হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৮ এপ্রিল, ২০২৩ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

‘L’Etat c’est moi’ অর্থাৎ ‘আমিই রাষ্ট্র’। যদিও বা এই ফরাসি বাক্যের আক্ষরিক অর্থ হলো, ‘রাষ্ট্র, সেটি আমি’। ফরাসি রাজা লুই ফোর্টিন এই সদম্ভ উক্তি করেছিলেন ফরাসি পার্লামেন্টে। দিনটি ছিল ১৬৫৫ সালের এপ্রিলের ১৩, আজ থেকে ৩৬৮ বছর আগে। কিন্তু ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, ব্যক্তি সে যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন রাষ্ট্রের চাইতে বড় হতে পারেন না।

 

কিন্তু ক্ষমতা এমন এক ‘ওপিয়াম’ যা আমাদের অনেক সময় নেশাগ্রস্ত ও অন্ধ করে দেয়। ক্ষমতায় বসে ক্ষমতাধর ব্যক্তি ভুলে যান যে তাকেও একদিন জনগণের সামনে হাজির হতে হবে, দাঁড়াতে হবে আদালতের কাঠগড়ায়। যেমনটি ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলেন পৃথিবীর সব চাইতে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি যখন পথ চলেন, এমন কী ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর পরও, তখনও আশপাশের সমস্ত কিছুর চলাচল সে পথচারী থেকে শুরু করে যানবাহন, এমন কী মাথার উপরে উড়োজাহাজও থেমে থাকে। অথচ গতকাল ট্রাম্পকে যখন নিউ ইয়র্কের

ম্যানহ্যাটান ফৌজদারি আদালতে হাজির হতে হয়, তখন আদালতে প্রবেশমুখে তার জন্যে দরোজা খুলে দাঁড়ানোর জন্যে কেউ ছিল না। তাকে দেখা যায় নিজ হাতে দরোজা ঠেলে ধরে আদালত কক্ষে প্রবেশ করতে। তার আগে আদালতের যে নিরাপত্তা কর্মী ছিলেন তিনি তার পেছন পেছন হেঁটে আসা ডোনাল্ড ট্রাম্পের

জন্যে দরোজাটা হাত দিয়ে ধরে খুলে রাখার তাগিদ বোধ করলেন না। এক সময়কার সব চাইতে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটিকে আদালতে হাজির হতে হলো সাধারণ আর পাঁচদশ অপরাধীর মত। ফৌজদারি আদালতে প্রবেশ করে তাকে বলা হলো, তিনি এখন পুলিশি হেফাজতে অর্থাৎ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে আর

সব অপরাধীর মত তাকে হাতকড়া পরানো হয়নি। কিন্তু তার ‘ডিজিটাল’ ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়া হয়েছিল। এর চাইতে অপমানকর পরিস্থিতি আর কী হতে পারে এক ব্যক্তির জীবনে, বিশেষ করে সেই ব্যক্তি যখন বিশেষ ব্যক্তি, এক সময়কার সর্ব ক্ষমতার অধিকারী। একেই কি তবে বলে নিয়তি? আদালত কক্ষে তাকে বিষণ্ন

ও অনেকটা হতাশাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল বলে সিএনএনএর সাংবাদিকরা মন্তব্য করেন। আদালতের বাইরে তার পক্ষ ও বিপক্ষের লোকজন জড়ো হয়েছিল। তার ছবি সম্বলিত এক পোস্টারে ইংরেজিতে লেখা ছিল, ‘তাকে আটকে রাখ। অন্য পোস্টারে লেখা, ‘দুর্নীতির সংজ্ঞা হচ্ছে ট্রাম্প’।

গতকাল অনেক রাত অবধি লেপটপ খুলে ট্রাম্পের এই নাটকীয় ঘটনা ‘লাইভ’ দেখছিলাম। নিউ ইয়র্কের তার বিশাল ‘ট্রাম্প টাওয়ার’ থেকে তাকে নিয়ে যে গাড়িবহর শুরু হয় তা ম্যানহ্যাটানের ফৌজদারি আদালত প্রাঙ্গণে পৌঁছার দৃশ্য বিশ্বের কোটি দর্শক স্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় দেখছিলেন। ট্রাম্প যখন ক্ষমতায়

তখন বেড়াতে গিয়েছিলাম নিউ ইয়র্ক। ছেলে মেয়ে, তাদের মা সহ। ভাবলাম একবার দেখে আসি ‘ট্রাম্প টাওয়ার’, এত শুনেছি এর গল্প। দূর থেকে চোখে পড়ে এই ভবন। কাছে গিয়ে দেখি বিশাল চমৎকার বহুতল ভবন। চকচক করছে, যেন সদ্য তৈরী। ভবনঘিরে পাশের রাস্তায় একটি পুলিশ ভ্যান, ভবনের

সামনে কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশ সদস্য। ভেতরে যাওয়া যাবে কিনা কোন ধারণা নেই। তারপরেও দেখিনা কী হয় এই ভেবে রাস্তা পার হয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখি স্ক্যানিং মেশিন। সেটি পেরিয়ে রিসেপশন জাতীয় ডেস্ক। লবিটি বেশ বড়। নিরাপত্তা রক্ষীর কাছে জিজ্ঞেস করি ছবি তোলা যাবে কিনা। সম্মতি দিলে পর

ছবি তুলি। মজার ব্যাপার হলো, ট্রাম্প টাওয়ারের কাছাকাছি মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি তকতকে, ঝকঝকে স্টেশন। অথচ নিউ ইয়র্কে মাটির নিচের প্রায় রেল স্টেশনগুলির দৈন্য দশা। কিন্তু এটি তার বিপরীত। প্রেসিডেন্টের নিজস্ব টাওয়ারের কাছাকাছি কিনা, তাই। এইখানটায় বাংলাদেশের সাথে কী অদ্ভুত মিল।

যাই হোকনানা কারণে ক্ষমতায় বসার আগ থেকেই ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ বলে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প তার কাজকারবার, কর্ম পদ্ধতি, আচারব্যবহার, নর্ম নিয়ে বারবার সংবাদশিরোনাম হন। যা কিছু প্রচলিত তা ভেঙে, সমস্ত সভ্যতাভব্যতাকে পাশ কাটিয়ে নিজ খেয়ালখুশি ও ইচ্ছামাফিক রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। নানা

সময়ে নানা জনের বিরুদ্ধে অরুচিকর বক্তব্য রাখেন। গণতন্ত্রের ‘বারোটা’ বাজিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে নির্বাচনী ফলাফলকে তার পক্ষে আনার জন্যে হেন কাজ বাকি ছিল না যা তিনি করেননি। নির্বাচন পরিচালনা করা সরকারি কর্মকর্তাদের, বিচারকদের, সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তার পক্ষে কাজ করার জন্যে চাপ

দেন। কিন্তু আমেরিকা ইজ আমেরিকা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। অভিযোগ যৌন কেলেঙ্কারিরও, যা অবশ্য আমেরিকার প্রেসিডেন্টইতিহাসে নতুন কিছু নয়। সে আমরা দেখেছি জন এফ কেনেডি থেকে শুরু করে বিল ক্লিনটনের ক্ষেত্রেও। ক্লিনটন পার পেয়ে গেলেও পার পেলেন না বেচারা ডোনাল্ড ট্রাম্প।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পই হলেন প্রথম ব্যক্তি যাকে ফৌজদারি আদালতে ‘শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে প্রেসিডেন্টনির্বাচনের আগে মুখ না খোলার জন্যে’ পর্ণ তারকা স্টরমি ড্যানিয়েলসকে ঘুষ দেবার অভিযোগে বিবাদীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো। ড্যানিয়েলসের দাবি, ২০০৬ সালে তিনি ট্রাম্পের

সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন এবং ২০১৬ সালে এই নিয়ে মুখে কুলুপ আটার জন্যে ট্রাম্প তাকে এক লক্ষ ত্রিশ হাজার ডলার ঘুষ দিয়েছিলেন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গতকাল মোট ৩৪টি অভিযোগ আনা হয়। ট্রাম্প তার সবকটি অভিযোগ অস্বীকার করেন। এদিকে ট্রাম্পের সমর্থকরা বলেন, এই সব গ্রেফ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র

ছাড়া আর কিছু নয় এবং তিনি যেন আগামী নির্বাচনে অংশ না নিতে পারেন তারই প্রক্রিয়া। ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী ২০২৪ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়বার ঘোষণা দিয়েছেন অনেক আগেই। তিনি এখনো বিগত নির্বাচনের পরাজয়কে মেনে নেননি এবং ওই নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে দাবি করে নির্বাচিত প্রেসিডেন জো

বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে মেনে নেননি। তবে কেবল যে এই যৌনকেলেঙ্কারি নিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তা ভাবার কোন কারণ নেই। তার বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের নির্বাচন ফলাফলকে তার পক্ষে প্রভাবিত করার জন্যে তিনি অর্থের বিনিময়ে ‘ডেমেজিং স্টোরি’ প্রকাশ করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাকে জর্জিয়ায়ও অভিযোগের মুখোমুখি হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা অভিযোগ থেকে আইনিরক্ষা পেয়ে আসছিলেন। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তার সরকারি ক্ষমতায় মামলা করা হয়, কিন্তু সাধারণত ব্যক্তিগতভাবে কোন অন্যায় বা অপরাধ করে থাকলে তাকে আইনের আওতায় আনা হয় না বা তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়না। কিন্তু

সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা এই নিষেধাজ্ঞা ভেঙে একটি নূতন উদাহরণ স্থাপন করেছে। কেউ কেউ মনে করেন এটি দেশকে বিভেদের মুখে ঠেলে দেবে। আবার কারো মতে এতে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ভাবমূর্তি আরো বাড়বে। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক এবং প্রেসিডেন্ট জর্জ

ডব্লিউ বুশের অধীনে বিচার বিভাগের প্রাক্তন শীর্ষ কর্মকর্তা, জ্যাক এল গোল্ডস্মিথ বলেন, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সত্যতা প্রমাণিত হোক বা না হোক, এক প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে অপরাধী হিসাবে আদালতে হাজির ও গ্রেপ্তার হওয়া মার্কিন রাজনীতি ও মার্কিন আইনিইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

একই সাথে এই ঘটনা এই সত্যটিকে আবার নতুন করে মনে করিয়ে দেবে যে পৃথিবীর সব চাইতে ক্ষমতাধর ব্যক্তিও আইনের ঊর্ধ্বে নন।

তবে সহজে দমে যাবার পাত্র যে ট্রাম্প নন সে কারো অজানা নয়। আদালত থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ফিরে যান তার বিলাসবহুল ‘মারলাগো’ স্টেটে। সেখানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। তিনি তার বক্তব্যে কেবল ম্যানহ্যাটানের জেলা অ্যাটর্নি আলভিন

ব্র্যাগকেই নয়, মামলা পরিচালনাকারী প্রসিকিউটরদের বিরুদ্ধেও কটাক্ষ করেন। এদিকে কেউ কেউ মনে করেন আদালতে হাজির হবার পর ট্রাম্পের ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। যে সমস্ত দলীয় (রিপাবলিকান) নেতারা তার বিরুদ্ধে এর আগে মন্তব্য করেছিলেন তাদের

কেউ কেউ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এই আইনি পদক্ষেপের সমালোচনা করেন। অভিযুক্ত হবার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। ট্রাম্পের সিনিয়র উপদেষ্টা জেসন মিলার দাবি করেন, নিউ ইয়র্কের গ্রান্ড জুরি তাকে অভিযুক্ত করার পক্ষে ভোট দেবার পর থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প চারদিনে চার মিলিয়ন ডলারের

বেশি অর্থ সংগ্রহ করেন। আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি বড় ফ্যাক্টর তাতে কোন সন্দেহ নেই। অনেকের প্রশ্ন তিনি কি আদৌ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা রাখবেন? যদি রাখেন তাহলে তিনি কি দলীয় মনোনয়ন লাভে সফল হবেন? তিনি কি

আবারো দ্বিতীয়বারের মত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন? যদি হন তার রাষ্ট্র পরিচালনায় কোন পরিবর্তন আসবে কি? তিনি ক্ষমতায় এলে বিশ্বরাজনীতিতে কি নতুন কোন মেরুকরণ সৃষ্টি হবে? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যে আমাদের আরো অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমৌলভী হাফিজুর রহমান বিএবিটি
পরবর্তী নিবন্ধসত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনই প্রত্যাশিত