শহীদ আলতাফ মাহমুদ এবং আবদুল গাফফার চৌধুরী যেমন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের জন্য অমরত্ব পেয়ে গেছেন তেমনি গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও আনোয়ার পারভেজও ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ এই একটি মাত্র গানের জন্যেই বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। যে গানটি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অনুপ্রেরণায় রচিত, সেই গান ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে প্রতিদিন উজ্জীবিত করতো, উজ্জীবিত করে এখনো। এই গান কেবল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সিগনেচার টিউনই ছিল না, ছিল বাংলাদেশের মুুক্তিযুদ্ধের ‘সিগনেচার টিউনও।’ ১৯৭৫ সালে এই গানের স্রষ্টাকে প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর আকস্মিক হত্যাকান্ডের কারণে তা আর প্রদান করা সম্ভব হয়নি। কিংবদন্তী গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথা বলছি। সংগীত ও চলচ্চিত্রের বিবিধ শাখায় তাঁর সফল বিচরণ সত্ত্বেও যিনি মূলত গীতিকার হিসেবেই খ্যাতকীর্তি। প্রায় ২৫ হাজার গানের রচয়িতা এই শিল্পীর ৪ হাজারের বেশি গান হারিয়ে গেছে ১৯৭১- এর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে। বেতার টিভিতে যেমন হারিয়ে গেছে এবং নষ্ট করা হয়েছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর লেখা গানের সব খাতাও হারিয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের পর থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত লেখা গানের সংখ্যা প্রায় ২১ হাজার। তাঁর তুঙ্গ সময়ে তাঁকে দৈনিক ৬ থেকে ৭টি গান নিয়মিত লিখতে হতো। প্রায় ২৫০০ ছবিতে গান লিখেছেন। এসব পরিসংখ্যান বিশ্ব সংগীতের ক্ষেত্রে ঈর্ষনীয় উপাত্ত এবং বাংলাদেশের সংগীতের ক্ষেত্রে রেকর্ড যা হয়তো অক্ষুণ্নই থাকবে।
বিবিসির জরিপে সেরা ২০টি বাংলা গানের তিনটিই তাঁর লেখা।
তিনটি গানই দেশাত্মবোধক; জয় বাংলা বাংলার জয়, একবার যেতে দে না, একতারা তুই দেশের কথা। তিনটি গানেরই সুরকার আনোয়ার পারভেজ এবং কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ। দেশের গানে যেন সহজাত দক্ষতা ছিল গাজী মাজহারুল আনোয়ারের। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি অপরিসীম মমত্ববোধের কারণে তা সম্ভব হয়েছিল। চলচ্চিত্রের রোমান্টিক গানেও তিনি অবলীলায় দেশপ্রেমকে মিশিয়ে দিতে পারতেন। হারজিৎ ছবিতে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘যদি আমাকে জানতে সাধ হয়’, আলিঙ্গন ছবিতে মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের কণ্ঠে ‘দেখে এলাম কত ঘুরে এলাম’ শেষ রাতের তারা ছবিতে মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের গাওয়া ‘এই যে সোনার দেশ’ কয়েকটি উদাহরণ। এরকম উদাহরণ প্রচুর রয়েছে।
তাঁর গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য সহজ সরলতা। শব্দচয়ন, উপমার প্রয়োগ, কাব্যময়তা এসবের সঙ্গে একই সাথে মিশে থাকতো চরম আধুনিকতা এবং এই মাটির সোঁদা গন্ধ। ফলে গানগুলি হয়ে উঠতো শ্রোতার নিজের গান। বাংলাদেশের প্রবীণ নবীন সকল সুরকারের সুরে গান রচনা করলেও সত্য সাহা, আনোয়ার পারভেজ, সুবল দাস এবং খন্দকার নুরুল আলম এই চার সুরস্রষ্টার সাথে তাঁর মেলবন্ধন ছিল চমৎকার। তবে সত্য সাহার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। গাজী মাজহারুল আনোয়ার এবং সত্য সাহার রসায়ন ছিল ষোল আনায় পরিপূরক। গাজী সাহেবের বেশিরভাগ গান সত্য সাহার সুরে সেসবের নব্বই ভাগই শ্রোতাপ্রিয় সত্যসাহা ছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মেন্টর। সত্য সাহার হাত ধরেই গাজী সাহেবের প্রকৃত যাত্রা শুরু। ১৯৬৫ সালে আয়না ও অবশিষ্ট ছবির জন্য আকাশের হাতে আছে এক রাশ নীল গানটি লিখিয়েছিলেন সত্য সাহা। পরিচালক সুভাষ দত্ত ২১ বছরের এই তরুণকে দিয়ে গান লেখাতে রাজি ছিলেন না। তার আগের বছর ১৯৬৪ সালেই মাত্র তিনি রেডিও ও টিভিতে গান লেখা শুরু করেছেন এবং দুয়েকটি মাত্র গান শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে। সত্য সাহার জোরাজুরিতে সুভাষ দত্ত রাজি হন এবং গানটি শুনে রীতিমত অবাক হয়ে যান। আঞ্জুমান আর বেগম ও বশির আহমেদের কণ্ঠে এই গান বাংলা সংগীতে একটি ইতিহাস তৈরি করে রেখেছে। সত্য সাহার সাথে গাজী সাহেবের ছিল আমৃত্যুর সম্পর্ক। তিনি সত্য সাহাকে বলতেন তাঁর গাইড।
