু বাসিন্দারা নন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ চরবাসীর পক্ষে তাদের অবস্থান জানিয়েছেন। সিটি কর্পোরেশনের সদস্য বিদায়ী প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনও পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদের বিরোধিতা করেছেন।
বন্দর কর্তৃপক্ষের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা বলেন, এই ভূমি বন্দর কর্তৃপক্ষের। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কৃষিভূমি হিসেবে এগুলো ইজারা দেয়ার রেকর্ড রয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের মালিকাধীন ভূমি উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। সর্বশেষ ৮ ডিসেম্বর জরিপ অনুযায়ী লালদিয়ার চরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আদালতের নির্দেশনা দুই মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।
১৭ ফেব্রুয়ারি বন্দর কর্তৃপক্ষ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সব ‘অবৈধ দখলদারকে’ অবিলম্বে ওই জায়গা ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করা হয়। গত বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে এসে নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী লালদিয়ার চরে উচ্ছেদে অনড় অবস্থানের কথা জানান। পাশাপাশি বলেন, সেখানে পুনর্বাসনের মতো কেউ নেই। লালদিয়ার চরে জমি ‘দখলে রেখে’ যারা আর্থিক ‘ফায়দা লুটেছে’ তাদের তালিকা করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। মন্ত্রীর এই ঘোষণার পর পুনর্বাসনের দাবিতে মানববন্ধন করে কয়েক হাজার স্থানীয় মানুষ। তাদের সাথে বিভিন্ন সংগঠন একাত্মতা প্রকাশ করে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি ম্যানেজার এস্টেট মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান বলেন, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মহোদয়ের সাথে বৈঠক করেছেন। বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তারা ছিলেন। কর্তৃপক্ষ নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে। আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। যাদের সামর্থ্য আছে তারা চলে যাচ্ছে। কিন্তু বহু মানুষ রয়েছে যাদের যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই।
স্থানীয় কাউন্সিলর ছালেহ আহমদ চৌধুরী বলেন, আমরা ৪ তারিখ পর্যন্ত সময় চেয়েছিলাম। দেয়নি। আমরা আর কী করব? এলাকায় এসে মানুষকে শান্তিপূর্ণভাবে চলে যেতে বলেছি। সবাই চলে যাবে। তিনি জানান, ২৩শ পরিবারে ১৪ হাজারের মতো বাসিন্দা রয়েছে। এর মধ্যে ৩১৬১ জন ভোটার। ঘরবাড়ি ছাড়াও মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, সাইক্লোন শেল্টারসহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে।