১. হাইপার থাইরয়ডিজম: গর্ভবতী মা যদি থাইরয়েড হরমোনের আধিক্যজনিত অসুখ হাইপার থাইরয়ডিজমে ভোগেন, বিশেষত গ্রেভস রোগে, তবে গর্ভফুলের মাধ্যমে গর্ভস্থ সন্তানে নানা প্রভাব পড়ে। ১ থেকে ২ শতাংশ সন্তান থাইরয়েড হরমোনের আধিক্যজনিত নানা দেখা দেয়। যেমন-নবজাতক শিশুতে অতিরিক্ত হৃদস্পন্দন, হার্ট ফেলিউর, বমি, ডায়রিয়া এবং ওজনে না বাড়া (শিশু পরিমাণ মতো বুকের দুধ পান ও খাবার গ্রহণে সকাষম থাকার পরও), হাত-পায়ের অনৈশ্চিক সঞ্চালন (জিটারিনেস), গলগণ্ড, অক্ষিগোলকদ্বয় বাইরের দিকে বেশি বেরিয়ে আসা (এক্সোলথেলমাস)। এসব উপসগার্দি বিশেষ করে শিশুর প্রথম দুই সপ্তাহ বয়সে দেখা যায়।
নবজাতক ও ইনফেন্ট শিশুতে মায়ের থাইরয়েড হরমোনের আধিক্যজনিত কারণে উপসর্গাদি দেখা গেলে তা সুনির্দিষ্ট ওষুধের (এনটিথাইরয়েড ড্রাগ্স) সাহায্যে চিকিৎসা দিতে হয়। কিন্তু যদি মা চিকিৎসা গ্রহণের দ্বারা তার থাইরয়েড অসুখ নিয়ন্ত্রণে রাখেন তবে গর্ভস্থ সন্তান ও ইনফ্যান্ট শিশু সাধারণভাবে ঝুঁকিমুক্ত থাকে।
২.গর্ভবতী মায়ের হাইপোথাইরয়ডিজম: গর্ভবতী মা যদি তার থাইরয়েড হরমোন এর অভাবজনিত অসুখ হাইপোথাইরয়ডিজম রোগে ভোগেন, কিন্তু থাইরক্সিন ওষুধের সাহায্যে যথাযথ চিকিৎসা নেন, তবে নবজাতক সন্তানে এই অসুখের প্রভাব খুব কমই দেখা যায়।
বরং পৃথিবীব্যাপী নবজাতক সন্তান ও শিশুতে জন্মগত থাইরয়েড হরমোনের অভাবজনিত অসুখের (কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়ডিজম) প্রধান কারণ শিশুর পাতে দৈনন্দিন আয়োডিনের অভাব। শিশু থাইরয়েড হরমোনের অভাবজনিত অসুখে ভুগে উচ্চতায় খাটো হয়, তার মেধাশক্তি হ্রাস পায়, পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকে, কখনো-বা চরম মানসিক প্রতিবন্ধীতে পরিণত হয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রথম সপ্তাহের মধ্যে নবজাতক শিশুর থাইরয়েড হরমোনের ল্যাব পরীক্ষা করে এ রোগ দ্রুত শনাক্ত করা যায়, ও তাৎক্ষনিকভাবে এর চিকিৎসা শুরু করা গেলে শিশু এই রোগের হাত থেকে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি পায়।
৩. গর্ভবতী মায়ের এস.এল.ই: গর্ভবতী মা যদি সিস্টেমিক লুপাস ইরিথেমেতোসাস (এস.এল.ই) অসুখে ভোগেন. তবে বারে বারে গর্ভপাত, গর্ভের সন্তানের কম বাড়ন, মায়ের প্রি-একলাম্পসিয়া ও প্রিটার্ম নবজাতক সন্তান জন্ম নেওয়ার মত নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। কখনো-সখনো এসব মায়ের নবজাতক সন্তানেও এস.এল.ই দেখা যায়। যেখানে নবজাতকের শরীরে র্যাশ ও কদাচিৎ হার্ট ব্লকের মত বিপত্তি দেখা দিতে পারে।
