বাংলার উঠোন ঘিরে ঘরে–ঘরে সৃষ্টি হওয়া আদি শিল্পসম্ভার আমাদের শিল্পকলার ভাণ্ডারকে যুগে–যুগে সমৃদ্ধ করেছে। পারিবারিক সাম্পর্কিক শেকড়ের বন্ধনে পরম্পরার স্মৃতির টুকরো হয়ে সেই শিল্পসম্ভারের বিশেষ জায়গা জুড়ে রয়েছে ‘মায়ের কাঁথা’। যাঁদের সৃজনশীল হাতে ভিন্ন ভিন্ন রকম সুঁই সুতোর ফোঁড়ে প্রেম–ভালোবাসা–মমতা–আবেগের হরেক নকশার বুননে বাঙালির শত বছরের সৃষ্টিশীল ইতিহাসে ‘নকশীকাঁথা’ যে দৃশ্যপট আর না বলা মনের কথার ডায়েরি–রচনার ভাষা ফুটিয়ে তুলেছে, তারই মমতাময় প্রেরণা আর অব্যাক্ত বুলি এই ‘মায়ের কাঁথা।’
মাথার উপর থেকে সারি করা ঝুলন্ত নকশাবহুল ‘মায়ের কাঁথা’র সামনে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে ভিডিও কলে বয়সের ভারে ঘরবন্দী মায়ের সাথে মেয়ের কথোপকথন– “দেইখ্যুনা ইয়ান কি! তোঁয়ার আতর্ বানাইন্না হাতা। আঁর্ বিয়ার্ সমত্ তোঁয়ারো জামাইল্যাইরে দিলাযে ইয়ান,চিনর্ না! ঈয়ান্ এডে প্রদর্শনী অর্! বোদ্ মানুষ চইন্যা অইয়ে।”
মমতাময়ী বাংলার চিরাচরিত যাপন জীবনের এমনই সরল গল্পের মতো দৃশ্যপট নজর আটকে নিয়েছে বর্ষবরণ ১৪৩১ উপলক্ষে কক্সবাজার আর্ট ক্লাব আয়োজিত পহেলা বৈশাখে ‘মায়ের কাঁথা’ শীর্ষক এই প্রদর্শনীর নানা মুহূর্ত। চট্টগ্রাম,কক্সবাজার,চকরিয়া,মহেশখালী, রামু অঞ্চলের সাতজন মায়ের সেলাই করা বিভিন্ন সাইজের বিশটি ‘ফুলর হাতা’ নিয়ে কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উঠোন জুড়ে ‘মায়ের কাঁথা’ প্রদর্শনী হয়েছে। অংশগ্রহণকারী নকশী কাঁথার শিল্পীরা হলেন রুপালী চৌধুরী (৬২), অপর্না পাল (৫৭), ঝর্না দাশ (৪৯),লিলা দাশ (৫২), শিখা দে (৪৮),আর্নিকা প্রভা দে (৫৩), বেলুবলা বড়ুয়া (৭৩)। পাশাপাশি বসেছে প্রায় দেড় শতাধিক চিত্রকর্ম নিয়ে ‘ছবির আঁট্’।
ক্ষেতের পাশে বাঁশ–ছনের চালার নিচে দেয়ালের মুরালে আঁকা হয়েছে বাংলার নারীদের ধান ভাঙ্গা, মায়ের বুকে আঁকড়ে ধরা শিশু, গ্রামের মেলায় মাটির বানানো জিনিসপত্রের হাট, রাখাইন মেয়েদের নদীতে ভাসানো ফুলবিউ উৎসবসহ আরো কত কি! নাকের ডগায় শিহরণ দিয়ে ভেসে এলো পাশে মেলে থাকা বাদাম গাছের নিচে গরম তেলে পাঁচফোড়নের সুবাস। শাক–লতা–শেকড়–সবজি মিলিয়ে প্রায় একশ পদের মিশ্রণে রান্না হচ্ছে পাঁচন। দুপুরের কড়া রোদ উপেক্ষা করে বাচ্চাদের ছুটোছুটি, দৌড়াদৌড়ি। একরাশ অপরাজিতা ফুলের পাশে সবুজ পাতার ভিড়ে দোলা দিয়ে নাচতে শুরু করলো বাঁশ কাগজ দিয়ে বানানো ফড়িং। নিমিষেই কবি–সাহিত্যিক– শিল্পীদের পদচারণায় উৎসবমুখর হয়ে উঠলো পুরো আঙ্গিনা। লোকজ উঠোন শিল্পকে জাগিয়ে রাখতে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে নিজেদেও শেকড়ের গর্ব অনুধাবনে এমন প্রদর্শনী মাইলফলক হবে মনে করেন আগত দর্শনার্থী ও শিল্পীরা।
বাংলার ঐতিহ্য, মমতাময় সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে যাওয়া মানুষদের সৃজনশীলতার সাক্ষর তুলে ধরে সংরক্ষণ ও নতুনভাবে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে পরিচয় করানোর লক্ষ্যে এইরকম ভিন্নধর্মী প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে জানান আয়োজকেরা।