রাউজান পশ্চিম গুজরায় প্রতিষ্ঠিত কালচারাল পার্ক–এর উদ্যোগে গত ২৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হলো কবিতা উৎসব ২০২৪। সুনয়ন মিলনায়তনে আয়োজিত এ উৎসবে আমার সঙ্গে চট্টগ্রাম থেকে উপস্থিত হয়েছেন বেশ কয়েকজন কবি ও আবৃত্তিকার। কবিতা উৎসব উপলক্ষ্যে আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে এ প্রতিযোগিতায় ছোটোরা ছাড়াও বড়রাও অংশগ্রহণ করেছেন। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তিন শাখায় শতাধিক প্রতিযোগী তাঁদের পরিবেশনা উপহার দেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন রাঙ্গুনিয়া হাসিনা জামাল ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক শীলা দাশগুপ্তা, কবি শিশুসাহিত্যিক উৎপলকান্তি বড়ুয়া, কবি মৃণালিনী চক্রবর্তী, কবি মর্জিনা আখতার, আবৃত্তি সংগঠক এস এম আবদুল আজিজ প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তিমির কান্তি বড়ুয়া।
আমরা যখন চট্টগ্রাম থেকে কালচারাল পার্কে পৌঁছলাম, তখন বিকেল সাড়ে চারটা। গাড়ি থেকে নেমেই সরাসরি অনুষ্ঠানে যাই নি। আমরা চলে গেলাম কালচারাল পার্কের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শনে। প্রতিষ্ঠাতা নান্টু বড়ুয়া আমাদের জানালেন এবং দেখালেন কী কী কার্যক্রম পরিচালিত হয় এখানে। সব কিছু মিলিয়ে অপূর্ব এক কমপ্লেক্স ‘কালচারাল পার্ক’, যা একক প্রচেষ্টায় টেনে নিয়ে যাচ্ছেন নান্টু বড়ুয়া। আমাদের সবচেয়ে ভালো লেগেছে লাইব্রেরিটি। খুব সুন্দর করে তাকে তাকে বইগুলো সাজানো হয়েছে। বিষয়ভিত্তিক বই। দেখে মন ভরে গেলো।
লাইব্রেরিকে বলা হয় জাতির মেধা ও মননের আঁতুড়ঘর; দেশের সকল মেধার সংগ্রহশালা। সময়ের প্রয়োজনে এই সংগ্রহশালাকে বিভিন্নভাবে প্রদর্শন ও প্রচার করা হয়ে থাকে। কখনো মেলার মধ্য দিয়ে, কখনো প্রজেক্টের মাধ্যমে। তাতে এই বিশাল জ্ঞানের ভাণ্ডার চলে আসে সকলের হাতের নাগালে। এর মাধ্যমে শিশুকিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ মানুষও এই বিশাল জ্ঞান–সমুদ্রের সাথে পরিচিত হওয়ার একটি বড় সুযোগ পায়।
কথায় আছে, যে জাতির পুস্তক সংখ্যা যত বেশি তার মেধাগত সমৃদ্ধিও তত বেশি। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি হলো ইউনাইটেড লাইব্রেরি অব কনগ্রেস। ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত এই লাইব্রেরিতে কী পরিমাণ বই আছে তা অনুমান করার জন্য তার একটি তথ্যই যথেষ্ট। তা হলো– এর একটি সেলফের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৪০ মাইল, যাতে বই ধারণক্ষমতা প্রায় ৯০ মিলিয়ন বা ৯ কোটি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ জন্যই বুঝি যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বের প্রধান পরাশক্তি। উল্লেখ্য, বিশ্বের প্রথম বইমেলাটিও অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ১৮০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে।
মানুষকে বইমুখী করে তোলার জন্য পাঠাগারের রয়েছে এক অসামান্য ভূমিকা। সকল বয়সের মানুষের জন্য এখানে থাকে উপযুক্ত বইয়ের পর্যাপ্ত কালেকশন। বাঙালি নাকি জতিগতভাবে আরাম ও প্রমোদপ্রিয়। জ্ঞানান্বেষণের উদ্দেশ্যে লাইব্রেরিতে গিয়ে বইপড়া ও বই সংগ্রহ করার ইচ্ছা ও সুযোগ অনেকেরই হয় না। যদি বইমেলার আয়োজন করা হয়, সে–উপলক্ষে প্রমোদ ও বইকেনা দু’টোই একসাথে হয়ে যায়। লাইব্রেরিতে যেসব দুর্লভ বই হাতের নাগালে পাওয়া যায়, ব্যক্তিগত সংগ্রহে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যে কোনো আয়োজনে সমবেত হওয়ার মননগত প্রবণতা আছে বাঙালির। লাইব্রেরি মানে শুধু বইয়ের সমাহার নয়, বইপ্রেমীদেরও মিলনক্ষেত্র। এতে মিলিত হওয়ার যে আনন্দ তা অন্যত্র পাওয়া যায় না। অধ্যাপক মাহমুদুল বাসার তাঁর এক প্রবন্ধে বলেন, ‘বইমেলায় বই কেনার গরজেই শুধু মানুষরা আসে না, আসে সাংস্কৃতিক পীঠস্থান, উৎসবে মিলিত হওয়ার আনন্দে। তারপর বইও কেনেন। যাঁরা মেলা থেকে বই কেনেন, তাঁরা কেউ কেউ হয়তো কোনোদিনও বই বিপণিতে গিয়ে বই কিনতেন না। এইটা বইমেলার গুরুত্ব।’ অন্যদিকে লাইব্রেরিতে গেলে বইয়ের যে অসীম সংগ্রহ, তা বই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সহায়তা পাওয়া যায়।
প্রমথ চৌধুরী বই পড়ার গুরুত্ব দিয়েছেন আর সৈয়দ মুজতবা আলী গুরুত্ব দিয়েছেন বই কেনার। বাঙালির বইকেনার প্রতি বৈরাগ্যকে তীক্ষ্ণ উপহাস করেছেন সৈয়দ মুজবতা আলী। বাঙালির সেই অনীহা অনেকটাই কেটে গেছে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠাসহ নানা উদ্যোগ ও বইমেলার বদৌলতে। যেমন বাংলা একাডেমির বইমেলায় হাজার হাজার মানুষ যাচ্ছে, বই কিনছে, গৌরবের প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে সমাগম হচ্ছে, মেলার তাৎপর্য উপলব্ধি করছে– সেটা অনেক বড় পাওয়া। লাইব্রেরি ও বইমেলা মানুষকে আনন্দমুখী করে। মেলায় গেলে বই কেনার তাগিদ অনুভব হয় আর লাইব্রেরিতে গেলে বই পড়ার জন্য মনের ভেতর অনুপ্রেরণা জাগে। ‘আরো বই পড়ুন’ নামে কবি জসীম উদদীনের একটি প্রবন্ধ আছে। এ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘আপনারা বই কিনলে আরো কী হবে জানেন? দেশের লেখকরা বই বিক্রি থেকে পয়সা পাবেন। দেশে একদল স্বাধীন–মত লেখক তৈরি হবে। তখন তারা যা ভাববেন তাই লিখতে পারবেন। দুর্বলের হয়ে, নিপীড়িতের হয়ে লড়াই করতে পারবেন। আপনাদের আশা–আকাঙ্ক্ষার ও আদর্শবাদের তারা রূপ দিতে পারবেন। দেশের অধিকাংশ লেখককে যদি জীবিকার জন্য সরকারের কোনো চাকরি করতে হয় তবে সেই সরকার কোনো অবিচার করলেও লেখক রুখে দাঁড়াতে পারেন না। লেখক স্বাবলম্বী হলে সে তো আপনারই লাভ। সরকারের সমালোচনা করে আপনাকে তবে জেলে যেতে হবে না। লেখকের বইগুলো সেই কাজ করবে। রুশো–ভলটেয়ারের লেখাগুলো তাদের দেশে মহাপরিবর্তন এনেছিল।’
লাইব্রেরিতে হাতের নাগালে একসাথে পাওয়া যায় সাহিত্যের সকল ভাণ্ডার। ফলে ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসের পড়ার বাইরে নানা স্বাদের বই সম্পর্কে চিন্তা করার সুযোগ পায়। তাদের চিন্তায় জ্ঞানের নতুন তৃষ্ণার জন্ম হয়। সব বয়সের পাঠকরা মেতে উঠতে পারেন জ্ঞান–সমুদ্রের সীমাহীন জ্ঞানাহরণে। তাই জাতীয় মেধা ও মনন গঠনে লাইব্রেরির গুরুত্ব অপরিসীম।
অমর একুশে ও ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে যে স্বতঃস্ফূর্ত বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে দেশে, তা এককথায় প্রশংসনীয়। কেননা, একে ঘিরে গল্প–কবিতা–উপন্যাস–প্রবন্ধ–শিশুসাহিত্যসহ সৃজনশীল লেখনী শিল্প ও প্রকাশনা শিল্পের সুবিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলছে দেশে, যার অর্থনৈতিক ব্যাপ্তি ও পরিধি কম নয়।
আবার বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তি–উদ্যোগে বা সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে লাইব্রেরি বা পাঠাগার। যে–গুলো জ্ঞান–সাধনায় বইপ্রেমীদের আন্দোলিত করছে।
কালচারাল পার্ক শুধু লাইব্রেরির কাজ নিয়ে চলছে না। আরো আরো কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এখানে। যেমন : আবৃত্তি শেখা, গান শেখা, চিত্রাংকন প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, শেখার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি প্রভৃতি। এসবের বাইরে সাহিত্যপাঠ ও সাহিত্যচর্চায় সংশ্লিষ্টদের উদ্বুদ্ধ করে আয়োজন করা হচ্ছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের, যা সত্যিই প্রশংসনীয়।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর : ৪২২), বাংলা একাডেমি।