৪. গর্ভবতী মায়ের আই.টি.টি: যদি গর্ভবতী মা ইমিউন থ্রমবোসাইটোপেনিয়া (আই.টি.টি) রোগে ভোগেন, তবে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে গর্ভস্থ সন্তানের রক্তের অনুচক্রিকা ভেঙে যায়। এতে করে প্রসবের পর শিশুর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটে, শরীরে লাল রক্তবিন্দু দানা দেখা যায়। কোনো কোনো সময় নবজাতক সন্তানের এই বিপদ কাটিয়ে উঠতে অনুচক্রিকা দানের মত (প্লেইটলেট ট্রান্সফিউশন) চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
৫. গর্ভকালীন মায়ের ওষুধ গ্রহণ: গর্ভকালীন সময়ে মা ওষুধ গ্রহণ করলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা গর্ভস্থ সন্তানের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। খিচুনি নিরোধক ওষুধ ভেলপ্রোয়েট ওষুধ সেবনে ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে নবজাতক সন্তান নানা জন্মত্রুটি এবং ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশুর বিকাশজনিত সমস্যা তৈরি হয়। থেলিডোমাইড ওষুধ সেবনে নবজাতক সন্তানে নানা দৈহিক জন্মত্রুটি দেখা যাওয়ার কারণে প্রজনন সক্ষম সকল নারীর জন্য তা নিষিদ্ধ। তবে এমন কতক ওষুধ আছে যার প্রতিক্রিয়া অত বেশি বোঝা যায় না। সেজন্য স্পষ্ট নির্দেশনা হলো-গর্ভকালীন সময়ে খুব প্রয়োজন না হলে গর্ভবতী মা যে কোনোরুপ ওষুধ গ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন।
৬. গর্ভবতী মায়ের এলকোহল ও ধূমপান অভ্যাস : গর্ভবতী মা এলকোহল সেবন করলে তা গর্ভস্থ সন্তানে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পরবর্তী সময়ে শিশুর বৃদ্ধিবৃত্তি ও আচার-আচরণজনিত সমস্যা প্রকট হয়। গর্ভকালে শিশুর বৃদ্ধি-বিকাশ যথাযথ হয় না, তার মাথার আকার ছোট হয় এবং মুখমণ্ডলে বৈশিষ্টপূর্ণ লক্ষণ দেখা যায়। সব মিলিয়ে যা ‘ফিটাল এলকোহল সিনড্রোম (এফ.এ.এস)’ বলে অভিহিত করা হয়।
অন্যদিকে যেসব মা গর্ভকালীন সময়ে ধূমপানের সংস্পর্শে আসেন, তাঁদের বারে বারে গর্ভপাত, কম ওজনি নবজাতক শিশু, গর্ভস্থ সন্তানের কম বৃদ্ধি ও বিকাশ ও নবজাতক সন্তানের দেহে নানা জন্মত্রুটি প্রভৃতি ঝুঁকি অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।
৭. মাদকাসক্তি: গর্ভবতী মা ব্যথা নিরোধক (ওপিয়েড) ও অন্যান্য সাইক্রিয়েটিক্র ওষুধ গ্রহণ করলে তার ক্ষতিকর প্রভাব নবজাতক সন্তানে পড়ে। নবজাতক শিশুতে এর যে সমস্ত উপসর্গ দেখা যায় তার মধ্যে আছে-
১. শিশুর খিঁচুনি, হাত-পায়ে অনৈশ্চিক সঞ্চালন (ট্রেমোর), অতিরিক্ত কান্না, ঘুম-চক্রে রদবদল
২. বুকের দুধ পানে সমস্যা, বমি, ডায়রিয়া, ওজনে না বাড়া অথবা ওজন কমে যাওয়া
৩. জ্বর বা দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক না থাকা, অতিরিক্ত ঘাম, নাক জ্যাম, ঘন ঘন হাই তোলা, হাঁচি ইত্যাদি।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল