গত ০৫ই আগস্ট বৃহস্পতিবার দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ভ্রাম্যমান আদালত কর্তৃক নেত্রকোনায় দুটি শিশুকে দণ্ড প্রদান এবং হাইকোর্টের নির্দেশে উক্ত দু’জনকে মুক্তি প্রদানের ঘটনা দেশব্যাপী প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এর আগেও বেশ কয়েকবার দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ছাগলকে দণ্ড প্রদান, অপরাধ সংঘটিত হবার কয়েকদিন পরে পুলিশ কর্তৃক ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থাপিত আসামীকে দণ্ড প্রদান, অপরাধ স্থলে না যেয়ে চেম্বারে বসে দণ্ড প্রদান ইত্যাদি ঘটনা ভ্রাম্যমান আদালতের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আজ এমন একজন ম্যাজিস্ট্রেট সম্পর্কে এ নিবন্ধ লিখতে বাধ্য হয়েছি, যার ম্যাজিস্ট্রেসি দক্ষতা ও নৈপূণ্য অসাধারণ, অনুসরণীয়, অনুকরণীয়। মোবাইল কোর্টের আইন প্রয়োগে তিনি ছিলেন নির্মোহ, নৈর্ব্যক্তিক এবং নিরপেক্ষ। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী, যাঁর নেতৃত্বে আমার জানামতে অন্তত ৮/১০ হাজার মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। অথচ তাঁর দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটিও রিট হয়নি। তাঁর নির্ভুল আইন প্রয়োগের কারণে দণ্ডিতরা কোন আদালতে যাওয়ার সাহস পাননি। বরং জেলা ও মহানগর দায়রা জজ আদালতে তাঁর দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রিভিশন গুলোর সবকটিতে তাঁর আদেশ অপরিবর্তিত রেখেছিলেন বিজ্ঞ জজ সাহেবগণ। তাঁকে দেখেছি, কী দুর্দান্ত সাহস নিয়ে তিনি ভূমিদস্যু, অপরাধী ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। উপরের মহলের অন্যায় চাপ, হুমকি কিংবা দুর্নীতিবাজদের রক্তচক্ষুকে তিনি পরোয়া করতেন না। ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বাংলাদেশের মোবাইল কোর্টের ইতিহাসে এমন উদাহরণ বিরল। মোবাইল কোর্টের সংখ্যা, দণ্ডিত অপরাধীর সংখ্যা এবং জরিমানার অংকে তিনি আমার জানামতে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। তিনি এক কিংবদন্তী, হাজার হাজার মোবাইল কোর্টের সফল অভিযানের তিনি মহানায়ক। বঙ্গোপসাগর কিংবা কর্ণফুলী নদীতে অতি প্রত্যূষে তিনি নেমে পড়তেন, এভাবে অসাধারণ দক্ষতায় পরিবেশ দূষণকারী, শুল্ক ফাঁকি দেয়া অথবা বন্দর আইন লঙ্ঘনকারী দেশী-বিদেশী শত শত জাহাজ আটক করেছেন। গভীর রাতে বা প্রচণ্ড ঝড়-তুফানের মধ্যেও সমুদ্রে অভিযান চালানোর অসংখ্য নজীর তিনি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর অসীম সাহসী ব্যক্তিত্বের কাছে সন্ত্রাসী, অপরাধী ও ভূমিদস্যুরা দুর্বল হয়ে যেতো। তাঁর মোবাইল কোর্ট রাডারের মতো বন্দরের জল ও স্থলসীমা পাহারা দিয়ে রাখতো। তাঁর পেছনে অনেক ভয়ংকর শত্রু ছিল। অনেক হুমকি ছিল, কিন্তু কখনো মৃত্যু ভয়ে ভীত ছিলেন না। চট্টগ্রামে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শক্ত হাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী সাহেব তাঁকে ‘Tiger of ctg’ নামে অভিহিত করতেন। বড় বড় দুর্নীতি উদঘাটন এবং রাঘব বোয়াল ধরতে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আমার বিশ্বাস, শুধু সততাই সম্বল নয়। সততার সাথে প্রয়োজন মুনীর চৌধুরীর মতো অসাধারণ সাহস, কর্মদক্ষতা অর্থাৎ তাৎক্ষণিক মাঠে তথা অপরাধ স্থলে ঝাঁপিয়ে পড়ার দুর্দমনীয় সাহস ও সর্বোপরি গভীর কর্তব্যনিষ্ঠা এবং হৃদয় দিয়ে কাজ করার প্রেরণা।
তাঁকে দেখেছি, নির্ভীক ও আপোষহীন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পর্বত সমান প্রতিকূলতা ও কঠিন সংকটের মধ্যেও মোবাইল কোর্টের দু:সাহসিক অভিযান চালিয়ে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের অর্ধশত বছর ধরে বেহাত হয়ে যাওয়া প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার মূল্যবান জমি ভূমিদস্যুদের হাত থেকে দখলমুক্ত করেন। সমুদ্রে চলাচলকারী শতশত জাহাজ আটক করে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় এবং বন্দর চ্যানেলে কলকারখানা ও দেশি বিদেশি জাহাজের বেপরোয়া পরিবেশ দূষণ ও বর্জ্য ফেলা কঠোর হাতে দমন করেন। নানা অনিয়ম ও বিশৃংখলা দমনে ম্যাজিস্ট্রেট মুনীরের কঠোর অভিযানে পোর্ট শিপিং সেক্টরে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। এছাড়া বড় বড় শিল্প কারখানায় গ্যাস চুরি, ভেজাল ও নকল ঔষধের ব্যবসা, যান চলাচলে ভয়াবহ বিশৃংখলা, ওয়াসার পানি চুরি, অপচয় ও রাজস্ব ফাঁকি, বিদ্যুৎ চুরি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, খাদ্যে ভেজাল, জনস্বার্থ বিরোধী অবৈধ ব্যবসা, নগর জুড়ে ভয়াবহ দূষণ, পাহাড় কাটা, নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবসা, কর্ণফুলী নদীতে বেআইনী মৎস্য সম্পদ আহরণ, নগরীর রাস্তা ঘাট, খাল-নালা-নর্দমা ও ফুটপাথ দখলের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযানে নেমে সরকারের বহু সেক্টরে এবং নগর জীবনে মুনীর চৌধুরী বিশাল পরিবর্তন আনেন। বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, বন্দরের বাইরে বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব কাধে নিয়ে অতিরিক্ত ভাতা ও সুবিধাদি ছাড়াই ক্লান্তিহীন ভাবে মুনীর চৌধুরী জনস্বার্থ রক্ষায় নিয়মিত মোবাইল কোর্ট চালিয়ে গেছেন। কখনো চেম্বারে বসে দণ্ড প্রদান করেননি। চট্টগ্রামের রাজপথে, অলিতে-গলিতে, পাহাড়ে, সমুদ্রে, মহল্লায় ও ভবনে নানা অপরাধ নির্মূলে ঝড়, বৃষ্টি ও রোদ উপেক্ষা করে অপরাধ স্থলে ছুটে যেতেন তিনি। তাঁর বিরামহীন অভিযানে চট্টগ্রামের সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ ও সংস্থাগুলোর রাজস্ব আয় অভাবিত ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এসে ৪০ লাখ নগরবাসীর কাছে এর সফলভাবে পৌঁছে। তাঁর মোবাইল কোর্টের হস্তক্ষেপে অনেক নাগরিক ফিরে পেয়েছেন বেদখল হওয়া জমি, ভবন ও ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থ। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে মুনীর চৌধুরী বাংলাদেশের পরিবেশ সেক্টরেও বিপ্লব ঘটিয়েছেন। বহু দূষণকারী ব্যবসায়ী গ্রেফতার এবং অসংখ্য দূষণকারী অবৈধ কারখানা উচ্ছেদ করে তিনি বাংলাদেশে দূষণের ভয়াবহতা কমিয়েছেন। প্রায় ১০০ কোটি টাকা জরিমানা আদায় এবং কয়েক হাজার টন দূষণকারী সামগ্রী জব্দ করে তিনি বাংলাদেশে পরিবেশ আইন প্রয়োগে বিপ্লব ঘটান। যে প্রতিষ্ঠানেই হাত দিয়েছেন, সে প্রতিষ্ঠান তাঁর স্পর্শে প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়েছে। তার প্রমাণ ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী নামক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের লোপাট হওয়া ১২শ কোটি টাকা উদ্ধার, মিল্ক ভিটা নামক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করা, চট্টগ্রাম ওয়াসার লোকসান কাটিয়ে ৩৪ কোটি টাকা বকেয়া আদায় করে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। মূলত তাঁর মোবাইল কোর্টের টার্গেট ছিল রাঘব বোয়াল, চুনোপুঁটি নয়। এমনকি, বিগত জোট সরকারের আমলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মালিকানাধীন ‘কোকো জাহাজ’ আটক এবং জরিমানা আদায় করে তিনি সরকারের ভীত কাঁপিয়ে দেন। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাকে নি:স্বার্থভাবে এবং জনকল্যাণে প্রয়োগ করার যে দৃষ্টান্ত ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর দেখিয়েছেন, বর্তমান প্রজন্মের ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে তা মডেল হিসেবে তুলে ধরতে হবে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় প্রচুর অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। যার অভাবে মোবাইল কোর্ট জনসাধারণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে ।
সফল মোবাইল কোর্টের জন্য প্রয়োজন কঠোর প্রশিক্ষণ বিশেষ করে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান। পুঁথিগত প্রশিক্ষণ নয়, প্রয়োজন মাঠে নেমে প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ এবং কেস স্টাডির মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ। দায়িত্ব পালন কালে ম্যাজিস্ট্রেটদের কঠোর মনোযোগ এবং আবেগহীন থাকতে হবে। আগামীতে যেন ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরীর মতো এ প্রজন্মের তরুণ নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন, সে প্রত্যাশাই রইলো।
লেখক : আইনজীবী, পরিবেশ এবং মানবাধিকার কর্মী