অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ : আইকন
বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা করা যায়। কিন্তু ‘আইকন’কে সংজ্ঞায়েত করা যায় না। আইকন সর্ববিস্তৃত দৃশ্যমান, অনুভবে, মননে বোঝা যায়। এজন্য বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা বেশি হলেও ‘আইকন’ হাতে গোনা। প্রত্যেক বিষয়ে আইকন থাকতে পারে। জ্ঞানে, কথনে- বলনে, আদর্শিক দৃঢ়তা ও সর্বোপরি বেশ-ভূষায় চট্টগ্রামের ‘আইকন’ ছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। প্রফেসর স্যারের আইকন হয়ে ওঠার জন্য আমার মনে হয় উনার জন্ম গ্রাম রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার একটা মুখ্য ভূমিকা আছে কারণ উনার বাড়ির আশেপাশে অর্থাৎ উনাদের পাড়াটাতে এত বেশি জ্ঞানী-গুণী মানুষ যে বাংলাদেশের খুব কম অঞ্চলেই এত তারকা’র সন্নিবেশ দেখা যায়। কয়েকজন ব্রিটিশ আমলের ডাক্তার, শিক্ষাবিদ একই পাড়ায় এরকম পরিবেশেই সৌভাগ্যের ব্যাপার।
লেখাপড়া উনি যে সময়ে করেছেন, তখন ভালো চাকরি করে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাপন করা উনার পক্ষে মোটেই কঠিন ছিল না। কারণ তখন যুগই ছিল চাকরির। কিন্তু ভাগ্য রাশি ও আল্লাহ উনাকে অন্যক্ষেত্রে নিয়ে এলেন। চাকরি বা অধ্যাপনা করলে কি হতেন তা অনেকটা অনুমানের ব্যাপার। কিন্তু সাংবাদিকতায় উনি যে দিকপালের ভূমিকা নিয়েছিলেন তাই তার জীবনের চরম সফলতা বলে আমি মনে করি। কিছু সময়ের জন্য তিনি রাজনীতি করেছেন। কিন্তু রাজনীতিতে যে বিসদৃশ সমীকরণের সাথে আপোষ করে চলতে হয় অধ্যাপক খালেদ সাহেব সেই সমীকরণের ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তাই হয়তো খণ্ডকালীন রাজনীতির জগত ছেড়ে ফুল-টাইম সাংবাদিকতার জগতে চলে আসেন। সময় প্রবাহ প্রমাণ করেছে শেষ পথেই খালেদ সাহেবের যথাযথ পথ, ওটাই চট্টগ্রামের প্রাজ্ঞ আইকনের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষেত্র।
অধ্যাপক খালেদের আরেকটি বড় কীর্তি চট্টগ্রামে দৈনিক আজাদীকে ঘিরে উচ্চমানের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা। তিনি যে সময় দৈনিক আজাদীর সম্পাদকের দায়িত্ব নেন সে সময় চট্টগ্রাম কলেজে ও পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একঝাঁক দেশখ্যাত প্রথিতযশা সাহিত্যিক অধ্যাপনা করতেন। নাট্যকার মমতাজউদ্দীন আহমদ, আলাউদ্দিন আজাদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং পরবর্তী প্রজন্মের চৌধুরী জহুরুল হক, ময়ুখ চৌধুরী, ডক্টর মাহবুবুল হক প্রমুখের আড্ডা তৈরি হয়েছিল দৈনিক আজাদীকে ঘিরে। এই আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন অধ্যাপক খালেদ ও সাংবাদিক ওবায়দুল হক। এতসব খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও প্রাজ্ঞ সমাজের নিত্য সাহচর্য খালেদ সাহেবের মনন, মেধাকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয় যা আমৃত্য বিকশিত ও পরিশুদ্ধ প্রক্রিয়ায় ছিল।
চট্টগ্রামে নতুন সাহিত্যকর্মী, কবি, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার সৃষ্টিতে অধ্যাপক খালেদ সাহেবের দূরদৃষ্টি অনন্য। আমরা যারা কিছু লেখালেখি করি দৈনিক আজাদীর সম্পাদকীয় পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে সম্ভব হতো কিনা এটা একটা বিরাট প্রশ্ন।
অধ্যাপক সাহেবের ১৯৭০-৭৫ এর রাজনৈতিক জীবন প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তখন আমি দ্বাদশ শ্রেণিতে। উনার নির্বাচনী প্রচারণায় উনি বিপক্ষীয় প্রার্থীর নাম ও উচ্চারণ করতেন না। আমি প্রফেসর সাহেবের নির্বাচনী এলাকার ভোটার ছিলাম। নির্বাচনী সভায়ও বক্তৃতা শুনতাম। যেহেতু উনার বিপক্ষীয় প্রার্থী উনার একই এলাকার ও তিনি যত না রাজনীতিবিদ তার চেয়েও এলাকার মুরুব্বী হিসেবে স্বীকৃত। পুরো নির্বাচনী প্রচারণায় প্রফেসর সাহেব জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে কোনো কিছুই বলতেন না। চৌধুরী সাহেবের কটুক্তি গুলোর জবাবও দিতেন না। যা হোক নিজের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যুতে প্রফেসর সাহেবের মানবিক ভূমিকাকে আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তুলনা করলে ছোট শিশুও তাজ্জব হবে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে ফজলুল কাদের চৌধুরীর মরদেহ গ্রহণ, প্যারেড ময়দানে জানাযা থেকে শুরু করে সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীকে জানাযায় বক্তব্য দেওয়া সবকিছুই নেহায়েৎ অতি মানবের পক্ষেই সম্ভব।
প্রফেসর সাহেবকে আরো কাছে থেকে দেখার ও জানার সুযোগ হয় ১৯৮৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র পরিষদ ও পরবর্তী পূর্ণমিলনী উদযাপন করতে গিয়ে। চট্টগ্রাম কলেজের প্রাক্তন ছাত্র সংখ্যা এত বেশি, এত বিভিন্ন স্তরের, এত ভিন্ন মতাদর্শের যে তাদেরকে এক ছাতায় এনে দীর্ঘ ১৬ বছর একত্রে রাখাটা প্রফেসর সাহেব এর অনন্য কীর্তি। উনি নিজে কম কথা বলে নবীন প্রবীনদেরকে বক্তব্য দিতে বলতেন। এই আইকনের মৃত্যুর পর এই অ্যালামনাই এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। ছাত্র-শিক্ষক এর বন্ধুত্ব দেখতে হলে রম্য লেখক ও বামপন্থী রাজনীতিবিদ বাঁশখালীর প্রফেসর আসহাব উদ্দিন ও প্রফেসর খালেদ সাহেবের আড্ডা গুলো স্মরণীয়। বয়সে অনেক ছোট হলেও দুজনেই আমাকে আদর করতেন। আসহাব উদ্দিন সাহেব এই আড্ডায় আমাকেও নিতেন মাঝেমধ্যে। দুইজনের সিগারেটের ধোঁয়ায় আমি ঘনঘন পায়চারি করতাম ও না বলেই পালিয়ে আসতাম।
স্বাধীনতার পর যে তিন বৎসর উনি রাজনীতি করতেন তখন বিভিন্ন সুপারিশের প্রয়োজন হতো এলাকার সাংসদ থেকে, যারা উনাকে ভোট দেয়নি উনাদেরকেও কোনো প্রতিশোধপরায়নতা দেখাতেন না। রাজনৈতিক সহনশীলতা, সহমর্মিতা অধ্যাপক খালেদ সাহেবকে চির উজ্জ্বল ও চট্টগ্রামের ‘আইকন’ হিসেবে রাখবে।
বলা হয় সময়ের প্রবাহে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়। কিন্তু অধ্যাপক খালেদ সাহেবের বিকল্প তো এখনো দৃশ্যমান নয়। সেই লম্বা পৌরুষদীপ্ত দেহ, সেই পাঞ্জাবি সেই মাথার তৈককা (টুপি) সৌম্য হাসি তো চোখে পড়ে না। তিনি চট্টগ্রামের বিবেকের আইকন নয় তো কী?
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক