যুগস্রষ্টা নজরুল

কুমুদিনী কলি | বুধবার , ২৪ মে, ২০২৩ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

দূরে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ভোরের নামাজের আহবান শোনা যাচ্ছিল-‘আসসালাতু খায়রুম মিনান্নাউমওগো, জাগো। নিদ্রার চেয়ে উপাসনা ঢের ভাল। জাগো! ‘মেজ বৌ দাঁতে দাঁত ঘষে বললে, ‘অনেক ডেকেছি আল্লা, আজ আর তোমায় ডাকব না।’ সেজোর মুখ কিন্তু কী এক অভিনব আলোকোচ্ছ্বাসে আলোকিত হয়ে উঠল। সে প্রাণপণ বলে দুই হাত তুলে মাথায় ঠেকালেমুনাজাত করার মত করে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে গেলকিন্তু তা তখখুনি ছিন্ন লতার মত এলিয়ে পড়ল তার বুকে।’ একদিকে মৃত্যু, আর একদিকে ক্ষুধা। দুটোকেই সমান উপলব্ধি করেছিলেন তিনি, দুটোই সমান নির্মম আচরণ করেছিলো তাঁর সাথে। তিনি প্রতিনিয়ত লড়ে গিয়েছিলেন। লড়ে যাবার জন্যই হয়ত তাঁর পৃথিবীতে আসা। তিনি তাঁর সমান দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন মানবজীবনের এই অধ্যায়টি। ‘মৃত্যুক্ষুধা’ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।

উপন্যাসের এই অংশটি যখন পড়ছিলাম, তখন কাকতালীয়ভাবে সময়টা ছিলো ফজরের নামাজের সময়। আযানের শব্দে আমার ঘোর ভাঙে। তখনও সেজো বৌয়ের মৃত্যু দৃশ্য আমার চোখের সামনে, চোখ ভিজে গেলো।

এমনি কত শত লেখায় তিনি বাঙালির মনে সাহসের সঞ্চার করেছেন। অন্যদিকে প্রেমের হিন্দোল জাগিয়েছেন, বিরহী করেছেন। প্রেম চাইতে এসেছিলেন তিনি, প্রেমের বাণী ছড়িয়ে দিতে এসেছিলেন। যখনই অবহেলিত হয়েছেন, প্রতিবাদী হয়েছেন। প্রেমের বাঁশীর পরিবর্তে তুলে নিয়েছেন রণতূর্য। বিদ্রোহ করেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ছিনিয়ে এনেছেন কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা। তাই প্রেমের কবির তকমা গেছে মুছে, সবাই তাঁকে বিদ্রোহী কবি বলেই চিনেন। তাঁর প্রেম, ভক্তি ঢাকা পড়ে গেলো। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে যে কজনের অস্তিত্ব সগৌরবে প্রকাশিত হয়েছে নিঃসন্দেহে নজরুল ইসলাম তার মধ্যে প্রধান এবং প্রথম। দ্রোহী নজরুল আর প্রেমিক নজরুল, সর্বধর্মের সমন্বয়কারী নজরুল। তিন ধারা মিলেমিশে যেনো একাকার হয়ে গেছে। তিনি বাংলা সাহিত্যকে দেখিয়েছেন নতুন দিগন্তরেখা। তাঁর হাতেই সৃষ্টি হয়েছে যুগান্তকারী সব সাহিত্য। প্রেম, বিরহ, ভক্তি, সুফিবাদ, শ্যামাসংগীত, গজল। কী নেই তাঁর ঝুলিতে। প্রচণ্ড জীবন সংগ্রাম, অস্তিত্বের লড়াই তাঁকে করে তুলেছে অভিনব। তাঁর সাহিত্যেও পড়েছে তাঁর জীবনযাপনের প্রভাব। যিনি বাংলাসাহিত্যকে এনে দিয়েছেন এক অনন্য সাধারণ স্থান। তিনি সকল সামপ্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে ছিলেন, সামপ্রদায়িকতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে একের পর এক শ্যামা সংগীত, কীর্তন, গজল, হামদ, নাত রচনা করে গেছেন। তাঁর রচিত গানে আজও এদেশে ঈদের আবহ আসে, তাঁর রচিত কীর্তনে আজও এদেশের হিন্দুরা প্রার্থনা করে। এমন অসামপ্রদায়িক চেতনা ধারণ করতে পারেন কজনে। তিনি পেরেছিলেন। কারণ তিনি মহান চেতনা ধারণ করতেন। তিনি যুগস্রষ্টা। তিনি গতানুগতিক ধ্যান ধারণার ঊর্ধ্বে বাস করতেন। তিনি স্রষ্টার আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। ক্ষুধা, দারিদ্রকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। আর সেসব তুলে ধরেছেন তাঁর সৃষ্টিতে। সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। প্রেমের পূজারী ছিলেন তিনি। প্রেমের কবিতায় তাঁর সমকক্ষ আর কজন হয়! প্রেমকে তিনি এক অনন্য উচ্চতা দান করেছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি অনন্য এবং অসাধারণ একটা দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। আজ এই মহামানবের জন্মদিন! ভালোবাসা ও নিরন্তর শ্রদ্ধা হে প্রিয়!

পূর্ববর্তী নিবন্ধজিততে চাইলে লড়তে হয় একাই
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে