গাজী স্যার ক্লাসে ঢুকতেই হইচই সব বন্ধ। একেবারে শান্ত পরিবেশ। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ বৃষ্টি থেমে গেলে যা হয়। স্যার চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব ছাত্রের চোখে একবার চোখ বুলিয়ে নেন। ব্যাস, তাতেই কাজ সারা। সবাই একেবারে সুবোধ বালক। যেন জীবনে লেখাপড়া ছাড়া আর কিছুই বোঝে না ওরা!
স্যার অস্টম শ্রেণির ক্লাস টিচার। পড়ান বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়। তবে এমন কড়া স্যার, শুধু ছাত্ররা নয়, স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকরাও ভয় পান। তাই গাজী স্যারকে সবাই আড়ালে বলেন- ‘মিলিটারি স্যার’।
আজ কোনো কথা ছাড়াই ব্ল্যকবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লিখলেন ‘জাতীয় শোক দিবস’। তারপর ছাত্রদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়েন, দিবসটি কত তারিখে পালিত হয়? ছাত্ররা সবাই হাত তুলল। স্যার মাধবের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেন, ‘তুমি বলো।’
‘পনেরই আগস্ট।’
‘ভেরি গুড। পনেরই আগস্ট কেন জাতীয় শোক দিবস, বলতে পারো?’ পেছনের বেঞ্চ থেকে বশর লাফিয়ে উঠে বলল, ‘ওইদিন রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বপরিবারে ঘাতকদের হাতে খুন হন। তাই পনেরই আগস্ট বাঙালির শোকের দিন।’
‘চমৎকার বলেছো। তা কত সালের ১৫ আগস্ট বলতে পারো?’
‘১৯৭৫।’ গাজী স্যার বশরের পিঠ চাপড়ে বলেন, ‘বাহ সালও মনে রেখেছো! গুড, ভেরি ভেরি গুড। পর পর তিনটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পেরে ছাত্ররা যেমন উৎফুল্ল, গাজী স্যারও খুব খুশি। পরবর্তী স্যার প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘বঙ্গবন্ধু প্রথমে কোন স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন, কে বলতে পারবে?’ সামনের বেঞ্চ থেকে দাঁড়িয়ে সাইম বলল, ‘গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্যার।’ এবারও সঠিক উত্তর পেয়ে স্যার মুচকি হাসেন। সঙ্গে সঙ্গে মিল্টনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন কত সালে?’
‘১৯২৭ সালে।’ পাশ থেকে তানজিম উঠে বলল, ‘১৯২৭ নয় স্যার, ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন বঙ্গবন্ধু।’ তানজিমের বলার ভঙ্গি দেখে স্যার বলেন, ‘তুমি এত জোর গলায় যে বলছো, এ তথ্য কোথায় পেলে?’
‘বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন স্যার।’
‘তাই নাকি! তা তুমি জানলে কিভাবে?’
‘বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে জেনেছি স্যার।’ গাজী স্যার বিস্ময়ে চোখ গোল করে বলেন, ‘বাহ! এই বইও পড়া হয়ে গেছে!’
‘পুরোটা এখনও পড়া হয়নি স্যার। আব্বু প্রচুর বই পড়েন। ভালো বই হলে আমাকেও পড়তে দেন।’ গাজী স্যার আবেগে আপ্লুত হয়ে তানজিমকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘সত্যি আজ আমার গর্ব হচ্ছে, আমাদের ছাত্ররা জাতির পিতাকে নিয়ে চর্চা করছে। তারা বঙ্গবন্ধুর বই পড়ছে। তবে বিখ্যাত এই বইটি কিভাবে লেখা হয়, কবে, কিভাবে ছাপা হয় সেসব গল্পও জানা দরকার। একজন মানুষ জীবনের চৌদ্দটি বছর বিনা বিচারে জেলখানায় বন্দি থেকেছেন, আবার সেই জেলখানায় বসেই নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা সাজিয়ে লিখেছেন। তবে সব ঘটনা লেখা সমাপ্ত হয়নি। তাই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। স্যার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলেন, জাতির পিতাকে সঠিকভাবে জানার জন্য বইটি আমাদের সবার পড়া উচিত।’
স্যার এবার চেয়ারে গিয়ে বসেন। একটু সময় নিয়ে সবার উদ্দেশে আবার বলেন, ‘আগামীকাল শোক দিবসে বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে রচনা ও কুইজ প্রতিযোগিতা হবে। তোমরা অংশ নিয়ে ভালো ফলাফল করবে এটাই আশা করি। তবে এ জন্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে খুঁটিনাটি জানা থাকা চাই।’
কথা বলতে বলতে গাজী স্যার নিজের চোখের চশমা খুলে শার্টের কোণায় কাচ মোছেন। তারপর আবার চশমাখানা নাকের ডগায় চাপিয়ে সবার দিকে একবার চোখ ঘোরান। সরাসরি আখতারের নাম ধরে বলেন, ‘কবে থেকে জাতির জনককে বঙ্গবন্ধু উপাধি কবে দেওয়া হয়েছে, বলতে পারো? আখতার নিরুত্তর। স্যার চেয়ার ছেড়ে উঠে আখতারের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে এক এক করে সবার চোখের দিকে তাকান। সবাই চুপচাপ। হঠাৎ পেছন থেকে অবিরন দাঁড়িয়ে বলল, ‘১৯৭১ সালে স্যার।’
‘না, হয়নি। উত্তর সঠিক না হলে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হবে কী করে! শেখ মুজিবুর রহমান কবে বঙ্গবন্ধু হলেন, তা তোমরা কেউ বলতে পারলে না!’ স্যার কিছুটা হতাশ হন। ছাত্ররাও লজ্জিত। সবাই মুখে বঙ্গবন্ধু বলছি, অথচ ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটা কবে হলো তারা কেউ বলতে পারছে না! পিনপতন নিরবতার মাঝে হঠাৎ তানজিম বলে ওঠে, ‘স্যার মনে পড়েছে। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি।’ গাজী স্যার ছুটে গিয়ে তানজিমকে জাপটে ধরে বলে ওঠেন, ‘সাবাস বেটা। সাবাস।’ স্যার আবেগতাড়িত হয়ে ঐতিহাসিক ঊনসত্তরের বর্ণনা দেয়া শুরু করেন-সে এক উজ্জ্বল সময় ছিল, দেশের মানুষের সে কী একতা! সবাই রাস্তায় নেমে টগবগ করে ফুটছে, হাত তুলে বজ্রকণ্ঠে স্লোগান দিচ্ছে-জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।
স্যার একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন-শেখ মুজিব তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেলখানায় বন্দি। পাকিস্তান সরকার জেলখানার মধ্যেই গোপন বিচার করে তাঁকে ফাঁসি দিতে চায়। কিন্তু চাইলেই কী সব হয়? বাঙালির ভালোবাসায় জাদু আছে। সেই জাদুর বলেই বাঙালি জেলখানা থেকে মুক্ত করে এনেছে প্রিয় নেতাকে। এরপর ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে গণসংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সেই সমাবেশে ঘোষণা করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু’। আর এই বঙ্গবন্ধুই বাঙালির মুক্তির রাজপুত্তুর। তিনি তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের করে দিয়েছেন মুক্ত স্বদেশি ও বিজয় পতাকার গর্বিত উত্তরাধিকারী। তিনি শুধু বাংলাদেশকেই গড়ে তুলেছেন তা নয়, বিশ্ব দরবারে বাংলা ও বাঙালিকে নিয়ে গেছেন উচ্চতর আসনে।’ বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের ঋণ কখনো শোধ হবার নয়….।’ বলতে বলতে স্যার হাঁপিয়ে ওঠেন। তবুও কথা ফুরায় না। ছাত্ররাও অসীম ধৈর্য আর শ্রদ্ধাভরে শুনে বাঙালির মুক্তির রাজপুত্তুরের দীর্ঘ সংগ্রামের কাহিনী।