‘মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ’। বিগত শতাধিক বছর ধরে এখানে এসে জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশ-বিদেশের লক্ষ-কোটি ভক্ত তাঁদের নিজেদের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষুধা আর তৃষ্ণা নিবারণ করে চলেছে। এই দরবার আজ নারী পুরুষ ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে অগণিত ভক্তের এক মহামিলন কেন্দ্র, এক মহাতীর্থভূমি। হযরত গাউছুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী মাওলানা শাহসূফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (কঃ) কেবলা এবং হযরত গাউছুল আ’যম মাওলানা শাহসূফি সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবাভাণ্ডারী (কঃ) কেবলার বেছালের পর মাইজভান্ডারী ত্বরিকা প্রচার-প্রসারে যে মহান অলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন, তিনি হলেন হযরত বাবাভান্ডারী (কঃ) কেবলার সুযোগ্য উত্তরসূরী-শাহজাদায়ে গাউছুল আ’যম আলহাজ্ব মাওলানা শাহসূফি সৈয়দ শফিউল বশর মাইজভান্ডারী (কঃ) কেবলা।
জন্ম ও শিক্ষা : শাহসুফি মাওলানা সৈয়দ শফিউল বশর আল হাচানী আল মাইজভান্ডারী (কঃ) ১৩২৫ বাংলার ৭ই ফাল্গুন ১৯১৯ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি রবিবার পূর্ণময়ী মাতা হযরত সৈয়দা জেবুন্নেছা রাহমানীর কোলে জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহ তায়ালা যাকে সর্বোত্তম মাহবুবরূপে গ্রহণ করতে চান তাঁকে তিনি নানা কঠিন পরীক্ষায় ফেলে, যোগ্যতর হিসেবে গড়ে তুলেন। তাঁর মাত্র আড়াই বৎসর বয়সে তিনি মাতৃহারা হন, তাঁর বড় ভাই শাহজাদায়ে গাউছুল আ’যম হযরত শাহ্সুফি মাওলানা সৈয়দ খায়রুল বশর মাইজভান্ডারী (কঃ) এর তত্ত্বাবধানে এবং আত্মীয় স্বজনদের মায়ামমতায় তিনি বড় হন। তাঁর জন্মদাতা পিতা হযরত গাউছুল আ’যম বাবাভান্ডারী (কঃ) সর্বসময় আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন বিধায় তিনি জাগতিক পিতৃ স্নেহ পাননি। ছোটবেলা থেকেই বিদ্যা শিক্ষা এবং ধর্মীয় বিষয়ে তাঁর প্রবল আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়, যথাযথ শিক্ষকের সাহাচর্য্যে তিনি লেখাপড়ায় উন্নতি লাভ করতে থাকেন। আরবী, ফার্সী ও উর্দুর পাশাপাশি সমসাময়ীক বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষায়ও তিনি পারদর্শি হয়ে উঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য তৎকালীন ভারত বর্ষের বিখ্যাত আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নের জন্য ভর্তি হন।
সাধনা ও রেয়াজত : পাক ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামী আধ্যাত্মিক কেন্দ্র চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার শরীফের যুগল গাউছুল আ’যমের বংশধর হিসেবে তিনি দুনিয়াবী শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় সাধনায় আত্ম-নিয়োগ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত মহাদেশের বিভিন্ন অলি বুজুর্গানে দ্বীনের মাজার শরীফ জিয়ারত করেন। একাধারে তিনি তিন মাস মিশরে অবস্থানকালে প্রতি শুক্রবার মসজিদুল আক্সায় (বায়তুল মোকাদ্দাসে) জু’মার নামাজ আদায় করতেন। সেই সময় তিনি হযরত মূসা (আঃ), হযরত ইব্রাহীম (আঃ) সহ অনেক নবী পায়গাম্বারের রওজায় জিয়ারত ও আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। দেশে ফিরে আসার পরে পিতা হযরত গাউছুল আ’যম বাবা ভান্ডারী (কঃ) এর সান্নিধ্যে থেকে কঠোর আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন হয়ে যান। কালক্রমে তিনি মাইজভান্ডার শরীফের ত্বরিকায়ে মাইজভান্ডারীর একজন প্রসিদ্ধ অলি হিসেবে জনখ্যাতি লাভ করেন।
তরিকা প্রচার : তাঁর জীবনের সুদীর্ঘ ৫৫ বৎসর কাল তিনি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও শহরে বন্দরে সর্বস্থানে কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক তরিকায়ে মাইজভাণ্ডারীয়ার শিক্ষা ও আদর্শ মানুষের মাঝে প্রচার করেন। একই লক্ষ্যে তিনি ভারত, বার্মা, লন্ডনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তরিকা প্রচার করে যান। তাঁর নূরানী চেহারা, সুমধুর কণ্ঠস্বর এবং সকলের প্রতি অনাবিল ভালোবাসার কারণে সবাই তাঁর প্রতি আদব ভক্তিতে অনুরাগী হয়ে পড়তেন। বিভিন্ন মাহফিলে তাঁর ওয়াজ নছিহত শুনে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর হাতে “দস্ত বাইয়াত” গ্রহণ করে গাউছুল আ’যম মাইজভাণ্ডারীর আশেক ভক্ত হয়ে যায়।
সমাজ সেবা : সমাজ সেবায় তাঁর অবদান অপরিসীম। সমাজ উন্নয়ন ও মানব কল্যানে ছিলেন তিনি নিবেদিত প্রাণ। নাজিরহাট-মাইজভাণ্ডার শরীফ সড়ক উন্নয়ন এবং এ সড়কে ব্রিজ নির্মাণ, মাইজভান্ডার শরীফে বিদ্যুৎ সংযোগ পোস্ট অফিস ও টেলিফোন একচেঞ্জের জন্য নিজস্ব জায়গা প্রদান, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন এর জন্য নগদ অর্থ প্রদান, মাইজভান্ডার শরীফ শাহী জামে মসজিদ সংস্কারের জন্য প্রচুর অর্থ প্রদান, এলাকার গরীব দুঃখীদের আর্থিক সাহায্য প্রদানের জন্য এলাকার গণ মানুষের কাছে তিনি একজন মহৎ প্রাণের মানুষ হিসেবে সুবেদিত।
বেছাল শরীফ : আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত বিধান মোতাবেক ৮ই মাঘ ২১শে জানুয়ারি ২০০২ রবিবার রাত ৮:২৫ মিনিটে ইসলামের এই মহা তাপস মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে যাত্রা করেন (ইন্না… রাজেউন)। ১০ই মাঘ হযরত গাউছুল আ’যম শাহছুফি মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (কঃ) ওরশ শরীফের দিন তাঁকে সমাহিত করা হয়।
আজ এ মহান অলির ৭ই ফাল্গুন ২০শে ফেব্রুয়ারি ২০২১ শনিবার ১০২তম খোশরোজ শরীফের খেদমত ও আন্জামে নিয়োজিত গাউছিয়া মাইজভাণ্ডারীয়া হাবিবীয়া কমিটির পক্ষ থেকে সবার জন্য রইল শুভেচ্ছা।