রোকেয়ার দর্শন

ড. আনোয়ারা আলম | শুক্রবার , ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি মুসলিম নারী সমাজের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রথম প্রবর্তক বেগম রোকেয়া। তাঁর চিন্তা চেতনার বিষয় ছিল সমাজে নারীর পশ্চাৎপদতা-অশিক্ষা ও কুসংস্কারচ্ছন্নতা এবং ঔপনিবেশিক শাসন- শোষণ নিয়ে। তাঁকে ধর্ম পিতৃতন্ত্র, নারী পুরুষের বৈষম্যের আক্রমণাত্মক পরিবেশের মধ্যে দিয়ে নারী মুক্তির কাজ পরিচালনা করতে হয়েছে। তৎ্‌কালীন ধর্মীয় মৌলবাদ, শিক্ষাহীন সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে নারী পুরুষের সমন্বয়ে সামগ্রিক সত্তা নির্মাণ করার আকাঙ্ক্ষায় নারীকে পুরুষের সমকক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। তাঁর সংগ্রাম ছিল পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে।

রোকেয়া দর্শনের আলোকপাত ঘটেছে তিনটি গ্রন্থে ‘সুলতানার স্বপ্ন’-‘পদ্মরাগ’- ‘অবরোধবাসিনী’ -এ।
সুলতানার স্বপ্ন -আখ্যানটি নারীবাদী বিশ্বের বা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ মেনিফেস্টো।

পদ্মরাগ- উপন্যাস বাস্তবতার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তত্‌কালীন সম্ভাব্য স্বাধীন মনুষ্য অবয়বধারী নারীর রূপরেখা। অবরোধবাসিনী গ্রন্থ হচ্ছে অবরোধ ও পর্দাপ্রথা সম্পর্কে রোকেয়ার ভাবনা নিয়ে যত বিভ্রান্তি তার মোক্ষম উত্তর।

নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি প্রধানত শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। যে শিক্ষা অর্জন চাকরির জন্য নয় বরং মানুষের অন্তর্জাত শক্তির উপায় হিসেবে। তাঁর মতে ‘শিক্ষার অর্থ কোনও সমপ্রদায় বা জাতি বিশেষের ‘অন্ধকরণ’ না। স্রষ্টা যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা দিয়েছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলনের দ্বারা ধারণ করাই শিক্ষা’’। তাঁর মতে – সৃষ্টিকর্তা আমাদের যে হাত, পা, চোখ, কান, মন এবং চিন্তাশক্তি দিয়েছেন, আমরা সেগুলো যদি সবল করি, হাত দিয়ে সত্‌ কাজ করি, কান দিয়ে মনোযোগের সাথে শুনি এবং চিন্তা শক্তি দিয়ে আরও সুক্ষ ভাবে চিন্তা করতে শিখি, তবে সেটাই প্রকৃত শিক্ষা। ‘শিক্ষা বলতে শুধু সনদ অর্জন করা, অর্থ উপার্জন করাকে বুঝেন নি, এটিকে তিনি মনো প্রক্ষোভিক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুলনা করেছেন। রোকেয়ার শিক্ষা দর্শন অভিজ্ঞতাবাদী ও প্রয়োগবাদীও।

শুধু সফলতা অর্জন নয় শিক্ষাকে আর্থ সামাজিক ব্যক্তিত্বের উন্নয়ন তথা মানবিক উন্নয়নকে বুঝিয়েছেন। নারী মুক্তির জন্য তিনি বলেছেন দরকার উদ্বোধক শিক্ষা যাতে কর্মক্ষেত্রে, সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারী যথাযথ ভুমিকা রাখতে পারে। সেভাবেই তিনি নারীকে গড়ে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।

তাঁর ইউটোপিয়া ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক ভৌগলিক বিষয়ে শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্থানের পরিবেশ, মানুষের জ্ঞান দানের বিষয়ে যেমন তেমনি বিজ্ঞান বিষয়ে ও আলোকপাত করেছেন যা সে যুগের প্রেক্ষিতে পরম বিস্ময়কর।

মানসিক শিক্ষার প্রসারে তিনি ধর্ম ও নৈতিকতা বিষয়ে গুরুত্ব করেছেন।

তাঁর মতে ‘আত্মসচেতনতা সত্তা মাত্রই বড়ো কোনও ক্ষেত্র, উচ্চতর কোনও আদর্শের জন্ম দিতে চায়’। এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি নারীমুক্তি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে সক্ষম হন। একজন সফল সমাজকর্মী হয়ে এখানেই তাঁর সার্থকতা।

রোকেয়া নিজের উপলব্ধ ব্যক্তিগত যন্ত্রণাকে ব্যক্তিগত না বরং সামাজিক বেদনা হিসেবে দেখে নিজেকে বিচ্ছিন্ন না রেখে বিবেচনা করেছেন অনেকের একজন হিসেবে। নির্যাতিতা নারীর প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে অবিচারের সামাজিক কারণ দেখিয়েছেন, প্রতিকার করতে চেয়েছেন সামাজিকভাবে। আপোষকামী ছিলেন না বিধায় সামাজিক অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে বলেন নি।

১৯০৪ সালে তিনি শাণিত ভাষায় বলেছেন–‘আমাদের যথাসম্ভব অধঃপতন হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনো মাথা তুলতে পারি নাই, তাহার প্রধান কারণ এই বোধহয় যে, যখনই কোনও ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। ‘আমরা প্রথমত যাহা সহজে মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি’।

সামন্ত পরিবেশে জন্ম গ্রহণ-যে পরিবেশ নারীর কোনও অধিকার স্বীকার করে না, তেমন পরিবেশ থেকে এসে রোকেয়ার মধ্যে যে ব্যক্তিত্ব ও সাহস এবং প্রতিবাদী মনোভাব তা সত্যিই অভাবনীয়। আজন্ম এ বিদ্রোহী সত্তার নারীর মাঝে ছিল শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ। যে কারণে প্রথমে বড়ো ভাই এবং পরবর্তী তে স্বামীর সাহচর্যে ও অনুপ্রেরণায় নিজেকে তৈরি করেছেন। মাত্র পঁচিশ বছরে ইংরেজিতে লিখেছেন সুলতানার স্বপ্ন নামে ইংরেজিতে এক অসাধারণ ইউটোপিয়া।

যেখানে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন এক নারীস্থানের যেখানে নারীরা বিজ্ঞান চর্চায় শক্তিশালী, বাল্যবিবাহ নেই আছে বিমান পথে (বায়ু শকটে যাতায়াত ব্যবস্থা) আর বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদ। এটি লেখনীর মাধ্যমে রোকেয়ার এক নীরব বিপ্লব।

মোহিত লাল মজুমদার রোকেয়ার জীবনী পড়ে তাঁর যে পরিচয় পেয়েছিলেন তা হলো; (১) তিনি বাঙালি মুসলিম সমাজের আত্মা ও বিবেকবুদ্ধি; (২) সমসাময়িক বাঙালি হিন্দু নারীদের থেকে রোকেয়া প্রাগসর; (৩) তিনি ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন একাধারে একজন লেখক ও সমাজকর্মী। তাঁর লেখালেখি, স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং নারী সংগঠন পরিচালনা, সমস্ত কাজই ছিল অনন্য। নারী জাগরণের মতো একটা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞে ঝাঁপ দিয়েছিলেন।

লেখক : সাহিত্যিক; সাবেক অধ্যক্ষ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে বিশ্বজয়ী হাফেজ তাকরিম : জান্নাতি সূরের মূর্ছনা
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা