আজ রাজার মন খারাপ।
সকাল থেকে গোঁ ধরে বসে আছে। কিছুই বলছে না। তিন নম্বর বেডের রোগী কত করে ডাকছে। কাকুতি মিনতি করছে। বার বার বলছে, আইজ আমাগো রাজার কি হইলো। গোস্সা করছে ক্যান। অ’ রাজা, ভাই আমার, আমারে একটু ধইর্যা রইদে বসাইয়া দে। বেলা দশটা বাজে। পোলাডা আইজও আইল না। বয়স হইছে। পোলার সংসার বাড়ছে। অহন আর বুড়া মায়ের খবর কেডা লয়। অ নানু ভাই, আমার রাজা। তরে একখান আপেল খাইতে দিমুু। আমারে একটু ধইর্যা খালি রইদে বসাইয়া দিবি।
রাজা তেমনি নিশ্চুপ। দুই নাম্বার ওয়ার্ডের গেইটে গেইটম্যানের ছোট কাঠের টুলে বসে আছে রাজা। দু’মাস ধরে সীতাকুন্ড হাসপাতালের প্রতিটা রোগী রাজাকে দেখে আসছে। আজ হঠাৎ রাজার কি হলো। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। ছোট রাজা। দশ বছর বয়স। নাদুস নুদুস গোল গাল চেহারা। সারা মুখে দুষ্টুমি খেলা করছে। মায়া ভরা একখানি নিষ্পাপ মুখ। দু’হাতে চোখ মুছে দ্রুত তিন নম্বর বেডের রোগীর মাথার পাশে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, তোমারে না ডাক্তারে কইছে পা নাড়াইতে পারবা না। আমি ধইর্যা নিয়া গেলে ডাক্তার আমারে বাইর কইর্যা দিবো। হেইয়া তুমি বুঝ না।
– তর আইজ কি হইছে ভাই। তর মন খারাপ ক্যান।
– মায়ের কথা মনে পড়ছে।
– এমন পোড়াকপাইল্যা বাপ। এতদিনে পোলাডার একটা খবরও নিতে আইল না।
এদিকে সাত নাম্বার বেডের মফিজ ছেলেটা প্রচন্ড যন্ত্র্তনায় ছটফট করছে। রাজা দ্রুত দৌড়ে নার্স রুমে গেল। নার্স নেই। তিন নম্বর ওয়ার্ডে আছে। রাজা ছুটছে সেই ওয়ার্ডে। পেছন থেকে এপ্রোন ধরে টেনে বলল, আপা তাড়াতাড়ি চলেন। সাত নাম্বার বেডের মফিজ ভাই কেমন করতাছে। বড় ডাক্তার সাব অহনও আসে নাই। আপনে তাড়াতাড়ি যান। আমি ডাক্তার সাবরে ডাইক্যা আনতাছি। তারপর ছুটল ডাক্তারের কোয়ার্টারের দিকে।
মফিজ যখন ভর্তি হয় রাজা তখন অনেকটা সুস্থ। গাড়ীর হেলপার। চৌদ্দ পনের বছর বয়স। হরতাল অবরোধের সময় পেট্্েরাল বোমা মেরে গাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছে। তারপর আর কিছুই মনে করতে পারছে না। চার পাঁচদিন পর কিছুটা সুস্থ হয়ে দেখল রাজাকে। পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আর বলছে মফিজ ভাই, ভয় পায়েন না। এখানে সবাই খুব ভালা। আপনে তাড়াতাড়ি ভালা হইয়া যাইবেন। আর তখন মফিজের দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছিল।
এখানে রাজার আপনজন কেউ নেই। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, আয়া, কর্মকর্তা কর্মচারী এমনকি প্রত্যেকটা রোগীই রাজার আপনজন। ভর্তির পর থেকে এরাই রাজাকে মায়া মমতা ভালোবাসা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছে। তিন তিনবার হাসাপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিয়েছে। কোথায় যাবে রাজা। ওকে আজ অব্দি কেউ নিতে আসেনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাজাকে একা ছাড়েনি। এই বয়সে এতটুকুন একটা ছেলে কোথায় যাবে। এখানে রাজার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা। অবারিত স্নেহ মমতা। একজন শিশুর জন্য এই ভালোবাসার আশ্রয় স্বর্গের চেয়েও অনেক সুন্দর।
রাজাকে মুমুর্ষ অবস্থায় কুড়িয়ে পাওয়া তসলিমউদ্দীনও নিতে এসেছিল। রাজার এক কথা, আমি হাসপাতাল ছাইড়্যা কোথাও যামু না। রাজা ভাবে, আমি চইল্যা গেলে এই রোগীগুলানরে কেডা দেইখবো। অনেকের কেউ নেই। সারাক্ষন রাজা রাজা বলে ডাকে। একটু ধরে বসিয়ে দেওয়ার জন্য। একটু খাবার খাইয়ে দেওয়ার জন্য। তাদের জন্য রাজার মন কেমন করে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিটা রোগীর পাশে গিয়ে খোঁজ খবর নেওয়া রাজার নিত্যদিনের কাজ। হাসি খুশী আর দুষ্টুমিতে সারা হাসপাতাল মাতিয়ে রেখেছে। রোগীরা রাজাকে কাছে পেয়ে সুস্থ বোধ করে। কষ্টের কথা ভূলে যায়। রাজার খাওয়া পড়ার কষ্ট নেই। রোগীরা না খেয়ে রাজাকে খাওয়ায়। রাজা ওতেই খুশী।
রাজার বাড়ীর কথা খুব মনে পড়ছে। কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল থানার করমছি গ্রামে তার বাড়ী। রাজার বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে। বাবা হেলাল মিয়া দিনমজুর। মা ঢাকায় ঝি–এর কাজ করে। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। আদরের রাজা। অথচ রাজার খোঁজ নিতে কেউ আসে না। বাবার নাম মনে করতে পারছে। ঠিকানা মনে করতে পারছে না।
বাবার সাথে ঢাকা থেকে রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম আসছিল রাজা। এই প্রথম রাজা ট্রেনে চড়ছে। মায়ের সাথে দেখা করেছে ঢাকায়। মা লুকিয়ে রাজার হাতে দশটা টাকা গুঁজে দিয়ে বলেছিল পথে ক্ষুধা লাগলে কিছু খাইয়া লবি। রাজা কিছু খায়নি। চট্টগ্রাম গিয়ে খাবে। খুব যত্ন করে টাকাটা প্যান্টের পকেটে লুকিয়ে রেখেছে। যাতে কোনভাবে হারিয়ে না যায়।
টি টি–কে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কোনভাবে দরজার সামনে বাবার কোলে বসে আছে রাজা। তাতেও কষ্ট নেই। বাইরে সুন্দর জোৎস্নার আলো। ঝিক ঝিক ঝিক ট্রেন ছুটছে তো ছুটছে। রাজা তাকিয়ে আছে বাইরে। ঠাণ্ডাও লাগছে। গরম কাপড় চোপড়ও নেই।
হঠাৎ করে ট্রেনে হৈ চৈ চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হলো। অনেকে কাঁদছে। একদল দুবৃত্ত ট্রেনে হামলা করেছে। প্রেট্রোল বোমা মারার হুমকি দিচ্ছে। রাজা এসব শুনেছে। ইদানীং গাড়ীতে পেট্রোল বোমা মেরে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মানুষ মারছে। রেলের স্লিপার খুলে মানুষ হত্যা করছে। একজন দুবৃত্ত দরজার পাশে বসে থাকা হালিম মিয়াকে সজোরে লাথি মেরে সরিয়ে দিতেই রাজা প্রতিবাদ করে উঠল। আমার বাবারে মাইরেন না। বাবায় কোন দোষ করে নাই। রাজা পা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল। এতটুকু মাছুম বাচ্চার ফরিয়াদ ওদের কান পর্যন্ত পৌছায়নি। গাড়ী চলছে। জোড় বটতল এলাকায় রাজাকে চলন্ত গাড়ী থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে দুবৃত্তরা। পরদিন স্থানীয় তসলিম উদ্দীন রাজাকে মুমুর্ষ অবস্থায় সীতাকুন্ড স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দেয়।
রাজার এখন সব কথা মনে পড়ছে। আর মনে পড়লেই তার মন খারাপ হয়। মনটাকে হালকা করার জন্য সে হাসাপাতালে সবার ভালোবাসার উঠোনে সারাক্ষণ বিচরণ করে। মাঝে মধ্যে হাসপাতালের খোলা মাঠে দাড়িয়ে চট্টগ্রামের দিকে চলে যাওয়া সোজা বড় রাস্তাটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। এই বুঝি বাবা এসে রাজাকে নিয়ে যাবে। কোনটা থামে। আবার কোনটা থামে না। এখানে যারা নামে তাদের মধ্যে রাজার বাবা নেই। রাজা ভাবে, বাবা নিশ্চয় একদিন আসবে। যতদিন না আসে আমি এই হাসপাতাল ছেড়ে কোথাও যাবো না।