সত্য সাহা সম্পর্কে তিনি বলতেন, ‘সত্যদা আমার কাছে ছিলেন দেবতাতুল্য। তিনি আমার চলচ্চিত্রের পিতা।’ সত্য সাহা, আজিজুর রহমান, দিলীপ বিশ্বাস এবং গাজী মাজহারুল ছিলেন হরিহর আত্মার বন্ধু।’ ‘চতুরঙ্গ’ নামে খ্যাত ছিলেন তাঁরা। মূলত সত্য সাহার আহ্বানে গাজী সাহেব চলচ্চিত্র নির্মাণে নিয়োজিত হন ১৯৭০ সালে সমাধান ছবির মধ্য দিয়ে। চতুরঙ্গ প্রোডাকশন নামের ব্যানার তৈরি করে চার জনের সমবায়ে ছবিটি পরিচালনা করেন আজিজুর রহমান এবং ১৯৭২ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিটি যথেষ্ট প্রশংসিত এবং দর্শকপ্রিয় হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে চারজন পৃথকভাবে চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু করলেও বন্ধুত্ব ছিল বরাবরই অটুট।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার ১৯৮১ সালে চলচ্চিত্র পরিচালনায় আসেন। ১৯৮২ সালে তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি ‘নান্টু ঘটক’ মুক্তি পায় এবং জনপ্রিয় হয়। তিনি মোট ৩৫টি ছবি পরিচালনা করেছেন। মূলত মূলধারার বাণিজ্যধর্মী ছবি নির্মাণ করেছেন তিনি। তবে ছবিগুলি ছিল রুচিসম্মত।
১৯৪৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা শহরে জন্মগ্রহণ করেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। পৈতৃক নিবাস কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা তালেশ্বর গ্রামে। কুমিল্লায় মাধ্যমিক (জিলা স্কুল) ও উচ্চ মাধ্যমিক (ভিক্টোরিয়া কলেজ) পড়ার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে সাংস্কৃতিক ব্যস্ততা ও চিকিৎসাবিদ্যায় অনীহার কারণে চতুর্থ বর্ষে পড়া ছেড়ে দেন। এর পর ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক হন। মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন সময়ে ১৯৬২ সালে একটি নাটকের জন্য প্রথম গান লেখেন ‘বুঝেছি মনের বনে রঙ লেগেছে’ গানটি গেয়েছিলেন ফরিদা ইয়াসমীন। পরে তিনি এটি ঢাকা রেডিওতে পরিবেশন করেন এবং গানটি বেশ সমাদৃত হয়। ১৯৬৪ সালে বেতারে গাজী সাহেব তালিকাভুক্ত গীতিকার হন। প্রথম গান ছিল খন্দকার নুরুল আলমের সুরে ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে। এই গান টিভির একটি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে এবং তিনি টিভিতেও তালিকাভুক্ত হয়ে যান।
কৈশোরে কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের হাতেখড়ি। স্কুলে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে উর্দুর পরিবর্তে সংস্কৃতি পড়েন। তাঁর মতে এই শিক্ষা বাংলা ভাষায় তাঁর ব্যুৎপত্তি সৃষ্টিতে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। গান রচনার ক্ষেত্রে তিনি প্রথম দিকে জিয়া হায়দার, ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও আবু হেনা মোস্তফা কামালের আঙ্গিক অনুসরণ করলেও অল্প দিনের মধ্যে নিজের আঙ্গিকে গড়ে তোলেন। ক্রমশ তিনি বাংলাদেশের সঙ্গীত বিশেষ করে চলচ্চিত্র সঙ্গীত জগতে অনিবার্য হয়ে ওঠেন। নিজেকে সমার্থক করে তুলতে সমর্থ হন গীতিকার অভিধাটির সঙ্গে। ক্রমশ পরিণত হন একজন কিংবদন্তি গীতিকবিতে।
১৯৭১ সালে সংযুক্ত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে। এছাড়াও নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত ছিলেন। ইয়াহিয়া খান প্রথমে যে ১৮ জন শিল্পীবুদ্ধিজীবীকে হত্যার তালিকা করে তম্মধ্যে ১১ নম্বর ছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। পরে অভিনেতা আজিমের জোরাজুরি ও সহায়তায় আগরতলায় চলে যান। রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন গাজী সাহেব। একটু ভিন্নমুখী রাজনীতি করলেও পরমতসহিষ্ণুতা এবং বিনয়ের কারণে তাঁর সর্বজনগ্রাহ্যতা ছিল। রাজনীতিতে শীর্ষপর্যায়ে সক্রিয় থাকলেও উচ্চকিত ছিলেন না।
বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রায় সব পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার (২০২১), দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার একুশে পদক (২০০২), ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বাচসাস সহ প্রচুর দেশি বিদেশি বেসরকারি পুরস্কারতো স্বভাবতই পেয়েছেন। সবচেয়ে বড় পুরস্কার দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনসাধারণের ভালোবাসা ও সমাদর যেটা কেবল জীবনকালে নয় মৃত্যুর পরেও পেয়েছেন। রাজনৈতিক মতদ্বৈততাকে উপেক্ষা করে সকলেই উপস্থিত হয়েছেন তাঁকে শেষ বিদায় জানাতে।
তিনি চেয়েছিলেন আমৃত্যু রচনায় ব্যাপৃত থাকতে। একজন প্রকৃত শিল্পস্রষ্টার চাওয়া এটাই। মৃত্যুর আগের দিনেও তিনি গীত রচনা করেছেন। চলে গেছেন ইপ্সিতভাবে। তবে ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তাঁর নশ্বর প্রয়াণ তাঁকে বিস্মৃতিতে আশ্রিত করবে না। আশা করি বাংলা গান দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবে। তারই মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার।