মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর চট্টগ্রাম ও এ শহরের নারী

বিচিত্রা সেন | বৃহস্পতিবার , ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ


চট্টগ্রাম : বীর চট্টগ্রাম!
বিক্ষত বিধ্বস্ত দেহে অদ্ভুত
নিঃশব্দ সহিষ্ণুতা
আমাদের স্নায়ুতে স্নায়ুতে
বিদ্যুৎপ্রবাহ আনে, আনে আজ
চেতনার দিন।
চট্টগ্রাম : বীর চট্টগ্রাম! -সুকান্ত ভট্টচার্য্য

চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত এক জনপদ। যার দক্ষিণ পাশ ঘিরে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এছাড়াও পুরো চট্টগ্রামকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য পাহাড় এবং নদী। সাগর, নদী, পাহাড়ঘেরা এমন অপরূপ শহর আর কোথাও নেই বাংলাদেশে। চট্টগ্রামের সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি কিছুটা রক্ষণশীল হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ শিক্ষার ক্ষেত্রে একসময় কিছুটা অনগ্রসর ছিল। যদিও তারা অর্থনৈতিকভাবে ছিল বেশ স্ব‘ছল। যেখানে গড়পড়তা পুরুষ শিক্ষার প্রতি আগ্রহী ছিল না, সেখানে নারীদের অবস্থান ছিল আরও করুণ। তবে মুক্তিযুদ্ধের পর পরিবর্তনের হাওয়া চট্টগ্রামেও এসে লেগেছিল। তাই যুগের প্রয়োজনে সামাজিক বাধাকে দূরে ঠেলে অনেক অভিভাবক তাঁদের মেয়েদেরকে স্কুলে পাঠানো শুরু করেন। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ সংখ্যা অধিক হলেও আশির দশক পর্যন্ত মাধ্যমিক এবং উ‘চ মাধ্যমিকে তা সন্তোষজনক ছিল না। তবে নতুন স্বদেশ পাওয়ার উন্মাদনায় এসময় বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার প্রসার ঘটাতে পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠে অনেক ক্লাব। যার বেশিরভাগই ছিল অরাজনৈতিক সংগঠন। এসব ক্লাবে খেলাধুলার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হতো। রক্ষণশীলতার বেড়া ডিঙিয়ে পাড়ার এসব ক্লাবে চট্টগ্রামের মেয়েরা অংশগ্রহণ করতো। তবে এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, এসব মেয়েদের বেশিরভাগই ছিলো হিন্দু এবং বড়ুয়া সমপ্রদায়ের। মুসলিম মেয়েরা এসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলেও তাদের সংখ্যা ছিল আনুপাতিক হারে কম।
শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি চট্টগ্রামের নারীরা এসময় এগিয়ে এলেন ক্ষুদ্রশিল্প এবং কুটির শিল্পেও। ওইসময় বাংলাদেশের মেলাগুলোতে এসব শিল্পজাত পণ্যের কদর ছিল বেশি। যার বেশির ভাগই উৎপন্ন হতো নারীদের হাতে। এসব পণ্য দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হতো। সুখের বিষয় নব্বইয়ের দশকে কিছু নারী উদ্যোক্তার দেখা মেলে এ চট্টগ্রামে।
মাত্র ৩০ জন নারীকে নিয়ে চিটাগাং উইমেন এন্টারপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন সংগঠনটি গড়ে তোলা হয়। উদ্দেশ্য ছিল নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা। এছাড়া তাদের আরও একটি মহৎ উদ্দেশ্য ছিল, তা হলো নারীদেরকে কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষ করে গড়ে তোলা। ২০০৩ সালে এই সংগঠনটি উইমেন চেম্বার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। উইমেন চেম্বারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মনোয়ারা হাকিম।
আশির দশকে ‘দেশ’ গার্মেন্টস এর মাধ্যমে চট্টগ্রামে পোশাকশিল্পের উদ্ভব ঘটার সাথে সাথে নারীমুক্তির পথে এক বিপ্লব ঘটে যায়। এ শিল্পের তরুণ উদ্যোক্তারা প্রথম থেকেই তাঁদের কর্মী নির্বাচনে নারীদের প্রাধান্য দেন। শ্রমিক আন্দোলনের নামে পাটশিল্প এবং ইস্পাতশিল্প ধ্বংস করে দেওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা প্রথম থেকেই নারী শ্রমিকদের নিয়োগ দিয়ে এক নীরব বিপ্লব ঘটান। পোশাকশিল্পের এই নারী শ্রমিকরা নারী প্রগতির নীরব দিশারী। চট্টগ্রামের গ্রামজীবনের সংস্কারাবদ্ধ রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নারীরা দলে দলে পোশাকশিল্পে যোগ দেন। আর মাত্র দশ বছরের মাথায় তাঁরা চট্টগ্রামের সমাজ ব্যবস্থাকেই পাল্টে দেন। উদয়াস্ত শ্রম খেটে একদিকে যেমন তাঁরা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন, তেমনি সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে কৃ‘ছতা পালন করে তাঁরা বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকেও নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। সুতরাং নারী প্রগতি মানেই যে শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীর এগিয়ে যাওয়া তা কিন্তু নয়। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে দৃপ্ত পদক্ষেপে নারীদের নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখাই প্রকৃত নারী প্রগতি। আর পোশাক শিল্পের নারীদের শ্রমের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আজকের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার পথে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ।
শিল্পসাহিত্যে চট্টগ্রামের নারীরা মধ্যযুগ থেকেই ভূমিকা রেখে আসছিলেন। শ্রীমতী রহিমুন্নেসা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আধুনিক যুগেও চট্টগ্রামের নারীরা হাতে কলম তুলে নিয়েছেন, যদিও জাতীয় ক্ষেত্রে তাঁরা বার বার উপেক্ষিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সাহিত্যচর্চায় চট্টগ্রামের নারীদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় লেখিকা উমরতুল ফজলের কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি জুবিলী রোড, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও ঘুরে ঘুরে মহিলাদের মনে সাহস সঞ্চার করে বেড়াতেন। দাঙ্গা রোধে মহিলাদের সংগঠিত করা তাঁর একটা স্মরণীয় কাজ। আজীবন তিনি অসামপ্রদায়িকতাকে লালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি পদ অলংকৃত করেন। তিনি লেখিকা সংঘেরও নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৮৬ সালে লেখিকা সংঘের জাতীয় সম্মেলনে এক পর্বে তিনি সভানেত্রী ছিলেন। বাবার বাড়ি এবং স্বামীর বাড়ি উভয়ক্ষেত্রেই তিনি পেয়েছিলেন সাহিত্যিক পরিমণ্ডল। তাই কবিতা এবং কথাসাহিত্য দুদিকেই তিনি বিচরণ করেছেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ কাব্যগ্রন্থ হলেও তিনি উপন্যাস এবং ছোটগল্পও রচনা করেন। তাঁর রচনাতে একদিকে যেমন পাওয়া যায় নারীদের বিকশিত হওয়ার আকুলতা, তেমনি অন্যদিকে পাওয়া সমকালীন সমাজবাস্তবতাও।
চট্টগ্রামের নারী প্রগতির পথে আরেক আলোর দিশারী বেগম মুশতারী শফী। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই তিনি নারীদের নিয়ে কাজ করতেন। ‘বান্ধবী সংঘ’র মাধ্যমে তিনি নারীদের একত্রিত করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর কথাসাহিত্য যেমন সমাজের মুখোশ উন্মোচন করেছে, তেমনি প্রবন্ধগুলোও ছিল একেকটা তীক্ষ্ণ চাবুক। তাঁর সবচেয়ে সাহসী কাজ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃত্ব দেওয়া। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে এ আন্দোলন সারাদেশে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর এ দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় বেগম মুশতারী শফীকে। তিনি শুধু চট্টগ্রামের দায়িত্বটা নেন। তাঁর নেতৃত্বে এ আন্দোলন চট্টগ্রামে তীব্রতর হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে যদিও নানা কারণে এ আন্দোলন স্তিমিত হতে হতে স্তব্ধ হয়ে যায়, কিন্তু বেগম মুশতারী শফী হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার প্রতীক। তিনি একজন বিশিষ্ট লেখিকাও। তাঁর সাহিত্যে বার বার উঠে এসেছে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এসেছে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট। তিনি নিপুণ দক্ষতায় সুবিধাবাদী শ্রেণির মুখোশ উন্মোচন করেছেন। তিনি বাংলা একাডেমি সম্মাননা ফেলোশিপ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন প্রদত্ত অমর একুশে সম্মাননা পদকসহ আরও অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন।
চট্টগ্রামের নারী প্রগতির আরেক ধারক ও বাহক হলেন রম্য লেখক ফাহমিদা আমিন। তিনি বাংলা সাহিত্যে রম্য রচনায় নারী লেখকদের যে ঘাটতি আছে, তা একাই পূরণ করেছিলেন। তাঁর লেখায় তিনি সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোকে চিহ্নিত করে তা নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন। এ ধারার তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘নিমমধু’। ‘কুট্টিবিবির আসর’ তাঁর আলোচিত গ্রন্থ। চট্টগ্রামের নারী সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি স্বতন্ত্র স্থান দখল করে আছেন।
রমা চৌধুরী চট্টগ্রামের নারী হলেও তাঁর পরিচিতি সারাদেশ জুড়ে। তাঁর স্বতন্ত্র জীবনযাত্রা এ পরিচিতির প্রধান কারণ। একাত্তরের বীরাঙ্গনা এ মহীয়সী নারী তাঁর সমস্ত ক্ষোভ ও যন্ত্রণাকে প্রকাশ করতে হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। তাঁর প্রকাশিত বই পাঠকের কাছে তুলে দিতে তিনি বেছে নিয়েছিলেন এক অভিনব পথ। সারা শহর ঘুরে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে তিনি বই বিক্রি করতেন। গল্প, উপন্যাস, কবিতায় তিনি আত্মকাহিনি প্রচার করলেও তাঁর প্রবন্ধগুলো ছিল বেশ শক্তিশালী।
চট্টগ্রামের নারীদের মধ্যে যে কয়জন নারী তাঁদের মেধা, শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব এবং কর্মকুশলতা দিয়ে নিজের যথাযোগ্য স্থান করে নিয়েছে তাঁদের মধ্যে অধ্যক্ষ আনোয়ারা আলম অন্যতম। তাঁর প্রধান ক্ষেত্র প্রবন্ধ ও গবেষণা হলেও কথাসাহিত্যেও তাঁর পদচারণা রয়েছে। তাঁর গল্পগুলোতে একদিকে যেমন ফুটে উঠেছে সমাজের চলমান চিত্র, তেমনিভাবে আছে ইতিহাসচেতনা। নারীলেখক হিসেবে নারী মনস্তত্ত্বেরও নিখুঁত রূপায়নকারী তিনি। তাঁর চরিত্রগুলো মননে ও কর্মে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে।
চট্টগ্রামের নারীরা লেখালেখিতে বরাবরই সক্রিয়। ফেরদৌস আরা আলীম, এলিজাবেথ আরিফা মুবাশ্‌শিরা, তহুনীন সবুর ডালিয়া, দীপালী ভট্টাচার্য, বদরুননেসা সাজু, সেলিনা শেলী তেমনি একেকটি নাম, যাঁরা আলোর প্রদীপ হাতে সমাজকে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন।
চট্টগ্রামের নারী সঙ্গীতশিল্পীদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় শেফালী ঘোষ এর কথা। তাঁর খ্যাতি ছিল গগনচুম্বী। এছাড়াও কল্যাণী ঘোষ, উমা চৌধুরী (খান), কান্তা নন্দী, ফওজিয়া সুলতানা, হৈমন্তী রক্ষিত, নিশিতা বড়ুয়া, বিউটি, রন্টিসহ আরও অনেক নারীশিল্পী বাংলা সঙ্গীতাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছেন।

সিনেমা, মঞ্চনাটক কিংবা থিয়েটারে চট্টগ্রামের নারীরা বরাবরই অগ্রগামী। সামাজিক রক্ষণশীলতাকে অস্বীকার করে কবরী, শাবানা, কাজরী, অঞ্জু ঘোষ একসময় ঢাকাই সিনেমার পর্দা কাঁপিয়েছেন। তাছাড়া চট্টগ্রামের নারী থিয়েটারকর্মীরা তাঁদের প্রতিভা দিয়ে জাতীয় পর্যায়েও সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
একসময় চট্টগ্রামের মেয়েরা নৃত্যশিল্পে অনাগ্রহী হলেও আশির দশক থেকে কিছু কিছু মেয়ে এ শিল্পে এগিয়ে আসে। আর্যসঙ্গীত, সঙ্গীত পরিষদ এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আল্পনা ব্যানার্জি, রঞ্জনা ব্যানার্জি, কস্তুরী দেব, সোমা দাশগুপ্তা, কমলিকা চক্রবর্তী একসময় চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বেশ পরিচিত মুখ ছিলেন। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংগঠন নৃত্যশিল্পকে উৎসাহিত করতে থাকে। বর্তমানে চট্টগ্রামের শিল্পাঙ্গনে নৃত্য একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। প্রমা অবন্তী, শুভ্রা সেনগুপ্তা প্রমুখ নারীশিল্পী এ ধারায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।
চট্টগ্রাম এর সাহিত্য সংস্কৃতিতে নারীদের জোরালো অংশগ্রহণ শুরু হয় মূলত নব্বইয়ের দশক থেকেই। এসময় শিক্ষাক্ষেত্রেও নারীরা তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। পেশাগত জীবনে চট্টগ্রামের নারীরা একসময় মূলত শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে নিতেন। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে নারীরা অন্যান্য পেশাতেও ছড়িয়ে পড়েন। তার মধ্যে যেমন আছে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী তেমনি আছে সাংবাদিক, পুলিশ, বিচারকও।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে চট্টগ্রামের নারীরা ব্যাপকভাবে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। এসময় বোর্ডের মেধাতালিকায় মেয়েরা ছেলেদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগেও মেয়েরা মেধাতালিকায় স্থান পেতে শুরু করে। এসময় নারীদের পেশাগত পরিধি আরও বেড়ে যায়। ব্যাংক এবং পুলিশবাহিনীতেও চট্টগ্রামের মেয়েরা যোগ দিতে থাকেন। রক্ষণশীল এবং অশিক্ষায় আচ্ছন্ন বলে চট্টগ্রামের নারীদের যে বদনাম ছিল তা ভেঙে ফেলে এ অঞ্চলের নারীরা সমাজের সর্বক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিভার পরিচয় দিতে থাকেন। বর্তমানে চট্টগ্রামের রাস্তাঘাটে, শিক্ষাঙ্গনে, অফিস আদালতে নারীর দৃপ্ত পদচারণা দেখা যায়। অথচ আশির দশকেও চট্টগ্রাম শহরে নারীর চলাচল ছিল সীমিত পরিসরে। নারীরা যেমন শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন, তেমনি কর্মক্ষেত্রেও এগিয়ে এসেছেন। নির্মাণশ্রমিক থেকে শুরু করে বড় বড় প্রশাসনিক পদে প্রমীলারা তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সফলভাবে পালন করছেন।
চট্টগ্রামের নারীরা সামাজিকভাবে রক্ষণশীল বলয়ের বাসিন্দা হলেও রাজনৈতিক আন্দোলন, সামজিক আন্দোলনে বরাবরই অংশগ্রহণ করেছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন চট্টগ্রামে নারীদের ভূমিকা ছিল অনন্য। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণে আমরা সে সব তথ্য আগেই জেনেছি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও চট্টগ্রামের নারীরা ছিল নতুন সমাজ গঠনে তৎপর। এসময় তাঁরা বিভিন্ন নারীজাগরণমূলক সংগঠন গড়ে তুলে নারীদেরকে সংগঠিত করতে চেয়েছেন, যা আজও বহমান। বর্তমানে চট্টগ্রামের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর সরব পদচারণা চোখে পড়ে। শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, ইন্ডাস্ট্রি সবক্ষেত্রে চট্টগ্রামের নারীরা তাঁদের মেধার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন-
‘কোনো কালে একা হয়নি কো জয়ী
পুরুষের তরবার শক্তি দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী নারী’।
তবে একবিংশ শতাব্দীর সিকিভাগ পেরিয়ে আমরা দেখছি নারী শুধু এখন প্রেরণা আর নেপথ্য শক্তির আধার নয়, নারী এখন নিজেই কর্ণধার। আমরা চাই সমস্ত কুপমণ্ডূকতাকে পায়ে মাড়িয়ে চট্টগ্রামের নারীরা সমাজ তথা রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে তাঁদের বিজয়নিশান উড়াক।
লেখক : কথাসাহিত্যিক; অধ্যাপক, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাদায় ভরা দুর্ভোগের সড়ক
পরবর্তী নিবন্ধরমেশ শীলের মরমী গান