রমেশ শীলের মরমী গান

ইকবাল হায়দার | বৃহস্পতিবার , ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ


চারণ কবি রমেশ শীল, রমেশ চন্দ্র শীল, রমেশ চন্দ্র সরকার, কবিয়াল রমেশ শীল যে নামেই ডাকিনা কেন তিনি একাধারে ছিলেন কবি, কন্ঠ শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, কবিয়াল। জন্ম ১৮৭৭ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পূর্ব গোমদন্ডী গ্রামে আর মৃত্যু ১৯৬৭ সালে। কবি গানের ভূবনে কিংবদন্তীর নায়ক,মরমী গানের ধারায় মাইজভান্ডারি গানের সফল সংযোজক, একুশে পদক প্রাপ্ত এ কবিয়াল শুধু মাইজভান্ডারি গানের গীতিকার ছিলেন না, তিনি একাধারে রচনা করেছেন, গেয়েছেন ভাষার গান, দেশের গান,মাটি ও মানুষের গান,জাগরণের গান, গণসংগীত, মরমী গান, আঞ্চলিক গান সহ অনেক সমাজ বিদ্রুপার্থক গান। তাঁর সকল সৃষ্টিকে ছাড়িয়ে এই কবিয়াল মাইজভান্ডারি গানের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তাঁর রচিত ব্যাপক দৃষ্টি আকর্ষণীয় তিন শতাধিক মাইজভান্ডারি গানের সৃষ্টকর্ম আধ্যাত্মিকতার এক উচ্চমার্গীয়, কালোত্তীর্ণ প্রতিভার বিরল স্বাক্ষর। তিনি মাইজভান্ডারি গানে মাইজভান্ডারি ত্বরীকার বাণীবাহক আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ, মহিমান্বিত ও সুগভীর ইতিহাস- ঐতিহ্য সম্পর্কিত শব্দ ব্যবহার করেছেন প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস ও স্বার্থক পরিপূর্ণতায়। ফলে সাধারণের মাঝে মাইজভান্ডারি গানের যথাযথ মাহাত্ম্য উপলব্ধি ও হৃদয়ঙ্গম এবং একে পরিপূর্ণভাবে আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে এক প্রাঞ্জল আবহ সৃষ্টি করেছেন ।
তাই তাঁর তিন শতাধিক মাইজভান্ডারি গানের সৃষ্টি এ দেশের মরমী গানের জগৎকে আশ্চর্যজনকভাবে প্রভূত সমৃদ্ধ করেছেন। উদার, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক এ গান সংগীত জগতে এক নতুন জোয়ারের সৃষ্টি করে সাধন সংগীতকে নিয়ে আসেন লোকসংগীতের কাতারে, জনপ্রিয় করে তোলেন যুগপৎ দরবারে ও সুধী মহলে।
কবিয়াল রমেশ শীলের সাধনা, হেকমতি ও অনুষঙ্গ হিসেবে মাইজভান্ডারি গানের উদ্ভব ও বিকাশ। মাইজভান্ডারি গানের মেজাজকে পরিপূর্ণ মাত্রায় ধারণ,লালন ও প্রতিপালনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার আবহকে পুরোপুরি অক্ষুন্ন রেখে বাংলার লোকসংগীতের স্রোতধারার সাথে সমন্বিত করেছেন মর্যাদাপূর্ণ ভাবে।
তাঁর রচনায় শব্দ সৌন্দর্য, বাক্যসৌন্দর্য, ভাবের পরিপূর্ণতায়, সুরের মাধুর্যে, গঠনশৈলীর সম্বৃদ্ধিতে, হৃদয়গ্রাহী এই মাইজভান্ডারি গান। দরবারের মহিমাবন্দনায় এ সকল গানের পরতে পরতে প্রকাশ পেয়েছে ভক্তি, ভাব, সুর, রস, দয়া, নুরের ঝলক, গূণ, প্রেম, মায়া, সাধনা, রূপ, আশেক রসিকের প্রেম, বিশ্বাস, ভক্তি, তাল, শ্লীলের, স্বপ্নের, নিবেদন, আবেদনের, আকুতি, মিনতির অসাধারণ রূপ মাধুর্য ।
এ সকল মাইজভান্ডারি গানের ভাব, মর্ম তাই সর্বোত্তম শব্দে, অর্থে , বিবিধ অভিধায় পরিপূর্ণভাবে পরিস্ফুটিত। তাঁর সকল আধ্যাত্মিক সৃষ্টির মাঝে ইসলামী ভাবের, চেতনার, শব্দের, ধারণার, ভক্তির যে সফল প্রয়োগ তা নিম্নোক্ত গানে পরিপূর্ণভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে ঃ
“মাঝি ত্রিবেণীর ঘাটেরে জোয়ার ধরি যাইও
ভান্ডারীর বর্জকে তরী ধীরে ধীরে বাইওরে।
প্রথম ঘাট নাছুতের বাজার হুশিয়ারে রইও
সেই ঘাটে ডাকাইতের মেলা মূল হারাইবা চাইয়
তাপরে মলকুতের শহর দিশা ঠিক রাখিও
ডাইনে বায়ে চন্দ্র সৃর্য মধ্যদি চলিও।
যব্‌রুতে বাতাসের খেলা বাদাম উঠাই দিও
নিলক্ষের বাঁক দৃষ্টি করি ছুপানটি ধরিও রে।।
রমেশ কয় লাহুতের ঘাটে দিদারে পৌঁছিও
পীর মুরিদে এক রঙ ধরি আনন্দে কাটাইও রে।।
অন্যগানে অধরার রূপ, মুর্শিদের ভাবরূপ, সর্ব ধর্মের ধারণা এ ভাবেই বর্ণনা করেছেন,
“তারে ভক্তিভাবে করলে দরশন
যীশু দেখে খ্রিষ্টানেরা ফয়া বৌদ্ধগন
হিন্দু দেখে মদনমোহন
শ্রীনন্দের কালোসোনা
আঠার আলমে আমার বাবা মওলানা”।
১৯৭৪ সালের কথা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিশাল অনুষ্ঠান, দেশের বাঘা বাঘা শিল্পী ছাড়াও এসেছেন ভারতের বিশ্বকাপাঁনো শিল্পী পূর্ণচন্দ্র দাশ বাউল। তাঁর মঞ্চ কাঁপানো গানের পর এমন পরিস্থিতি হল কোন শিল্পী স্টেজে ওঠার আর সাহস করেনা, কঠিন এক পরিস্থিতিতে ঘোষণা আসল, এখন সংগীত পরিবেশন করবেন চট্টগ্রামের শিল্পী রশিদুল আনোয়ার (বর্তমানে প্রয়াত প্রকাশ রতন ভান্ডারী)।
দর্শকদের মাঝে চাপা গুঞ্জনের মাঝে শিল্পী গান ধরলেন,
“এয়া মওলা,
গাউসুল আজম বাবা নুরে আলম
তুমি ইসমে আজম বাবা ত্বরানে লয়ালা।”
একি গান! এ গানতো আগে কেউ শোনেনি!
