আমার মতো নগণ্য মানুষ একজন মহীরুহ সম মনীষী সম্পর্কে লিখতে যাওয়া এক প্রকার ধৃষ্টতা মনে করি। তারপরও এই মহান মানুষটির রুহানি দোয়া পাবার আশায় কিছু লেখার চেষ্টা মাত্র।
উত্তর চট্টগ্রাম এমনিতেই রত্নগর্ভা জনপদ। কারণ, এই জনপদে সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা ব্যাপকভাবে পদচারণা করেছেন। তাঁদের মধ্যে শিক্ষাবিদ ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব মৌলভী হাফিজুর রহমান বিএবিটি অন্যতম। সৌভাগ্যক্রমে আমি অধম এই মহান ব্যক্তির দৌহিত্র। আট এপ্রিল ওনার ওফাত দিবস।
তিনি উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে রাউজানের মোহাম্মদপুর পল্লিতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে মহিয়সী মাতার ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা হতে সুতীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী মানুষটি একাডেমিক লাইফের প্রতিটি স্তরে আউটস্ট্যান্ডিং প্রতিভার সাক্ষর রাখেন। শৈশবের কোনো এক দিনে বাবার সাথে
আধ্যাত্মিকতার প্রাণকেন্দ্র মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে গমন করেন আমার নানাজান। সেই সময় সেখানে গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারি হযরত গোলামুর রহমান কেবলা (কাদ্দাসাল্লাহু সিররাহুল আযিয) জাহেরি হায়াতে বর্তমান ছিলেন। আমার নানাজানকে দেখা মাত্রই আল্লাহর এই মহান অলি নানাজানের দিয়ে তাকিয়ে
মুচকি হেসে ওনার হাতে থাকা হুক্কার নল মোবারক নানার কপালে লাগান এবং দোয়া করেন। এরপর নানাজানের ভিতর একটি অন্যরকম পরিবর্তন এসে যায়। অর্থাৎ; এই কাজটি করার মাধ্যমে বাবা ভাণ্ডারি এই শিশুটির দিকে রহমতের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। কারণ; এই শিশুটি যে বড় হয়ে কামেল অলি হবেন তা বাবা
ভাণ্ডারি অন্তর্চক্ষু দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন। আল্লাহর অলিরা মহান আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে মানুষের ভবিষ্যত দেখতে পান। বাবা ভাণ্ডারি এই শিশুটির দিকে আধ্যাত্মিকতার তাওয়াজ্জুহ বখশিশ করেন।
হযরত গাউছে মাইজভাণ্ডারি বাবা ভাণ্ডারি (কাদ্দাসাল্লাহু সিররাহুল আযিয)’র সেই ঘটনা মূলত: তিনি সেই দিন আমার নানুজীকে কামালিয়াতের মর্যাদায় পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ, বাবা ভাণ্ডারি হুজুর এত উঁচু মর্তবাসম্পন্ন অলি ছিলেন যে, পুরো পৃথিবীকে যদি চার ভাগ করা হয়,তৎমধ্যে একটি অঞ্চল তথা
পৃথিবীর পূর্ব অঞ্চলের আধ্যাত্মিক সম্রাট ছিলেন তিনি। কারো দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকালে অলিয়ে কামেলে পরিণত হতেন। আমার নানা সেই সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। আরেকবার, রাউজানের গহিরায় তাশরিফ নিয়ে আসেন এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত অলি আল্লাহ, আওলাদে রাসূল (দ.), জামেয়া
আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার প্রতিষ্ঠাতা, হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ ছিরিকোটি (রহ.)। মা ফাতেমা (রা.)’র বাগানের এই নূরানী সন্তানকে দেখতে, কুতুবুল আউলিয়ার সান্নিধ্য পেতে আমার নানাজান গহিরায় আসেন। যথারীতি সালাম ও কুশল বিনিময় শেষে যখন হযরতের জন্য তাবাররুকাত পরিবেশন করা হয়
তখন আমার নানাকে শাহেনশাহে ছিরিকোটি হুজুরের পাশেই বসানো হয়। আলাপচারিতার ফাঁকে ছিরিকোটি হুজুর নিজের পাত হতে এক টুকরো মাংস ছিঁড়ে আমার নানাকে খেতে দেন। ইংরেজিতে একটি কথা আছে– ‘ডায়মন্ড কাটস্ ডায়মন্ড’। অর্থাৎ; রতনে রতন চিনে। একজন প্রকৃত অলি আরেকজন প্রকৃত অলিকে
চিনেন ও মহব্বত করেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে মূলত: ছিরিকোটি হুজুর আমার নানার দিকে রহমতের ফয়েজ বখশিশ করেন। ইংরেজি শিক্ষিত হবার কারণে নিজের বুযুর্গীয়ত বা কামালিয়াতকে খুব গোপন করে চলতেন নানাজান। আধ্যাত্মিকতাকে লুকিয়ে রাখতেন। প্রকাশ হতে দিতেন না। এটাই প্রকৃত অলি
আল্লাহদের বৈশিষ্ট্য। ওনারা নিজেদের গোপন রাখতে পছন্দ করেন। সমসাময়িক আউলিয়ায়ে কেরামগণের সাথে ছিল নানার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। যেমন– মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের হযরত দেলাওয়ার হোসাইন মাইজভাণ্ডারি (রহ.), নানুপুরের হযরত আবদুচ্ছালাম ইছাপুরী (রহ.), রাঙ্গুনিয়ার বেতাগীর হযরত
হাফেজ বজলুর রহমান (রহ.), রাউজান হাজিপাড়ার হযরত মৌলানা এজাবত উল্লাহ শাহ (রহ.), হযরত মৌলানা কলিমুল্লাহ শাহ (রহ.), অধ্যাপক হযরত আবদুল জলিল মিয়া (রহ.), লোহাগাড়ার হযরত পেঠান শাহ (রহ.) সহ অনেক সাধক মহাপুরুষদের অপার্থিব সান্নিধ্যে নিজেকে আপনালোকে সমৃদ্ধ করেছেন।
এবার আসি, মৌলভী হাফিজুর রহমান বিএবিটি’র সুদীর্ঘ কালের গৌরবোজ্জ্বল শিক্ষকতা জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে। আমার নানাজান ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। য়াঁরা বর্তমানে শিক্ষকতার মহান পেশায় জড়িত তাঁদের জন্য তিনি ছিলেন এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। আমেরিকান মনীষী জন এডামস বলেছেন, ‘শিক্ষক
হলেন জাতির আলোকবর্তিকাবাহী এবং মানবজাতির ভবিষ্যৎ রূপকার’। শিক্ষক সম্পর্কে জন এডামস এর সংজ্ঞার মধ্যে মৌলভী হাফিজুর রহমান বিএবিটি’র শিক্ষক জীবনের শতভাগ সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। আদর্শ শিক্ষকের উন্নত জীবনবাদর্শ থাকা প্রয়োজন। শিক্ষক হলেন সেই মোমবাতির মতো যে নিজের আলোতে অন্যকে আলোকিত করে।
শিক্ষক হবেন জ্ঞানপিপাসু যিনি সারাজীবন ধরে জ্ঞান আহরণে সচেষ্ট হবেন, যা শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করবে। শিক্ষাবিদ, জ্ঞানতাপস, আধ্যাত্মিক সিদ্ধ পুরুষ মৌলভী হাফিজুর রহমান বিএবিটি জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের মাধ্যমে আলোকিত মানুষ ও আলোকিত সমাজ গড়তে যে অবদান রেখেছেন তা যুগ যুগ ধরে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমার নানুজীর জীবনের সকল সৎকর্মগুলোকে কবুল করে তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান করুন। আমিন।
লেখক : অফিসার, বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা