বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে জায়নবাদী বর্বর ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র–ছাত্রীরা। প্রথমেই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে–যা ছড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত চল্লিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। উত্তাল এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে গাজায় অসহায় নারী শিশু হত্যাকারী মধ্যপ্রাচ্যের কসাই নেতানিয়াহুর বর্বরতার বিরুদ্ধে। ধর পাকড় সত্ত্বেও যেন বিক্ষোভ থামছে না। কয়েকদিন আগে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভরত ছাত্র–ছাত্রীদের উপর কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। তাদের তাঁবুগুলো ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়–এরপরও বিক্ষোভকারী ছাত্র–ছাত্রীরা অনড়। তারা তাদের দাবিতে কোন ছাড় দিতে রাজি নয়। তাদের দাবি–ইসরায়েলকে অর্থ সহায়তা বন্ধ করা এবং যে সমস্ত কোম্পানী ইসরায়েলকে সমরাস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে, তাদের কার্যক্রম বন্ধ করা। যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ এখন যেন মারমুখী অবস্থানে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র–ছাত্রীদের ওপর পুলিশ দমন–নিপীড়ন চালাচ্ছে। এরই মধ্যে আড়াই হাজারের অধিক ছাত্র–ছাত্রীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়েছে এবং অনেককেই ছাত্রত্ব বাতিল করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। বিক্ষোভ যেন আরও উত্তাল সাগরের মতন ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলছে। ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে এনে তাঁবু ভেঙ্গে দেওয়া, আটক–হুমকি, ছাত্রত্ব বাতিল এত কিছুর পরও শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলছেই। বিক্ষোভকারীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে অন্তত তেরো দেশে। সর্বশেষ গত রোববার ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন অব ক্যালিফোর্নিয়ার বিক্ষোভকারীদের তাঁবু ভেঙ্গে দিয়েছে পুলিশ।
এর আগে শনিবার ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তাঁবু ভেঙ্গে দিয়ে অন্তত ২৫ শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের হামলা বন্ধ এবং ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান ও ইসরায়েলের সাথে সংশ্লিষ্টতা আছে এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবিতে গত ১৭ এপ্রিল নিউইয়র্ক এর কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে তাঁবু গেড়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন যেভাবে ইসরায়েলকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন তা বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে নিউজার্সির প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঠারো শিক্ষার্থী গত রোববার থেকে আমরণ অনশন শুরু করেছেন। একই দাবিতে এর আগে ব্রাউন ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশনে বসেছিলেন। মাথায় ঐহিহ্যবাহী কেফায়া (ফিলিস্তিনিরা সাদা কালো যে স্কার্প পড়েন) পরে রোববার বিক্ষোভ করেছেন ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির কয়েকশত শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট এর ভাষণ অনুষ্ঠান বর্জন করেন। এত কিছুর পরও বিক্ষোভকারীদের মন গলাতে পারছে না বাইডেন প্রশাসন। কি এক অদ্ভুত জোয়ার! এই আন্দোলনের জোয়ারে কম্পন তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রময়। এক অজানা চেতনায় উজ্জীবিত করে তুলছে মার্কিন শিক্ষার্থীদের। আরেক সহনশীল পরিবেশ ফুটে উঠেছে ক্যামেরাম্যানের ছবিতে–মুসলিম শিক্ষার্থীরা নামাজ পড়ছেন ক্যাম্পাসে আর অমুসলিম শিক্ষার্থীরা তাদেরকে পাহারা দিচ্ছেন। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়–জার্মানী, সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, মেক্সিকো, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, ভারত ও লেবাননের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। জার্মানীর বার্লিনের হার্মবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরে অবস্থান নিয়ে গাজায় যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে এবং নিরপরাধ ফিলিস্তিনি নারী–পুরুষ হত্যার প্রতিবাদে এই বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। সুইজারল্যান্ডের লুসান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও একই দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। মার্কিন ছাত্র–ছাত্রীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে আয়ারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচী শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সমাপনী অনুষ্ঠান চলাকালে অনুষ্ঠানস্থলে মঞ্চের সামনে বিক্ষোভ করেছেন একদল শিক্ষার্থী। এই সময় দর্শক সারিতে থাকা শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভকারীদের উৎসাহ দেন। এদিকে বিক্ষোভকারীদের বাধার মুখে পড়ল ফ্যাশন জগতের সবচেয়ে বড় আসর মেট গালা। