অপেক্ষাকৃত ভালো কাজের সন্ধানে বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিকদের মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গমন বহুদিন চলে আসা স্বাভাবিক ঘটনাক্রম। শুধু তাই নয় মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে বাঙালি নারী শ্রমিকের চাহিদাও আছে। বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বৈধ পথে যে কোনো শ্রমিকের বিদেশ গমন একপ্রকার স্বাভাবিক যাত্রা। কিন্তু সবসময় আইনী বিধান সুরক্ষিত রেখে ভিন দেশে মজুরি শ্রমিক পাঠানো যথার্থভাবে না হওয়ার চিত্রও আশঙ্কাজনক। সৌদি আরব, জর্দান, ওমান, কাতার এসব দেশে পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকের কাজের সন্ধানে যাওয়া দেশের অর্থনীতিতে এক বিরাট অবদানও বটে। নিজের দেশে যথাযথ কর্মসংস্থান না পাওয়ার তাগিদও প্রবাসে গমনে সংশ্লিষ্টদের উদ্বুদ্ধ করে। সংসারে সচ্ছলতা ফেরানো, বেকারত্বকে মোকাবিলা করে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষায় মধ্যপ্রাচ্যের হরেক দেশে কর্মসংস্থান খুঁজে নেয়। বৈধ–অবৈধ যেভাবেই হোক প্রবাসে গমন করে নির্দিষ্ট কোনো পেশায় নিযুক্তও হয়ে যায়। সেটা গৃহকর্মী থেকে বিভিন্ন শিল্প কারখানায় মজুরি শ্রমিক হিসেবেও যোগদান করে নিজেদের স্বাবলম্বী করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। দুঃসাহসিক মনোবলে অনিশ্চয়তার যাত্রাপথে নিজেদের শামিল করা বাংলাদেশের নারীদের এক অভাবনীয় কর্মপরিকল্পনা। কিন্তু সেখানে কোনো এক কর্মযোগে নিয়োজিত হবার পর শুধু প্রবাসী আয় আসা ছাড়া অন্য কোনো খবর জানাও মুশকিল। আর এই আলো আঁধারির আবছায়ার জীবনও নেপথ্যে, আড়ালে, আবডালে থেকেই যায়। একটা সুখবর প্রায়শই সংবাদ মাধ্যমের তথ্য উপাত্তে উঠে আসে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে রেমিটেন্স দেশে আসে সেখানে নাকি নারী শ্রমিকের বেতন–মজুরি তার পুরুষ সহকর্মীর চাইতে বেশি। কিন্তু তার বিনিময়ে প্রবাসী বাঙালি নারীকে কত যে খেসারত দিতে হয় সেটা লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়। তেমন ভুক্তভোগী নারী শ্রমিক যতক্ষণ না জীবিত বা মৃত অবস্থায় দেশে ফিরে আসেন। একসময়ের ঘরবন্দি নারীরা প্রচলিত সমাজ সংস্কারকে পেছনে ফেলে অসম সাহসিকতায় গৃহের সীমাবদ্ধ আলয় থেকে সম্প্রসারিত বিশ্বে পা বাড়ায় সেখানেই প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে নির্ভীক এক অনমনীয় চেতনা। নিম্নবিত্তের সাধারণ ঘরের অভিবাসী নারী শ্রমিকের বিদেশে কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ জীবন তা আন্দাজও করতে পারে না। মধ্যপ্রাচ্যের বহু রাষ্ট্রে শুধু যে আমাদের দেশের নারীরা অভিভাসী হিসেবে যায় তা কিন্তু নয় বরং শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান থেকেও অসংখ্য নারী শ্রমিক বিভিন্ন দেশে গমন করে। কিন্তু অত্যাচার, অবিচার, অনিয়মের দৃশ্য প্রতিভাত হলে বহু দেশ প্রতিবাদস্বরূপ শ্রমিক পাঠানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাও দিয়ে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করার কার্যক্রম সেভাবে শুরু হয়নি। বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে আসতে দেরি হয়নি– কেন বাংলাদেশ থেকে নারীদের বিদেশ গমন স্থগিতের পর্যায়েও পৌঁছাতে পারল না। উত্তরও মিলেছে স্বাভাবিকভাবেই। গতানুগতিক সংস্কারাচ্ছন্ন আমাদের এই চিরায়ত বাংলা। সব ধরনের অপসংস্কারকে পিছনে ফেলে যখন কোনো নারী বিদেশের পথে পা বাড়ায় তখন তার সেভাবে পিছু টানও থাকে না। অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যে পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে বাঙালি নারীরা শেষ অবধি তাদের কর্মসংস্থানকে টিকিয়ে রাখতে লড়াই–সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াও যেন একপ্রকার দুর্গম পথ অতিক্রম করা। অচেনা, অজানা, ভিনদেশী সমাজ সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হতেও সময় গড়িয়ে যায়। সেখান থেকে যখন মাথা তুলে দাঁড়ায় সে সময় আর দেশে ফেরার চিন্তা থাকেই না। কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। পারিবারিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্য সামনে এসে পথরোধ করে। ফলে অত্যাচার–অবিচার সহ্য করেও বিদেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। দেশও উপকৃত হয় নানাভাবে। যথেষ্ট রেমিটেন্স রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়। এমনকি করোনাকালের চরম দুঃসময়ে আমাদের প্রবাসী আয় আসার স্বস্তিও ছিল। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে কত অমানবিক, নৃশংস, লোমহর্ষক ঘটনার ইতিবৃত্ত। সুস্থ কিংবা সক্ষম নারীদের দেশে ফেরার লক্ষণ প্রায়ই অনুপস্থিত। বরং যারা দেশে আসতে বাধ্য হয় সেখানে আসে তাদের মরদেহ কিংবা অত্যাচারের জর্জরিত শরীর। সভ্যতা সূর্যের মধ্যগগন কালো মেঘের আঁধারে যেন ঢেকে যাওয়ার দুর্দশা। আমাদের দেশের নারী শ্রমিকরা মূলত মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবেই বেশি যায়। অত্যাচারের মাত্রাও সেখানেই বেশি করে ঘটে। এক তথ্যউপাত্তে জানা যায় ২০১৬ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত প্রায়ই ৫০০ নারী শ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে। সেখানে নিপীড়ন আর দুঃসহ অত্যাচারে জর্জরিত নারীদের ফেরার সংখ্যাও কম নয়। ফিরে আসা লাঞ্ছিত নারীরা অকপটে স্বীকার করেছেন তাদের ওপর শারীরিক অত্যাচার ছাড়াও গর্ভধারনের কারণে অনেকের আত্মাহুতি দেওয়ার মতো মর্মান্তিক করুণ ঘটনাও ঘটতে থাকে। সারাদিনের ক্লান্তি, অবসাদের পরও বিশ্রামের কোনো সুযোগ থাকে না। গৃহকর্তার অমানবিক ক্রিয়াকলাপ ছাড়াও গৃহকর্ত্রীর রোষাণল সঙ্গে বেদম প্রহারও নাকি নিত্য দিনান্ত পরিশ্রমের প্রাপ্তি তো বটেই। তবে এক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ই বৈধভাবে যেসব শ্রমিক পাঠান বিভিন্ন দেশে সেখানে কিছুটা হলেও সহনীয় স্বস্তির পরিবেশ থাকে। এর অন্যথায় অর্থাৎ মানব পাচারের মাধ্যমে যারা যায় তাদের নির্যাতনের কোনো সীমা পরিসীমা থাকেই না।