রক্তাক্ত পঁচাত্তর : কমিশন অত:পর ট্রুথ কমিশন

শঙ্কর প্রসাদ দে | রবিবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ

সাবেক প্রধান বিচারপতি বাবু এস কে সিন্‌হার মতে, নথি দেখে তাঁর মনে হয়েছে প্রকৃত অপরাধী অনেকেই বিচারের বাইরে থেকে গেছে। অনেক খুনী পার পেয়ে গেছে সময়, ক্ষমতা ও সমাজের প্রতিরোধের মুখে। পরবর্তী প্রজন্ম আজি হতে শত শত বর্ষ পরে কল্পনাও করতে পারবে না বিভীষিকাময় দিনগুলো। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিজয় এলো। তাজউদ্দীন সাহেব ২২ ডিসেম্বর এসেই পাকিস্তানী প্রশাসন এবং সামরিক আমলাতন্ত্র পুনর্বহাল করলেন। ১২ জানুয়ারি ১৯৭২, বঙ্গবন্ধু ও পুরনো সিভিল ও সামরিক কাঠামো নিয়ে এগোলেন। সর্বনাশের শুরু এখান থেকে।
সামরিক কর্তারা ভাবলেন তাঁরাই দেশ স্বাধীন করেছেন আর রাজনৈতিক নেতারা প্রবাসী সরকারের নামে অনেকটা ঝুঁকিহীন অবস্থানে ছিলেন। আমরা কেউ’ই সেনাকর্তাদের এই মনোভাবকে পাত্তা দেইনি। বঙ্গবন্ধু এদেরকে নিজের সন্তান জ্ঞান করতেন। তিনি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেননি। পাকিস্তান সৃষ্টির দ্বিতীয় ব্যক্তি ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে সামরিক বাহিনীই হত্যা করেছে। সেনাপ্রধান আইয়ুব খান নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের গুতা দিয়ে বের করে দিলেন। নিজেকে ঘোষণা করলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে জিয়া সেনাপ্রধান হতেন না। ২৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র ৯ দিনের ব্যবধানে সেনাপ্রধান হয়েই জিয়া ক্ষমতার প্রকৃত মালিক হলেন। পরবর্তীতে বিচারপতি সায়েমকে বন্দুকের গুতায় বঙ্গভবন থেকে বের করে দিয়ে নিজেকে ঘোষণা করলেন প্রেসিডেন্ট। হুবহু পাকিস্তানী মডেলে আইয়ুবের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জিয়ার বঙ্গভবন দখল রূপকথাকেও হার মানায়। লিয়াকত আলী খান হত্যার বিচার হয়নি। কারণ গত ৭০ বছরে পাকিস্তান রাষ্ট্রে সময়, ক্ষমতা ও সমাজের নিয়ন্ত্রণ ছিল সামরিক বাহিনীর হাতে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতা নেয়ার মুহূর্তে সময়, ক্ষমতা ও সমাজ বিচারের পক্ষে ছিল না। রূঢ় হলেও এটি সত্য। পঁচাত্তরের পর যে শিশু জন্ম নিয়েছিল তারা জানত না, বঙ্গবন্ধু নামে কেউ এদেশে জন্মেছিল বা জাতির পিতা ছিল। এই রাষ্ট্রের অন্যতম শক্তিকেন্দ্র সামরিক বাহিনী। তখন উচুস্তরে যারা ছিলেন তাঁদের অনেকেই রক্তাক্ত পঁচাত্তর না হলে অতো উপরে উঠতে পারতেন না। ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোকে উত্ত্যক্ত করে বিচার দূরের কথা ক্ষমতায় টিকে থাকাও ছিল কষ্টসাধ্য। মনে রাখতে হবে ১৯৯৬ সালের ৭ম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ পেয়েছিল ১৪৬ আসন। আ স ম রবের তো এরশাদী মোসাহেব সহ ৫টি ভোট ধার করে সরকার গঠন করতে হয়েছিল। একাত্তরের পরাজিতরা, খুনীরা, ষড়যন্ত্রকারীরা, মৌলবাদ সমাজে ছড়িয়ে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্ত চিন্তার বিরুদ্ধে রাশি রাশি ঘৃণা। শেখ হাসিনার সময়, ক্ষমতা ও সমাজের এই প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা, হিমালয় অতিক্রম করাকেও হার মানায়। গোটা দেশে কানাঘুষা চলছিল মামলা করলে কি হবে, এ বিচার কোন দিন শেষ হবে না। ফারুককে যে দিন গ্রেফতার করা হয় সেদিন অনেকেই অবাক হয়ে বলেছিল শেখ হাসিনা বড় দু:সাহসী হয়ে উঠেছেন। এসব অশুভ ইঙ্গিত ছিল। ২১ আগষ্ট ২০০৪ শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলার এটাই ছিল প্রকৃত কারণ। বেগম জিয়া বিচার প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিয়েছিলেন হাইকোর্টে। পাকিস্তানী আদর্শ, মৌলবাদ ও মুক্তিযুদ্ধকে চিরতরে পরাস্ত করতে হলে শেখ হাসিনাকে চিরতরে বিদায় করার দরকার ছিল।
আসলে সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত যাদের মৃত্যুদন্ড বহাল ও কার্যকর হয়েছে তারা ছাড়াও আরো বহুজনের মৃত্যুদন্ড হওয়া উচিত ছিল। এর বাইরে রয়ে গেছে একঝাক ষড়যন্ত্রকারী, পটভূমি রচনাকারী, বিদেশের সাথে সংযোগকারী আন্তর্জাতিক চক্র। যেমন ধরুন লিবিয়ার নৈতিক সমর্থন না থাকলে লিবিয়া খুনীদের নিরাপদ আস্তানা হতো না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে আমেরিকার নৈতিক সমর্থন ছিল বলেই আজো খুনী রাশেদ দিব্যি ঘুরে বেড়াতে পারছে। বিশাল এক ক্যানভাসে মঞ্চস্থ হয়েছে পৃথিবীর নৃশংসতম এক হত্যালীলা। ফ্রাঙ্কফুট ওডার থেকে বার্লিন ফেরার পথে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আলাপচারিতায় বলেছিল, তিনি বাংলাদেশীদের ঘৃণা করেন কারণ শেখ মুজিবের মতো এক অসাধারণ মানুষকে তারা হত্যা করেছে। তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর। লজ্জায় মাথা নীচু করা ছাড়া আমার উপায় ছিল না।
মহাভারতের হত্যাযজ্ঞ থেকে শুরু করে আলেন্দে হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত সমস্ত ঘটনাগুলো তুলনা করে দেখলাম, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সাথে তুলনীয় কোন জঘন্য ঘটনা মানব ইতিহাসে ঘটেনি। সেইসব ষড়যন্ত্রকারী, পটভূমি, রচনাকারী ও বিদেশী শত্রুরা কি ইতিহাসের বিচার এড়িয়ে যাবে দোর্দন্ড প্রতাপে? বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড উদ্‌ঘাটনে কমিশন বাঙালি জাতিসত্তা, সভ্যতা ও প্রগতির স্বার্থে অপরিহার্য্য অনিবার্য। মহাত্মা গান্ধীকে হত্যাকারী শিবসেনা সমর্থক আইনজীবী নাথুরাম গডসেকে ফাঁসী দেয়া হলেও তার আদর্শকে মোকাবেলা করা হয়নি। সেদিন নাথুরামের রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিভূমি, ষড়যন্ত্র, পটভূমি চিহ্নিত করা গেলে ভারতবর্ষে শিবসেনা, রাষ্ট্রীয় সেবকসংঘ ও বিজেপি দিল্লী দখল করতে পারতোনা। তেমনি ১৫ আগস্ট হত্যাকারীদের রাজনৈতিক আদর্শ, পটভূমি রচনাকারীদের আদর্শ ও মৌলবাদকে চিহ্নিত করা না গেলে ভবিষ্যৎ কখনোই ঝুঁকিমুক্ত হবে না। কমিশন গঠনের এটাই সর্বোত্তম সময়। সময় ও স্রোত কাহারো জন্য অপেক্ষা করে না। এরপরে কথা উঠবে কমিশনের শেষ পরিণতি কি? কি উদঘাটন করতে চায় কমিশন? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য কমিশন ব্যবহৃত হবে না তো? প্রশ্নগুলোর যৌক্তিকতা আছে। আবার এসব প্রশ্ন উত্থাপন করে কমিশন গঠন কে ঠেকানোর অপচেষ্টা নেয়া হবে না তো? এসব প্রশ্ন যত বেশী উত্থাপিত হবে ততই যৌক্তিক পরিণতির দিকে ধাবিত হবে রক্তাক্ত পঁচাত্তরের রহস্য উন্মোচন।
পৃথিবীব্যাপী একটি জনপ্রিয় ধারণার নাম ট্রুথ কমিশন। নেলসন ম্যান্ডেলা ক্ষমতা নিয়েই ইতিহাসের সত্য উন্মোচনে গঠন করেছিলেন ট্রুথ কমিশন। হাজার হাজার হৃদয় বিদারক ঘটনা উঠে আসল অবলীলায়। বেশীর ভাগ অপরাধ সংঘটিত করেছিল শ্বেতাঙ্গরা। সত্য স্বীকার করায় অপরাধীরা ক্ষমা পেয়েছিল রাষ্ট্রের কাছে। তবে ক্ষমা পায়নি ভুক্তভোগী আর ইতিহাসের কাছে। এটাই সভ্যতার লাভ।
কমিশন বা ট্রুথ কমিশন যেটাই হোক, রক্তক্ত পঁচাত্তরের সত্য ঘটনা আসুক দিনের আলোয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র অনেককে ক্ষমা করার সুযোগ পাবে। প্রদর্শিত ক্ষমায় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের বিদেহী আত্মাও শান্তি পাবে। লাভবান হবে বাঙালি জাতিসত্তা, সভ্যতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ। আমার বিশ্বাস মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে হলে আমাদের আরো বহুপথ অতিক্রম করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট; আইনজীবী হাইকোর্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধবাংলার রুমি সৈয়দ আহমদুল হক