১৯৯০ সালে আমি ইংল্যান্ড থেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং–এর প্রফেশানাল পরীক্ষা পাশ করে সেকেন্ড–ইঞ্জিনিয়ার সার্টিফিকেট পেয়ে গেলাম। প্রায় দশমাস সেখানে থেকে নিজখরচে পড়ালেখা করতে গিয়ে পকেট ফাঁকা। দেশে ফিরে আবারো সময় নষ্ট করার চাইতে, ইংল্যান্ড থেকেই চাকরীর চেষ্টা করছিলাম। পড়ালেখা করেছিলাম উত্তর–ইংল্যান্ডের নিউক্যাস্লের কাছে সাউথশীল্ড্স্ শহরে। পরীক্ষা শেষে, লিভারপুলে চাচার বাসায় চাচা–চাচীর আদরে আরাম–আয়েসে দিন কাটাচ্ছিলাম একদম রাজপুত্রের মতই। তবে লেখাটার নাম কিন্তু সেই কারণে দেই নাই; যদিও সেখানে আসলেই রাজপুত্রের হালে ছিলাম চাচীর হাতের মজাদার রান্না আর দিনশেষে চাচার সঙ্গে অতীতের স্মৃতি–রোমন্থন।
চাচার বাসায় থেকেই এপ্লাই–ইন্টারভিউ করে, জুলাইতে একটা চাকরী হলো। ’৯০ সালে তো ড়ড়স মিটিং বা ই–মেইল ছিলো না। খুবই জরুরী হলে হয়তো, পয়সা খরচ করে ফ্যাক্স করতাম। আর তা না হলে সবই ছিলো কাগজের চিঠিতে এপ্লিকেশান। ইংল্যান্ডের ‘রয়েল–মেইল’ ছিলো খুবই টাইম–এফিসিয়েন্ট। দিনে দুইবার মেইল ডেলিভারি দিতো। মাঝে মাঝে দিনের চিঠি একইদিনে অন্য শহরে পৌঁছে দিতো। যাই হোক, আমাকে সেই কোম্পানিটা একদিনের সফরেই লন্ডনের অফিসে নিয়ে গিয়ে, ইন্টারভিউ নিয়ে, আবারো সন্ধ্যার ফ্লাইটে ফেরৎ পাঠালো। সব টিকিটই ফোনের মাধ্যমে আমার নামে করে দিয়েছিলো, আমি শুধু এয়ারপোর্টে একটা আইডি (পাসপোর্ট) নিয়ে হাজির হয়েছিলাম মাত্র। নব্বইয়ের দশকে কাগজের টিকিটের যুগে, সেটাই একটা তাক লাগানোর মত ব্যাপার। আরো তাক লেগেছিলো, সেবারই প্রথম সেলফোন দেখলাম। কোম্পানীর মালিক আমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করলেন নিজ গাড়ি নিয়ে। বিশাল বড় ও বেঢপ (১০ইঞ্চি লম্বা) সেলফোন, গাড়ির মেঝেতে পায়ের কাছে রেখেছিলো, মনে আছে। আমার চাচা পেশায় ডাক্তার, প্রায় তিরিশ–পঁয়ত্রিশ বছর সেদেশে বসবাস করছেন; কিন্তু ভীষণ সহজসরল, সাদাসিধে মানুষ ছিলেন। তিনি আমার এরকম ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া–আসার পদ্ধতি দেখে হতবাক। আবারো, দুইদিন পরেই যখন আমাকে সিলেক্ট করে বললো, অ্যামেরিকায়, টেক্সাসে হিউস্টনে যেতে হবে, তখন চাচা–চাচী দুজনেই আকাশ থেকে পড়লেন। আমার সেই রাজার হালে বসে বসে থাকার দিন প্রায় শেষ হয়ে এলো আরকি।
কোম্পানী, আরো একবার আমাকে লিভারপুল–লন্ডন ঘুরিয়ে আনলো, অ্যামেরিকার ভিসা করানোর জন্যে। আমি আবার এদিকে, একদিনের ঝটিকা সফরে লিভারপুল থেকে বার্মিংহ্যামে আমার ডাক্তার ভাই–ভাবীর সঙ্গেও দেখা করে আসলাম। ওনাদের বাসা থেকে সঙ্গে এনেছিলাম চাচার জন্যে ডলি খালার (শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফি)-র বই “স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিনগুলো”। লিভারপুলের ফিরতি ট্রেনে বইটা শুরু করলেও, শেষ করতে পারি নাই। চাচার বাসায় পৌঁছেও পড়েই চলেছি। আমার ফ্লাইট, ভোররাতে ম্যানচেস্টার থেকে। সারারাত জেগে খালার বই পড়ে শেষ করে, ঘন্টাখানেক মাত্র ঘুমিয়েই ভোর চারটায় বের হয়ে গেলাম। চাচা অনেক কষ্ট করে আমাকে সেদিন তুমুল ঝড়বৃষ্টির মাঝে ড্রাইভ করে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়েছিলেন। উনি আমাকে নিজের ছেলের মতই স্নেহ–যত্ন করতেন। সেদিন সেই ভোররাতে, ঝড়বৃষ্টিতে গাড়ি চালিয়ে মোটরওয়ে (অ্যামেরিকান ভাষায় হাইওয়ে) দিয়ে যেতে যেতে উনি অনেক ইমোশানাল হয়ে পড়েন। আমারো খুব খারাপ লাগছিলো, চাচা–চাচীকে ফেলে যেতে।
ম্যানচেস্টার থেকে হিউস্টনে নামার পরে, এয়ারপোর্টে আমাকে শিপিং কোম্পানীর এজেন্ট রিসিভ করে, ঘন্টাখানেক ড্রাইভ করে গালফ অফ মেক্সিকোর পাড়ে, রিসোর্ট শহর গ্যালভেস্টন (এধষাবংঃড়হ)-এ একটা হোটেলে তুলে দিলো। যাত্রার ধকল কাটিয়ে, বিশ্রাম নিয়ে, জীবনে প্রথমবারের মত অ্যামেরিকার মাটিতে ঘুরে বেড়ালাম। অ্যামেরিকার প্রতিটা শহরেই আমোদ–ফূর্তি, মজা করার সব ধরনেরই ব্যবস্থা রয়েছে সব বয়সেরই জন্যে, সব ধরনের রুচির জন্যেই। সেটা ছোট্ট গ্রাম বা শহর হোক; অথবা বিশাল মেট্রোপলিটান হোক আপনি আপনার পছন্দমাফিক বিনোদনের ব্যবস্থা পাবেনই। আর গ্যাল্েভস্টন তো রিসোর্ট শহর সেখানের আকাশে–বাতাসে প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই খুশীর আমেজ। কিন্তু, সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে টিভির নিউজে চোখ আটকে গেলো বন্দরে প্রবেশের চ্যানেলে একটা জাহাজ বিকল হয়ে চড়ায় আটকে সকলের পথ বন্ধ করে বসে আছে, লে ঠ্যালা! অন্য কোনো জাহাজই ঢুকতে বা বের হতে পারছে না। সেটা টাগ দিয়ে ছাড়তে বেশ কয়েকদিন লাগতে পারে। আমার তো কোনো দুশ্চিন্তা নেই কোম্পানীর পয়সায় খাচ্ছি–দাচ্ছি, হোটেলে দিন কাটাচ্ছি, শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আবার অন্যদিকে আমার বেতনের মিটার ঠিকই ঘুরছে। কোম্পানীর নিয়ম অনুযায়ী, হোমবেস্ থেকে রওনা দেওয়ার প্রথমদিন থেকেই, বেতন শুরু। সুতরাং, আমি তো চাইবোই যে, সেই জাহাজটা মাসের পর মাস, বা বছরখানেক চড়ায় আটকে থাকুক। নাহ্, সেরকম চাওয়াটা আসলে মন থেকে আসে না। প্রথমতঃ অন্যের বিপদ বা কষ্ট, সেটা বুঝতে হবে। দ্বিতীয়তঃ কতদিন আর কাজকর্ম ছাড়া এরকম হোটেলে বসে বসে অলস সময় কাটানো যায়? পঁচিশ/ছাব্বিশ বছর বয়সে, বেকার বসে থেকে শুধু শুধু টাকা নিতে ইচ্ছা করে না; আর আমরা মেরিনাররা জাহাজের গন্ধ পেলে, সমুদ্রের গন্ধ পেলে বাসায় বা হোটেলে বা ডাঙ্গায়–মাটিতে টিকতে পারি না। মন চায় সমুদ্রে দোল খাই, শরীরে লোনা জলের ঝাপটা আর মুখে লাগুক লোনা বাতাস।
যাক, চার–পাঁচদিন পরে চ্যানেল খুললো; প্রথমে ভিতরে আটকে পড়া বন্দরের জাহাজগুলোকে বের করা হলো, তারপরে বাইরের জাহাজগুলো একে একে ঢুকলো। হিসাবমতে, এজেন্ট আমাকে সময় বলে রেখেছিলো। আমি তৈরী ছিলাম, সে জুলাইয়ের ২৬ তারিখে আমাকে জাহাজে তুলে দিলো। নরওয়ে–র রেজিস্টার্ড তেলের ট্যাঙ্কার, নাম এম টি ইয়াহ্রে প্রিন্স (গ.ঞ. ঔধযৎব চৎরহপব)। বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায় রাজপুত্রের দিন বা রাজপুত্রের যুগ। গ.ঞ. মানে মোটর ট্যাঙ্কার। ঝকঝকে নতুন এটা, মাত্র এক বা দুই বছর বয়স সেই যুগের সব মডার্ন টেকনোলোজিই সেটায় ছিলো। তেলের ট্যাঙ্কার, তাই তেলের বন্দরগুলোতেই যাবে সেটাই স্বাভাবিক। টেক্সাস তো তেলের খনি। আমরা টেক্সাসের গ্যালভেস্টন, কর্পাস–ক্রিস্টি থেকে তেল বোঝাই করে নিয়ে, ইউরোপের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
জাহাজে অধিকাংশ অফিসার এবং ক্রু ইন্ডিয়ার। দুই একজন আমরা অন্যদেশের আমি বাংলাদেশী, কয়েকজন ফিলিপিনো, একজন পাকিস্তানী, একজন যুগোস্লাভিয়ার। ভালই দিন কেটেছিলো আমাদের। তখনো কম্পিউটার–ইন্টারনেটের যুগ শুরু হয়নাই। সমুদ্রে যখন দিনের পর দিন ভাসতে হতো, তখন আমরা জাহাজে একটা না একটা উছিলা খুঁজে নিয়ে পার্টি করতাম। গান–বাজনা, খাওয়াদাওয়া, বার্বিকিউ, হৈ–হুল্লোড়, খেলাধুলা করতাম।
কিছুদিন আগে বারমুডা ট্রায়াংগেল নিয়ে লিখেছিলাম। চলুন, এবার একটু ম্যাপ খুলে দেখি। টেক্সাস (হিউস্টন বা কর্পাস–ক্রিস্টি) থেকে কোনো জাহাজ যদি ইউরোপের দিকে রওনা দেয়, তাহলে গালফ অফ মেক্সিকো পার হয়ে, কিউবার উপর দিয়ে মায়ামি আর বাহামার মাঝ দিয়ে গিয়ে বারমুডা ট্রায়াংগেলে পড়বেই। কাল্পনিক এই বারমুডা ট্রায়াংগেলটাকে বারমুডা–মায়ামি–পুয়ের্টোরিকো এই তিনটা পয়েন্ট যোগ দিয়ে ত্রিভুজ বানিয়ে দেখানো হয়। বিশ্বের অন্যান্য সমুদ্রপথের মতই, এটা কখনো শান্ত থাকে, আবার কখনো থাকে ভীষণ উত্তাল। অন্য সমুদ্রের মতই এখানেও জাহাজডুবি বা অন্যান্য দুর্ঘটনা ঘটে; কিন্তু সেগুলো দুঃখজনক হলেও, সবই স্বাভাবিক। রহস্যময় বা অলৌকিক কোনকিছুই সেখানে নেই। আমরা মেরিনাররা বলতে পারবো, বারমুডা ট্রায়াংগেল সম্পর্কিত ভৌতিক গল্প–ডকুমেন্টারি–ম্যুভি সবই বানোয়াট। চাইলে, দুনিয়ার অন্য জায়গার সমুদ্রপথ নিয়ে হয়তো এর চাইতেও ভয়ঙ্কর ঘটনা লেখা সম্ভব। সাউথ চায়না সী, বে অফ বিস্কে, কেইপ ইত্যাদি। যেহেতু এটা অ্যামেরিকার কাছাকাছি, লাগোয়া; এবং তাদের হলিউডের সিনামার জন্যে মাল–মশল্লা লাগবে। তাই তারা অল্প–সত্য কিছু ঘটনার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে ছাপিয়ে দিলো; আর দর্শক–শ্রোতাও সেগুলো গিলে নিলো।
যাক, আবারো আমার জাহাজ ইয়াহ্রে প্রিন্সে ফিরে আসি। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে, জার্মানীর হামবুর্গ, নেদারল্যান্ডের এমস্টার্ড্যাম, রটারড্যাম ঘুরে, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন গেলাম। সেখান থেকে ফিরতি পথে আবারো রওনা দিলাম টেক্সাসের উদ্দেশ্যে। দুর্ভাগ্যবশতঃ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে অ্যামেরিকার উপকূলের কাছাকাছি এসে, আমি একটা দুর্ঘটনায় পড়লাম। জাহাজে ফার্স্ট–এইড এবং অল্পকিছুটা চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও, আমার শরীরের অবস্থার কথা চিন্তা করে জাহাজ ঘুরিয়ে, সবচেয়ে কাছের বন্দর ভার্জিনিয়ার নিউপোর্ট নিউজের হাসপাতালে আমাকে স্থানান্তরিত করা হলো। পরবর্তীতে এই দুর্ঘটনা নিয়ে লিখবো। রাজপুত্রের যুগে (বা, এম টি ইয়াহ্রে প্রিন্স জাহাজে) আমার মাত্র দুই কি তিন মাস সময় কেটেছিলো। নিউপোর্ট নিউজের রিভারসাইড হাসপাতালে গিয়েছিলাম ১৯৯০–এর অক্টোবারের ১০ তারিখ।
টলিডো, ওহাইও, ২০২৩
refayet@yahoo.com