চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন শিক্ষার্থীদের মাঝে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন সাইফুল আলম লিমন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি না থাকায় সেখানে কোনো পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেননি তিনি। তবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তার মূল্যায়ন করেছিল। সাংগঠনিক দক্ষতাবলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য থেকে সহ-সম্পাদক পর্যন্ত হয়েছিলেন।
লিমন চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার শ্রীপুর গ্রামের শাহ আলমের ছেলে। তার বাবা রেলওয়ের কর্মকর্তা হওয়ায় তাদের বসবাস চট্টগ্রামে। রেল কর্মকর্তার ছেলে হওয়ায় সিআরবি, টাইগারপাস, লালখান বাজারসহ আশেপাশের এলাকায় ছাত্রাবস্থা থেকে ভালো অবস্থান ছিল লিমনের। এসব এলাকায় নিজের অনুসারী ছাত্রলীগের একটি গ্রুপও গড়ে তুলেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩-২০০৪ শিক্ষাবর্ষে লিমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। কিছুদিনের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলীর কারণে ছাত্রলীগের সামনের সারিতে চলে আসেন। কিন্তু ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যে কমিটি গঠিত হয় সেটি কার্যকর ছিল ২০১১ সাল পর্যন্ত। এর ফলে লিমন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিতে কোনো পদ পাননি। এদিকে লেখাপড়া শেষ হয়ে যাওয়ায় ২০১১ সালে গঠিত ছাত্রলীগের মামুন-খালেদ কমিটিতেও তার জায়গা হয়নি। এরই মধ্যে শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক গ্রুপ ‘একাকার’ কিছুদিন চলে লিমনের নেতৃত্বে। এরপর সেটা ভেঙে ‘সিক্সটি নাইন’ গড়ে তুলেন তিনি। বগিভিত্তিক গ্রুপগুলো ভেঙে দেওয়া হলেও সিঙটি নাইনের অঘোষিত নেতৃত্ব এখনও লিমন এবং তার অনুসারীদের হাতেই।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিতে ঠাঁই না মিললেও রিপন-রোটনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সদস্য হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিলেন লিমন। এরপর সোহাগ-নাজমুলের কমিটিতে সহ-সম্পাদক পদ পান তিনি। কিন্তু ২০১৩ সালের ২৪ জুন সিআরবিতে কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও জোড়া খুনের ঘটনায় এক অংশের নেতৃত্বদাতা হিসেবে লিমনের নাম চলে আসে। এরপর তাকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। সেই বহিষ্কারাদেশ আর প্রত্যাহার হয়নি ঠিকই, তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ চট্টগ্রাম নগরীতে ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে লিমনের জনপ্রিয়তা তৈরি হয়। বাড়তে থাকে তার অনুসারীর সংখ্যা। তবে তার অনুসারীদের মধ্যে একটি বড় অংশ কিশোর। তারা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ‘লিমন গ্রুপ’ নামে কিশোর গ্যাং গড়ে তুলেছে। মিছিল-সমাবেশে লিমনের জয়ধ্বনি দেয় তারা। সাথে এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতেও তাদের দেখা মিলে।
র্যাব-পুলিশের তালিকায় লিমনের নাম রয়েছে টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ হিসেবে। আর আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে তার রাজনৈতিক পরিচ্ছন্ন ইমেজ, রাজনীতিতে এগিয়ে যাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিবি দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার আলী হোসাইন বলেন, লিমনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও গ্যাং নিয়ন্ত্রণের নানা অভিযোগ আগে থেকেই ছিল। এছাড়া তার তথ্য মতে সজল দাশ (২৩) নামে তার এক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে জানিয়েছে, তার কাছে থাকা বিদেশি পিস্তলটি লিমনই রাখতে দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে রেলওয়ের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ শুরু হয় তার নেতৃত্বে। এতে তার শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ায় যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর বাবরের গ্রুপ। নিজের গ্রুপকে শক্তিশালী করতে এবং প্রতিপক্ষকে দমাতে টাইগারপাস, জামতলা বস্তি, বয়লার কলোনি, তুলাতলী বস্তির অপরাধী-মাদকসেবীদের নিজের দলে নিয়ে নেন লিমন। তাদেরও ছাত্রলীগের পরিচয়ে পরিচিত করা হয়। তাদের অধিকাংশই শিশু-কিশোর।
ইতোপূর্বে র্যাব-৭ চট্টগ্রাম তাকে চার দেহরক্ষীসহ গ্রেপ্তার করেছিল। সেই সময় লিমনের বাসা থেকে তিনটি ওয়ান শ্যুটার গান, একটা বিদেশি পিস্তল, সাত রাউন্ড গুলি এবং চারটি ম্যাগজিন উদ্ধার করা হয়েছিল। এদের মধ্যে সাদ্দাম ছিল তার গাড়ি চালক, বাকি তিনজন দেহরক্ষী।
রেলওয়ের কোটি টাকার দরপত্রের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ২০১৩ সালের ২৪ জুন যুবলীগের সে সময়ের কেন্দ্রীয় নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর এবং ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতা সাইফুল আলম লিমনের অনুসারীদের মধ্যে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর সিআরবি এলাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান যুবলীগ কর্মী সাজু পালিত (২৮) এবং স্থানীয় বস্তির শিশু মো. আরমান (৮)।
ঘটনার পর নগরীর কোতোয়ালী থানার এসআই মহিবুর রহমান বাদী হয়ে যুবলীগ-ছাত্রলীগের ৮৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার এজাহারে সাইফুল ইসলাম লিমনকে দুই নম্বর আসামি করা হয়েছিল। নিহত সাজু বিশ্বাসের মা পরে আরেকটি মামলা করেন আদালতে। আদালত দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই মামলায় ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর ৬২ জনকে আসামি এবং ৩৭ জনকে সাক্ষী করে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছিল নগর গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু আদালত অভিযোগপত্রটি গ্রহণ না করে পিবিআইকে অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পিবিআই অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। এতে ৬৪ জনকে আসামি ও ১৭ জনকে সাক্ষী করা হয়। এই প্রতিবেদনে লিমনকে দুই নম্বর আসামি করা হয়।
এ ঘটনার পর প্রথমবারের মতো জানাজানি হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রনেতাটি চট্টগ্রাম নগরী, বিশেষ করে সিআরবি, লালখানবাজার ও টাইগারপাস এলাকার আতংক।