বাঙালির নববর্ষ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের উৎসবে রাজনৈতিক চেতনা যুক্ত হয় বিগত শতাব্দীর ৬০–এর দশকে, ছায়ানটের মাধ্যমে। আইয়ুব সরকার বাঙালি সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথের ওপর আকস্মিক হামলা চালালে ছায়ানট প্রতিবাদ হিসেবে রবীন্দ্রসংগীতের আয়োজন করেছিল ১৯৬১ সালের পহেলা বৈশাখে। যাত্রায়ও এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল। ’৪৩–এর দুুর্ভিক্ষের সময় শরীয়তপুর জেলার কার্তিকপুরে স্থানীয় চোরাকারবারি ও খাদ্য মজুতদারদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়েছিল যুবশক্তি। এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে ‘যাত্রাপালাসম্রাট’ হিসেবে খ্যাত ব্রজেন্দ্র কুমার দে লিখলেন জাগরণীপালা ‘আকালের দেশ।’ মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৪৪ সালে অর্থাৎ ১৩৫১ বাংলা সনের পহেলা বৈশাখে।
ঐতিহ্যগতভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মধ্য দিয়ে প্রত্যেক যাত্রাদলের অবশ্য পালনীয় কিছু নীতি নিয়ম তৈরি হয়ে গিয়েছিল এক সময়। এ দিনের অনুষ্ঠানের ছক সাজানো হতো এভাবে: কীর্তন ও ভক্তিমূলক গানের আসর, নাট–দেবতার স্তুতি, আরতি প্রতিযোগিতা, শিল্পীদের মিষ্টিমুখ করানো এবং প্রত্যেককে নগদ অর্থ প্রদান। এসব আনুষ্ঠানিকতা হতো যাত্রাদল অধিকারীর পক্ষ থেকে। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী যাত্রা মৌসুম শেষ হয়ে যায় ৩০ চৈত্র। পরদিন পহেলা বৈশাখ থেকে নতুন মৌসুম শুরুর কল্যাণ কামনায় নানা ধরনের ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম চলতে থাকে। আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রার নতুন মৌসুমের ঘন্টা পড়ে শারদীয় দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিনে। সূর্য ওঠার আগে যাত্রাদলে পহেলা বৈশাখ শুরু হয় সমবেত কণ্ঠে ভক্তিমূলক ও দেশাত্মবোধক গানের মধ্য দিয়ে। সূর্যাস্তের পর বসে বৈশাখ নিয়ে গল্পের আসর। তারপর রাতভর চলে ‘হই হই কাণ্ড আর রই রই ব্যাপার’ যাত্রাপালার বাদ্য–বাজনা।
পাকিস্তান আমলে পেশাদার যাত্রাদল ছিল ২৬টি। বর্তমানে শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক নিবন্ধিত যাত্রাদলের সংখ্যা প্রায় ২৬০। যাত্রার যখন সুদিন ছিল সেই সময় প্রত্যেক দলেই ঘটা করে ‘পহেলা বৈশাখ’ পালন করা হতো। এখন যাত্রাদলে পহেলা বৈশাখ পালনে সেই জমজমাট আয়োজন চোখে পড়ে না। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জয়দুর্গা অপেরা, ভোলানাথ অপেরা, ভাগ্যলক্ষ্মী অপেরা, চট্টগ্রামের বাবুল অপেরা এবং সিরাজগঞ্জের বাসন্তী অপেরার উৎসব–অনুষ্ঠানাদি হতো খুব জাঁকজমক সহকারে। স্বাধীনতার পর ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বৈশাখ উৎসবের ঐতিহ্য ধরে রেখেছিল মানিকগঞ্জের নিউ গণেশ অপেরা, চারণিক নাট্যগোষ্ঠী, গোপালগঞ্জের দিপালী অপেরা, ময়মনসিংহের সবুজ অপেরা, যশোরের তুষার এবং এই শ্রেণীর আরো কয়েকটি দল।
বিগত শতাব্দীর ৫০ ও ৬০–এর দশকে পহেলা বৈশাখে এবং বৈশাখ মাসজুড়ে যে পালাগুলো মঞ্চস্থ হতো, তার তালিকা এ রকম: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জয়দুর্গা অপেরার ‘বাগদত্তা’, সিরাজগঞ্জের বাসন্তী অপেরার ‘সোহরাব–রুস্তম’, ময়মনসিংহের নবরঞ্জন অপেরার ‘বাঙালি।’ এগুলো ছিল যুদ্ধবিরোধী ও গণজাগরণমূলক পালা। এর বাইরে ধর্মীয় ও ভক্তিমূলক পালাও মঞ্চস্থ হতো। যেমন– ‘বাবা তারকানাথ’, ‘সাধক রামপ্রসাদ’ ও ‘এজিদ বধ।’ বিষাদ সিন্ধু অবলম্বনে এজিদ বধ পালা মঞ্চে এনেছিল বরিশালের মুসলিম যাত্রা পার্টি। ’৬৯–এ গণঅভ্যুত্থানের সময় চট্টগ্রামের বাবুল অপেরার একটি বিপ্লবী পালা গোটা দেশে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পালার নাম ‘একটি পয়সা।’ পালাটি ১৩৭৬ বাংলা সনের পহেলা বৈশাখে চট্টগ্রামের পটিয়া ক্লাবে পরিবেশিত হয়েছিল। এর একটি সংলাপ: ‘পুঁজিপতি ভগবানদের কাছে আর কোনো আবেদন নয়, প্রার্থনা নয়, মেহনতি মানুষের সংঘশক্তির প্রচন্ড আঘাতে ওদের খুশির অট্টালিকা ভেঙেচুরে কায়েম করতে হবে আমজনতার ন্যায্য অধিকার।’ রাজনৈতিক সংকীর্ণতা, দলাদলি আর জাত্যাভিমানের বাইরে এদেশে একমাত্র পহেলা বৈশাখই সর্বজনীন উৎসবের রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই সাম্য–সম্প্রীতির ঐকতান আমরা শুনি যাত্রাপালায়ও। নবাব সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রের অভিনেতা পহেলা বৈশাখের যাত্রামঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন বলেন, ‘বাংলা শুধু হিন্দুর নয়, শুধু মুসলমানের নয়, মিলিত হিন্দু–মুসলমানের মাতৃভূমি গুলবাগ এই বাংলা’–তখন বিভিন্ন শ্রেণী–গোত্রের দর্শক নিমিষে যেন একাত্ম হয়ে যায়। ‘চন্দ্রশেখর’ যাত্রাপালায় সাম্য–সম্প্রীতির এমন এক সংলাপ দেওয়া হয়েছে, যার সম্নোহনী শক্তি চিরকালের। সেই যাত্রার কাহিনীতে নবাব মীর কাশেমকে নায়ক প্রতাপ বলছেন– ‘জাঁহাপনা এই সেই দেশ যেখানে মুসলমানের মসজিদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে হিন্দুর দেব মন্দির। যেখানে হিন্দুর সন্ধ্যারতির শংখঘন্টার সঙ্গে মুসলমানদের আজানধ্বনি একই সঙ্গে ভেসে ওঠে।’ স্বাধীনতার আগে চন্দ্রশেখর পালাটি প্রায় মঞ্চস্থ হতো বিভিন্ন স্কুল–কলেজের বৈশাখ অনুষ্ঠানে।
পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সঙ্গে এতিহ্যবাহী যাত্রাপালার যে যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল একদা, নানা বৈরী পরিবেশের কারণে অনেকটা তা শিথিল হয়ে পড়েছে। বিগত শতাব্দীর শেষের দিকে আমরা দেখলাম, যাত্রার সোনালী দিনগুলো অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। আলো ঝলমল যাত্রামঞ্চের বাতিগুলো নিভে যাচ্ছে একের পর এক। ১৯৯১–৯২ সালের কথা। হঠাৎ সারা দেশে যাত্রানুষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ জারি হয়। একবার নয় দফায় দফায় ছয়বার। গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয় ঐতিহ্যবাহী যাত্রা। হতাশা–অনিশ্চয়তা আর জীবনের টানাপড়েনে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয় যাত্রাশিল্পীরা। সেই কঠিন সময়ে ঐতিহ্যের এক একটি ধারাও হারিয়ে যায় ক্রমশ। স্থবিরতা নেমে আসে পহেলা বৈশাখের জাঁকজমক উৎসব আয়োজনেও। তবে আশার কথা, স্বাধীনতার পর ২০১২ সালে বর্তমান সরকার যাত্রাশিল্প নীতিমালা প্রণয়ন ও গেজেটভুক্ত করেছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে যাত্রা তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে এবং বাঙালির সর্বজনীন উৎসবে বেজে উঠবে যাত্রার চিরায়ত ঐকতানবাদন।
লেখক : নাটকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত যাত্রাশিল্পী, পালাকার, গবেষক