গান জমে উঠল, শুরু হল তালে তালে তালি।
ডাবল দাদরায়, ঝুমুর তালে সেকি অবস্থা! সারা মাঠে যেন ঝড়ের পর টর্নেডো বয়ে গেল! দর্শক মঞ্চে এই প্রথমবার শুনলো দরবারের ফকিরি গান ।
এ গানের রচয়িতা আর কেউ নন রমেশচন্দ্র শীল।
একই বছর মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে বিশাল এক সংগীতের আয়োজন। দেশের সেরা সেরা শিল্পীদের বসিয়ে রেখে চট্টগ্রামের শিল্পী তাজুল ইমাম সারা হল মাত করে ছিলেন এ গান গেয়ে ঃ
“বাবা মওলানা মওলানা মওলানা রে
নুরের পুতলা বাবা মওলানা।
এই ভুবনে দিতে নাইরে তুলনা
দীন দনিয়ার মালীক বাবা মওলানা”
এ গানেরও রচয়িতা আর কেউ নন রমেশ চন্দ্র শীল। পরবর্তীতে আযম খান, ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর সহ পপ গানের নামে,ব্যান্ড সঙ্গীতের যে স্রোত পশ্চিমা তালে, বিটে যন্ত্রের প্রয়োগে সারা দেশের সংগীতে য মহা ঝড়, তান্ডব, আন্দোলন তুলেছিল তা এই মাইজভান্ডারি গানেরই তুমুল জোয়ারে ঝড়ে।
যে গানগুলি সারা দেশের সংগীতপ্রেমী হৃদয় কে টালমাটাল করেছিল তার মধ্যে উল্লেখ করার মত গান,
১ : গাউসল আজম বাবা নুরে আলম।
২ : স্কুল খুইলাছেরে বাবা স্কুল খুইলাছে।
৩ : ওকি চমত্‌কার ভান্ডারেতে আজগুবি কারবার।
৪ : এলে তুমি হৃদ মাজারে ভক্তের প্রাণ ঢেউ খেলায় ।
৫ : রসিক রতন ভান্ডারী রসিক রতন ।
৬ : বাবা মওলানা মওলানা মওলানা রে ।
রমেশ শীলের এই গান গুলি এখনো সমান জনপ্রিয় অত্যাশ্চর্যভাবে।
সকল গানে কি অসাধারণ নতুনত্ব, কথায়, সুরে, তালে, ভাবে, অর্থে ও শব্দের
নান্দনিক প্রয়োগে পেল মানুষ, শ্রোতা, দর্শক ।
তালে কথা বলে, ‘হু,আল্লাহ্‌ হু’।
বাংলার লোকসংগীতকে পল্লী ও শহর অঞ্চলে সমানভাবে পরিচিত করা, জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে এবং মাইজভান্ডারি গানকে মাইজভান্ডারি পরিমন্ডলের পাশাপাশি সুধী সমাজে পরিচিত ও জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে রমেশ শীলের অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তিনি আধ্যাত্মিক ভাবধারায় রচিত মাইজভান্ডারি গানের সফল রূপকার ও প্রচারক যা ছিল মাইজভান্ডার দরবার ভিত্তিক ।
মাইজভান্ডারী ত্বরীকার উদার, মানবিক, অসাম্প্রদায়িক বক্তব্যে আকর্ষিত হয়ে অন্যান্য ধর্মের লোকজনও এই তরীকার প্রতি প্রবল আকর্ষণে ঝুঁকে পড়ে।
১৯২৩ সালের কথা, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানায় ‘সুফিবাদের জাগ্রত কেন্দ্র’মাইজভান্ডার দরবারে গদীনশীন কিংবদন্তীর আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ সৈয়দ গোলাম রহমান ( বাবা ভান্ডারী) যার আধ্যাত্মিক মহিমা এতই উচ্চ মার্গের ছিল যে, যে কেহ তার সংস্পর্শে ,এমনকি প্রত্যক্ষদর্শী হলেও তার মধ্যে আধ্যাত্মিকতার জোয়ার বয়ে যেত। প্রতি বছর মাঘ মাসে সেখানে ওরসে মানুষের মেলা বসে।১৯২৩ সালে রমেশ শীলের এক প্রতিবেশী সারদাচরণ দে তাঁকে মাইজভান্ডর নিয়ে যান। তাঁর ভাষায়, ‘ আমি কি শুভ মুহুর্তে শ্রীযুক্ত সারদা বাবুর সংগ নিয়েছিলাম তাহা বাবাজান ভিন্ন অন্য কেহ জানিবার কারণ নাই’।
দরবারে পৌঁছার পর বাবার দরশনে রমেশ শীলের শরীরে যেন এক বিদ্যুতের আবহ খেলে যায়, তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।তিনি প্রত্যক্ষ করলেন, গদির পরে এক উজ্জ্বল নির্বাক পুরুষ, সিদ্ধ বলে মেনে নিলেন।এই সিদ্ধ পুরুষকে দেখে গান রচনার কথা মনে হল রমেশের ।
স্বয়ং রমেশ বলেন,’ তথায় উপস্থিত হওয়া মাত্র প্রাণ যেন কি একটা অনির্বচনীয় আনন্দ হিল্লোলে খেলিতে লাগিল এবং কে যেন কানে কানে বলিল,” রমেশ এই মাইজভান্ডারের ভক্তদের তোর গান শুনাইতে হইবে।প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল,শরীর আড়ষ্ট ঽইল,সেইখানে গান তৈরি করলাম।
(ভূমিকাংশ-আশেকমালা)।
ডঃ সেলিম জাহাংগীর এর ভাষায়,’আবহমান বাংলার লোকসংগীতে র ধারার সাথে মাইজভান্ডারি গানকে মর্যাদাপূর্ণভাবে সুসমন্বিত করার এক অবিস্মরণীয় দায়িত্ব পালন করেছেন ‘মাইজভান্ডারি গানের সাংস্কৃতিক দূত’ কবিয়াল রমেশ শীল’ ।
রমেশ শীল মাইজভান্ডারি গানের উদ্ভবের মেজাজকে পুরোপুরি অক্ষুন্ন রেখে গুণগত বিচারে কালোত্তীর্ণ, উচ্চ মার্গের ৩২৩ টি মাইজভান্ডারি গান রচনা করেছেন যা আটটি বইয়ে প্রকাশিত(অপ্রকাশিত আরো থাকতে পারে) যা নিম্নে উপস্থাপন করা গেল।
যেমনঃ
এক আশেক মালা ৪২ টি গান।
দুই- শান্তির ভান্ডার ৩৯ টি গান।
তিন-মুক্তির দরবার ৩৮ টি গান ।
চার- নুরে দুনিয়া ৪০ টি গান।
পাঁচ- জীবন সাথী ৩৯ টি গান।
ছয়- সত্য দর্পণ ৪২ টি গান ।
সাত- ভান্ডরে মওলা ৪৩ টি গান।
আট- মানব বন্ধু ৪০ টি গান।
এখানে উল্লেখ্‌ করা প্রয়োজন যে, অনেকের ভুল ধারণা,
‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করলিরে বাঙালি
তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’
এবং
‘আমি বন্ধুর প্রেমাগুনে পোড়া ‘
বহুল প্রচারিত, শ্রুত, জনপ্রিয়, কালজয়ী এ গান দুটি রমেশ শীলের রচনা, আসলে প্রথমটির রচয়িতা বাগের হাটের চারণ কবি শেখ শামসুদ্দিন ও সুরকার আব্দুল লতিফ এবং দ্বিতীয়টির রচয়িতা, সুরকার ও শিল্পী কানাইলাল শীল ।
রমেশ শীলের রচনায় কোরান, পুরান,বাইবেল, গীতার প্রভূত প্রভাব দৃশ্যমান। রমেশ সয়ং বলেন, এক বিনা দ্বিতীয়ে নাস্তি সকল ধর্মের একই তত্ত্ব।
শরীয়ত, মারিফাত, তরিকত, হকিকত সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানে পরিপূর্ণ এই গীতিকার, শিল্পী, কবিয়াল। তার উপদেশ মোতাবেক তাই তাঁকে চিতায় না পুড়িয়ে কবরস্থ করা হয় ।
মাইজভান্ডারি গানের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর প্রতিভা কবিয়াল রমেশ শীল। তিনি আবহমান বাংলার লোকসংগীতের পাঠক, গবেষক, সংগীত শিক্ষক, শিল্পী, শ্রোতা সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে দিয়ে গেছেন কালোত্তীর্ণ, উচ্চ মার্গের মাইজভান্ডারি গান রূপে মরমী, আধ্যাত্মিক ভাবধারায় রচিত মাইজভান্ডারি গান যা বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে, মানুষের হৃদয়, মনে স্থায়ী আসন লাভ করেছে।
লেখক : সংগীতশিল্পী, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধ-উত্তর চট্টগ্রাম ও এ শহরের নারী
পরবর্তী নিবন্ধআঁরার ঐতিহ্য আঁরার নুন