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে বিক্ষোভ করেন মেসাসুসেট্স ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের কারণে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন্ন স্নাতক সমাপনি অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। এদিকে গাজার শাসক গোষ্ঠী হামাস জানিয়েছে, যুদ্ধ বিরতিতে তারা রাজি তবে ইসরায়েল যুদ্ধ বিরতিতে রাজি হচ্ছে না। এরই মধ্যে রাফায় অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল বাহিনী। গত সাত মাস ধরে বর্বর ইসরায়েলিদের নির্বিচার হামলার মুখে গাজার অধিকাংশ বাসিন্দা রাফা সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছেন। ভাবতে যেন অবাক লাগে–অমুসলিম শিক্ষার্থীরা যেখানে বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, হিন্দু এমনকি ইহুদিরাও রয়েছে এই বিক্ষোভে। এই সমস্ত শিক্ষার্থীরা চায় একটি সুন্দর বিশ্ব। নিরপরাধ শিশু ও নারী হত্যাকারী মধ্যপ্রাচ্যের কসাই বলে খ্যাত নেতানিয়াহুর বর্বর আচরণ তাদের প্রাণে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। অথচ মুসলিম বিশ্ব আজ নির্বিকার–মুখে যেন কুলুপ এঁটে বসে আছে। আরব বিশ্ব, ওআইসি, আরবলীগ সবাই যেন এই নৃশংস গণহত্যা চেয়ে চেয়ে দেখছে। তারা যেন বোবা, অন্ধ, বধির কিছুই শুনতে পায় না, কিছুই যেন দেখে না। ১৮০ কোটি মুসলিম ৭০ লক্ষ ইহুদির কাছে যেন জিম্মি হয়ে পড়েছে। একটি মাত্র ইহুদি রাষ্ট্র আর সেটাই যেন সারা বিশ্ব শাসন করছে। সমস্ত প্রযুক্তি, অস্ত্রের ভান্ডার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবকিছু যেন তাদের হাতের মুঠোয়। নেতানিয়াহু প্রশাসন যুক্তরাষ্টসহ পশ্চিমা বিশ্বকে পাত্তা না দিয়ে রাফায় স্থল অভিযান শুরু করেছে আর এতে করে হাজার হাজার গাজার নিরপরাধ মানুষগুলো মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়বে এবং এতে ঘটবে চরম মানবিক বিপর্যয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের গ্রেফতারি পরোয়ানাকেও পাত্তা দিচ্ছে না নেতানিয়াহু। আর এতে কল–কাঠি নাড়াচ্ছে বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র। তিনধাপে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব আসলেও হামাস এটা মেনে নিয়েছে মধ্যস্ততাকারীদের মাধ্যমে কিন্তু গাদ্দার নেতানিয়াহু প্রশাসন সেটাকে পাত্তা না দিয়ে রাফাতে তার সামরিক অভিযান শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের মাঝে আমরা যেন ইসলামের আলো দেখতে পাই। তাদের মানবিকতা, উদারতা আমাদেরকে নতুন স্বপ্ন যোগায়–আমরা মুসলিম বিশ্ব যেন ঘুমের ঘোরে আটকে আছি। জেগে জেগে ঘুমাই। আমাদের মাঝে নেই কোন ঈমানী চেতনা। শিশু, নারী হত্যার প্রতিবাদ করার মতন প্রতিবাদী উদ্যোগ। এই জায়গাতেই যেন আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। অন্তত ইরান তাদের অবস্থানের কথা জানান দিয়েছে। বিশাল শক্তিধর ইসরায়েলকে পরাস্ত করতে হুতি, হিজবুল্লাহ, ইরাকি কিছু গোষ্ঠী মরনপণ লড়াই করছে আর হামাস তাদের মাতৃভূমি রক্ষা করার জন্যে নিজের রক্ত ঢেলে দিয়ে গাজার ভূমি রঞ্জিত করছে। ৩৫ হাজারের অধিক গাজাবাসীর রক্তে বিধৌত এই ভূমি। তাদের শাহাদাতের নজরানা রক্তাক্ত ইতিহাস হয়ে থাকবে। নিজের ভূমি রক্ষার জন্য যেভাবে বাংলার দামাল ছেলেরা বুক পেতে দিয়েছিল হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে, তেমনি গাজাবাসী তাদের ভূমি রক্ষার দাবিতে নিরন্তর রক্ত ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে। হায় সেলুকাস এই পৃথিবী! মুসলিমদের রক্তের মাঝে কোন আন্দোলন দেখতে পাচ্ছি না–যেভাবে সেই আন্দোলন শুরু হয়েছে অমুসলিম দেশগুলোতে। কবে ফিরবে আমাদের হুঁশ? কখন টনক নড়বে? রাফায় রক্ত বন্যা বয়ে যাওয়ার পর কি আমাদের হুঁশ আসবে? মুসলিম বিশ্বের অনৈক্যের কারণে বর্বর ইহুদিরা আজ গাজায় রক্তগঙ্গা বয়ে দিচ্ছে। যদিও তুরুস্ক তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করেছে।
যে সমস্ত মুসলিম বিশ্ব এখনও ইহুদিদের সাথে সম্পর্ক রেখে চলছে তারা কি আল্লাহর কোরআনের সেই আয়াতটি পড়ে দেখেননি, ‘হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা ইহুদি, খ্রীস্টানদের নিজেদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ কর না। এরা নিজেরা একে অপরের বন্ধু; তোমাদের মধ্যে কেউ যদি এদের কাউকে বন্ধু বানিয়ে নেয় তাহলে সে অবশ্যই তাদের দলভুক্ত হয়ে যাবে: আর আল্লাহতায়ালা কখনও জালেম সম্প্রদায়কে হেদায়াত দান করেন না’– সূরা মায়েদা– ৫১।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল