পুরো বিশ্ব তাকিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে। দেশটির জনগণ তো বটেই, বিশ্বজুড়ে সবার কৌতূহল, কে হচ্ছেন আগামী চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউজের অধিকর্তা। বিভিন্ন জরিপ মতে, এবারই সবচেয়ে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং অনিশ্চয়তায় ভরা এক নির্বাচন হলো যুক্তরাষ্ট্রে। নির্বাচন শেষ। গতকাল সন্ধ্যায় ভোট শেষে শুরু হয় গণনা। এখন ফলের জন্য অপেক্ষা।
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রে গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হলো ৫৯তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হবেন দেশটির ৪৬তম প্রেসিডেন্ট। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবারও নির্বাচনে প্রার্থী। তার প্রতীক ‘হাতি’। তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বদ্বী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। তার প্রতীক ‘গাধা’। শেষ হাসি কে হাসবেন সেটা নিশ্চিত হতে একটু সময় লাগতে পারে। তবে বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, এবার ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে বাইডেন।
৭৪ বছর বয়সী ট্রাম্প লড়ছেন দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য। ৭৭ বছর বয়সী বাইডেন জিতে গেলে তিনি হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া সবচেয়ে বেশি বয়সী প্রার্থী। করোনা মহামারী ছাড়াও অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, কর ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসাসেবা, অভিবাসন পদ্ধতি ও বর্ণবাদ প্রসঙ্গ এবারের নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভোটারদের প্রভাবিত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। করোনা এর মধ্যে দেশটির প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। নির্বাচনে জিতলে বাইডেন ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় দেশজুড়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। ট্রাম্প বলছেন, মার্কিন অর্থনীতি নতুন কোনো লকডাউনের ধাক্কা সহ্য করতে পারবে না। নির্বাচনের পর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন দেশের বেশিরভাগ মানুষ। সমপ্রতি এক সমীক্ষায় প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনই মনে করছেন, নির্বাচনের পর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে।
রীতি অনুযায়ী গতকাল মঙ্গলবার প্রথম প্রহরে ভোট দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সীমান্ত সংলগ্ন নিউ হ্যাম্পশায়ার রাজ্যের ছোট শহর ডিঙভিল নচের ভোটাররা। আর এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ফ্লোরিডার পাম বিচের একটি ভোটকেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক সপ্তাহ আগে আগাম ভোট দিলেও মেলানিয়া গতকাল ভোটের দিন কেন্দ্রে গিয়েই নিজের ভোট দিলেন।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা করেছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী বাইডেন। নির্বাচনে অন্তত ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে নির্বাচিত হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন ট্রাম্প। নির্বাচনের দিন গতকাল মঙ্গলবার সকালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফঙ নিউজকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এই আশা প্রকাশ করেন। দেশটিতে মোট ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে। ইলেকটোরাল কলেজ প্রতিনিধিরাই মূলত হোয়াইট হাউসে কে যাবেন সেটি নির্ধারণ করেন।
এদিকে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বাইডেন পিটসবার্গে বলেছেন, ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার সময় হয়েছে ট্রাম্পের। সোমবার রাত সোয়া ১২টার দিকে এক টুইট বার্তায় বাইডেন বলেন, আমরা যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আরও চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউসে রেখে দিই, তাহলে তিনি আমাদের দেশের বৈশিষ্ট চিরতরে পাল্টে দেবেন। আমরা এটা হতে দিতে পারি না।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সাধারণত নির্বাচনের রাতেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল জানা যায়। তবে এবার চিত্র কিছুটা ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রে মোট ভোটার প্রায় ২৪ কোটি। এর মধ্যে ১৯ কোটির মতো ভোটার এবার নিবন্ধন করেছেন। আগাম ভোট দিয়েছেন প্রায় ১০ কোটি ভোটার, যা দেশটির ইতিহাসে রেকর্ড। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে ভিড় এড়াতেই মূলত ডাকযোগে ভোটের সংখ্যা বেড়েছে। সব মিলিয়ে কখন চূড়ান্ত ফল পাওয়া যাবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকছে এবার।
এদিকে, করোনাভাইরাস আক্রান্ত ভোটাররা এবং যারা স্বেচ্ছা-আইসোলেশনে আছেন তারাও ভোট দিতে পারবেন বলে জানিয়েছিল সিডিসি। তারা বলেছিল, আক্রান্তদের ক্ষেত্রে সুরক্ষার নিয়ম মেনে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে ভোট দিতে কোনো বাধা নেই।
কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস বা প্রতিনিধি পরিষদ এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ডেমোক্র্যাটরা। তারা এই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য লড়ছে। তারা উচ্চ কক্ষ সিনেটেও সংখ্যাগরিষ্ঠা পেতে লড়ছে।
ফলাফল ঘুরিয়ে দিতে পারে যেসব রাজ্য : দেশটির অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে অন্তত ছয়টি রাজ্য এবারের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে সকল সমীকরণ উল্টে দিতে পারে অ্যারিজোনা, পেনসিলভানিয়া, টেঙাস, ফ্লোরিডা, জর্জিয়া ও উইসকনসিন। এছাড়া আলোচনায় আছে নর্থ ক্যারোলিনা এবং মিশিগানের মতো রাজ্য।
নর্থ ক্যারোলাইনাতে ভোট শুরু হয় সকাল সাড়ে ৬টা থেকে। এখানে কোনো কোনো সেন্টারে আশি ভাগ পর্যন্ত ভোট পড়েছে। এদিকে, নির্বাচনী প্রচারণার শেষ পর্যায়ে রাশিয়ার প্রধান আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেল রাশিয়া টুডে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
নিউ ইয়র্কের ভোট কেন্দ্র ফাঁকা : নির্বাচনের দিন সকাল সাড়ে ৮টায় নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন হাইটসের সেন্ট ফ্রান্সিস কলেজ ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের লাইন ছিল না। নিউ ইয়র্কে আসলে আগাম ভোটের ব্যাপারটি ঘটেছে সফলভাবে। ১১ লাখ মানুষ আগাম ভোট দিয়েছেন। যদি কোনো রাজনৈতিক ভূমিকম্প না হয় বাইডেনের নিউ ইয়র্কের ২৯টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ভোটকেন্দ্রে বিনোদনের ব্যবস্থা : ফিলাডেলফিয়ায় মানুষ যখন ভোট দেওয়ার জন্য লাইনে অপেক্ষা করছেন, তখন নেচে গেয়ে তাদের বিনোদন জোগাতে উদ্যোগী হয়েছে নিরপেক্ষ অরাজনৈতিক গোষ্ঠী ‘জয় টু দ্য পোলস্’। তাদের উদ্দেশ্য উত্তেজনা কমানো ও ভোট কেন্দ্রে সঙ্গীতের আবহ সৃষ্টি করা।
কমলা হ্যারিস ও পনির টিক্কা : যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের দিন ভারতে টুইটারে ট্রেন্ডিংয়ের শীর্ষে আছে একটি বিখ্যাত ভারতীয় রান্না পনির টিক্কা। ডেমোক্রেট কংগ্রেসওম্যান প্রমিলা জয়াপাল ভারতীয় আমেরিকান। তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের সম্মানে পনির টিক্কা রান্নার সিদ্ধান্ত নেন।
ভোটকেন্দ্র থেকে নাস্তা : মিশিগানে স্থানীয় সময় সকাল ৭টায় শুরু হয় ভোট গ্রহণ। এখানে প্রচণ্ড ঠান্ডার (৪ সেলসিয়াস) ভোট দিচ্ছেন ভোটাররা। অনেক কেন্দ্রে ভোট দানে উৎসাহিত করতে ভোটারদের জন্য বিনামূল্যে সকালের নাস্তা ও কফির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ভোটকেন্দ্রের পক্ষ থেকে।
সুরক্ষা প্রস্তুতি : নির্বাচনের ফল নিয়ে সহিংসতার আশংকায় বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে দোকানপাট, অফিস আদালতে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়েছে গতকাল থেকেই। অনেকে দোকানের সামনে কাঠের বোর্ড তুলে দেন। অনেকে দোকানের কাচ ঢেকে দেন।
যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের ফল এবং ভোট গণনা নিয়ে আইনি লড়াইয়ের নজির আছে। ২০০০ সালের নির্বাচনের মীমাংসা হয়েছিল আদালতে। এবারও নির্বাচনের ফলকে ঘিরে আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু হয় আগে থেকে। সেই সঙ্গে বাড়ছে রাস্তায় সহিংসতার ঝুঁকি। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দুজন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ভোটের ফল মেনে না নেওয়ার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।