স্বাধীন বাংলাদেশ এর অপর নাম যেন বঙ্গবন্ধু। একটি দেশ সম্পর্কে জানতে ইতিহাস জানতে হবে। আর বাংলাদেশের ইতিহাস মানেই বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস। ইতিহাস না জেনে কোন বিষয়ে যেমন সঠিক ধারণা পাওয়া যায়না তেমনি একজন মানুষকে ভালোভাবে না জেনে, তার সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা ছাড়া তাকে ভালোবাসা সম্ভব না। ঠিক আমাদের বঙ্গবন্ধুকেও ভালোবাসতে হলে তাঁর চারিত্রিক বিভিন্ন গুণাবলী সম্পর্কে জানতে হবে শুরুতেই। বাংলা মানেই বঙ্গবন্ধু। একথা বলি আমরা খুব সহজেই। অনেকেই জেনে আর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ না জেনেই শুধুই শোনা কথায় ভর করে। শোনা কথা যেমন সবসময় সঠিক তথ্য প্রদান করেনা তেমনি শোনা কথায় তাঁকে ভালোবাসাও সম্ভব না। আর যারা ইতিহাস না জেনে বলেন, আমরা ভালোবাসি, তাদের বেশির ভাগই গড্ডালিকাপ্রবাহে নাও ভাসিয়ে ভেসে থাকতে চান, যার স্থায়িত্বকাল ক্ষণিকের। আমিও তার খুব একটা ব্যতিক্রম তা নই। ইতিহাস সম্পর্কে ক্ষীণ জ্ঞান নিয়ে চলেছি। কিন্তু চলার পথের প্রয়োজনেই জানতে হচ্ছে অনেক কিছু। তাঁকে ধীরে ধীরে জানছি। আর যতোই জানছি ততোই তাঁকে নতুন নতুন করে আবিষ্কার করছি। আর ততোই তাঁকে ভালোবাসা থেকে বিরত থাকা অসম্ভব হয়ে উঠছে।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই মার্চ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের বাইগার নদী তীরবর্তী টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান। বলিষ্ঠ নেতৃত্বগুণ, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, উদারচেতা, অসামপ্রদায়িক মনোভাব সম্পন্ন এই পুরুষ যেমনে ছিলেন শিক্ষা, সাহিত্য -সংস্কৃতি অনুরাগী, তেমনি তাঁর দৃষ্টিতে আড়াল হয়নি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়নের প্রয়োজনীয়তা। প্রাণভরে ভালোবাসেন দেশের প্রকৃতি ও দেশের সার্বভৌমকে। শিশুদের ভালোবাসার মতো ছিলো যাঁর নরম কোমল মন। একজন মানুষ কিভাবে এতোটা মেধা, প্রজ্ঞা আর অসামান্য প্রতিভা নিয়ে পৃথিবীতে আসেন! আর তিনি এভাবে শক্তিশালী চারিত্রিক মহিমা নিয়ে এসেছিলেন বলেই হয়তো তিনি বীর বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।
আমাদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে কিছু লেখার জন্য বসা। আর তাঁর সম্পর্কে কিছু লেখা মানেই মস্তিষ্কে প্রথমেই কড়া নাড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা। স্বাধীনতা মানেই আর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকা ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘুমন্ত বাঙালির ওপর হামলে পড়ার, নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ফলশ্রুতিতে একটি রক্তস্নাত সূর্যোদয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেদিন এই বাংলার মানুষ দেখেছিল এক অন্যরকম নব উদিত রক্তিম সূর্য। একটি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সূর্য। সেদিনই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল। সেদিন অর্থাৎ ২৫ মার্চের মধ্য রাতের পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যা তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার চালু হবার প্রায় ১৮ ঘন্টা আগেই বিদেশি সাংবাদিকরা শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন রেডিও মনিটর করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচার করেন। পরে চট্টগ্রামের স্থানীয় একটি বেতারকেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয়।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল। আর এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহবান করেন এবং তা সত্বেও আহূত এই অধিবেশন স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আর বাংলার মানুষের সাথে এমন বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নিতে পারেননি দূরদর্শী, দেশপ্রেমিক এই নেতা।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ১ মার্চ দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এর পর থেকেই স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বাংলার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জনসভায় তৎসম্পর্কিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হবার ডাক দেন এবং ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
দেশের এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা, মানুষের শেষ ভরসাস্থল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা নথি নিরাপত্তাজনীত কারণে সংরক্ষণ করা না গেলেও পরবর্বতী সময়ে তা ষষ্ঠ তফসিলে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। আর এই ঘোষণা অবিকল তুলে ধরলে এরকমই হয় —
“ইহাই হয়তো আমাদের শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।”- শেখ মুজিবুর রহমান।
মূলত ৭ মার্চের মাত্র ১০৩ লাইনের ১৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড এর ভাষণে যথাযথ ইঙ্গিত প্রদানের মধ্য দিয়েই বাংলার মানুষকে মানসিকভাবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছিলেন আগেই। তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, মানুষের জন্য, দেশের জন্য অগাধ প্রেমই হয়তো তাঁকে একজন সাধারণ মানুষ হতে অসাধারণ অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছে। অতিমাত্রায় দেশভক্তি ছাড়া হয়তো এমন সাহসী সিদ্ধান্তগ্রহণ সম্ভব হতো না।
আর তাইতো শুধুমাত্র অদম্য মনোবলকে সম্বল করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নিরস্ত্র বাঙালি মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানের আধুনিক সমরসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। মৃত্যুপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুঃসাহসে দীপ্ত মুক্তিকামী বাঙালি একাত্তরের মাত্র ন’ মাসে প্রবল পরাক্রমশালী পাক হানাদারদের পরাস্ত করে ছিনিয়ে এনেছিল মহামূল্যবান স্বাধীনতা। পরিশেষে বলতে হয়, বঙ্গবন্ধু শুধু একজন নেতাই নন, একটি ইতিহাস। শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফ-এর ভাষায় বলা যায় :
‘বঙ্গবন্ধু বিশ্বাসে নিঃশ্বাস
বঙ্গবন্ধু একাই ইতিহাস’।
লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, ওমরগণি এম ই এস কলেজ, চট্টগ্রাম