যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ধারণা এখনো স্বচ্ছ নয়। সমাজে এখনো কিছু বিষয়কে দুষ্টুমি, মজা করা ইত্যাদির ছাঁচে ফেলে যৌন নিপীড়নকে হাল্কাভাবে দেখে ও উদাসীন থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রে প্রথম যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতা পরিবার, প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের দ্বারা হয়ে থাকে। যা আমাদের উদাসীনতাকে চিহ্নিত করে। কারণ পরিবার তথা সমাজ শিশুকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে না ভেবে তাকে ছোট, অবুঝ ইত্যাদি ভেবে তাদের মতামত ও বিরুদ্ধতাকে মূল্যায়ন করতে চায় না। এমনকি অনেক সময় শিশুদের ইচ্ছে–অনিচ্ছে, মতামতকে প্রবলভাবে অগ্রাহ্য করা হয় কেবল তারা ছোট বলে। ফলে অধিকাংশ শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েও কেবল বড়দের মত প্রকাশ করতে না পারা, তাদের অগ্রাহ্যতা, ভয়, সংকোচ এবং নিজেকেই দোষী সাব্যস্ত হবার শঙ্কায় চেপে যায়। শুধু তা–ই নয়, এই ধরনের ঘটনাকে লোকসমাজের ভয়, বদনাম রটা ইত্যাদি বলে গোপন রাখা হয়। সেক্ষেত্রে অপরাধী যেমন পার পেয়ে যায়, তেমনি বড় হতে থাকা শিশুটিও একটা ট্রমার ভেতরে বড় হতে হতে আত্মীয়স্বজন ও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভীতি ও অশ্রদ্ধা নিয়ে বেড়ে ওঠে। যেটা পরবর্তীতে মানসিক বৈকল্য তৈরি করে। আবার অনেকক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ জানে না, ধর্ষণ না হলেও এই ধরনের যৌন নিপীড়নের প্রতিকার আদৌ আছে কি না। সচেতনতার অভাবে, কখনো আইন না জানা ও প্রতিকার না পাবার আশঙ্কায় আইনের দ্বারস্থ হয় না।
একইভাবে, ভিড় বাসে, হাটে–বাজারে, পথ চলতে কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতা হয়নি এমনটা বিরল।
দেশে বিভিন্ন সময় নারী ও কিশোরীদের রাস্তাঘাট, স্কুল–কলেজ থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রেও উত্ত্যক্তের শিকার হতে হচ্ছে। উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে অনেক মেয়ের। অনেকে বেছে নিয়েছে আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথ।
আপনি যদি যৌন কামনা চরিতার্থ করার জন্য কোন নারীর উপর বলপ্রয়োগ করেন বা কোন অঙ্গ স্পর্শ করেন বা ইচ্ছাকৃতভাবে আপনি নিজের যৌনাঙ্গ প্রদর্শন করেন বা কোন বস্তু দ্বারা যৌন অঙ্গ স্পর্শ করেন তাহলে আপনি যৌন নিপীড়নের অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন। আমাদের সামাজিক রীতিনীতি কিংবা আচার–আচরণের সঙ্গে মানানসই নয়, এমন যে–কোনো ব্যবহার বা আচরণই অশালীন আচরণ।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ৩৪ অনুচ্ছেদ এ বলা হয়েছে ‘‘অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ সকল প্রকার যৌন নিপীড়ন এবং যৌন নির্যাতন থেকে শিশুকে রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকবে। তা প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ জাতীয়, দ্বিপাক্ষিক এবং বহু পাক্ষিক সকল প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে”।
এই অনুচ্ছেদে অশ্লীল যৌন আচরণ বা বিষয়বস্তুতে শিশুদের অপব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে ও পদক্ষেপ নিতে রাষ্ট্রকে আহবান জানানো হয়েছে।
দণ্ডবিধির ৩৫৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, উপরোক্ত অপরাধের শাস্তি দু’ বছরের কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয়বিধ দণ্ড। ৫০৯ ধারায় নারীর প্রতি ইভটিজিং বিষয়ে বলা হয়েছে, সেই ব্যক্তি বিনাশ্রম কারাদন্ডে–যার মেয়াদ এক বৎসর পর্যন্ত হতে পারে বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে। স্কুল কলেজগামী মেয়েদের রাস্তাঘাটে দেখে শীষ দেওয়া, গান গেয়ে উঠা, চোখ বাঁকা করে তাকানোসহ যে কোন অঙ্গভঙ্গি এ ধারার আওতাভুক্ত হবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এর ধারা–১০ এ বলা হয়েছে, উক্ত ব্যক্তি অনধিক ১০ বৎসর কিন্তু অনূন ৩ বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। তবে কোন মহিলার সম্মতি থাকলে এ–ধারায় শাস্তি দেয়া যায় না। (১৯৮২ পিএসসি ৯৬৮)।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ধারা–৯ক এ বলা হয়েছে যে, কোন নারীর সম্মতি ছাড়া বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কোন কার্য দ্বারা সম্ভ্রমহানির প্রত্যক্ষ কারণে কোন নারী আত্মহত্যা করলে তার শাস্তির বিধান এই আইনের ৯ (ক) ধারায় রাখা হয়েছে যা সর্বোচ্চ ১০ বৎসর এবং অন্যূন ৫ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবে।
ঢাকা মহানগরী পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬, ধারা –৭৬ এ বলা হয়েছে, সেই ব্যক্তি এক বৎসর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ড অথবা দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানাদণ্ড অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।
এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ৭৫ ধারায় ‘সর্ব সমাজে অশালীন বা উচ্ছৃঙ্খল আচরণের শাস্তি হিসেবে তিন মাস মেয়াদ পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৫০০ শত টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড’– শাস্তির বিধান আছে।
সুতরাং চাইলেই, যে কেউ যৌন নিপীড়ন করতে পারে না। দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কেউ নিপীড়িত হলে যথাযথ আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়।