তীব্র গরমের মাঝে ঘন ঘন বিদ্যুতের আসা-যাওয়াতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ। বিদ্যুতের এই ভেল্কিবাজিতে বিঘ্নিত হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের কাজকর্ম। নষ্ট হচ্ছে ইলেকট্রোনিক্স যন্ত্রপাতি। বিঘ্ন ঘটছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে। তবে পিডিবির দাবি, এখন লোডশেডিং নেই। বিভিন্ন প্রকল্পের উন্নয়ন কাজের কারণে শার্ট ডাউন দিতে হচ্ছে। এছাড়া ভারী বাতাসের কারণে গাছের ডাল-পালা ভেঙ্গে পড়লে সঞ্চালন লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। বিদ্যুতের এই ঘন ঘন আসা যাওয়া দেখে আসন্ন রমজানে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে উদ্বিগ্ন সাধারণ গ্রাহক।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে সরকারি-বেসকারি মিলে ২২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার ৪০৩ মেগাওয়াট। গ্যাস সংকট ও মেরামতের কারণে প্রায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ। এর মধ্যে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রর ৫টি ইউনিটের মধ্যে ১ থেকে ৩ নম্বর ইউনিট পানির কারণে বন্ধ রয়েছে। ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিটেও উৎপাদন হচ্ছে অর্ধেকের কম। তবে পিডিবি চট্টগ্রাম আঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান সামিনা বানু শোনালেন আশার কথা। তিনি বলেন, আসন্ন রমজানে বিদ্যুতের লোডশেডিং থাকবে না। গতকাল আজাদীকে তিনি জানান, বিদ্যুতের লোডশেডিং নেই। আজকে (গতকাল বুধবার) পাথরঘাটা সাব স্টেশন এলাকায় একটি কাজের শার্ট ডাউনের কারণে বিদ্যুতের আসা-যাওয়া কিছুটা বিঘ্নিত হয়েছে। তাছাড়া এখন দুটি প্রকল্পের কাজ চলছে এজন্য লাইন বন্ধ রেখে কাজ করতে হয়। চট্টগ্রামে এখন ১১শ’ মেগাওয়াট থেকে ১২শ’ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে বলে জানান পিডিবির এই প্রকৌশলী।
চট্টগ্রামে ১৪ শ’ কোটি টাকার ‘বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা ও সঞ্চালন লাইনের উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী দুলাল মাহমুদ আজাদীকে জানান, পিডিবির ১৪শ’ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে। এই প্রকল্পের মোট ২৪টি সাব স্টেশন নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ রয়েছে। এর মধ্যে ১২টি নতুন সাব স্টেশন ও ৮টি পুরাতন সাব স্টেশনের ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ কাজ আছে। এছাড়া সন্দ্বীপে রয়েছে ২টি এবং পাবর্ত্য জেলায় ২টি। সাব স্টেশনগুলোর কাজ প্রায় শেষ। এই প্রকল্পে সঞ্চালন লাইনের কাজও রয়েছে। প্রকল্পটির পাশাপাশি ‘চট্টগ্রাম বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্প-২’ নামে ২৬শ’ কোটি টাকার আরো একটি মেগাপ্রকল্পের কাজ চলছে।
এদিকে বিদ্যুতের ঘনঘন আসা যাওয়াতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাজ কর্ম বিঘ্নিত হচ্ছে বেশি। এছাড়া ঢাকায় চলছে বাংলা একাডেমির বই মেলা। প্রকাশকদের বলতে গেলে নির্ঘুম সময় যাচ্ছে এখন। দিন-রাত চলছে নতুন নতুন প্রকাশনার কাজ। কিন্তু বিদ্যুতের ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ত্যক্ত-বিরক্ত চট্টগ্রামের প্রকাশকরা। চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনের প্রকাশক কবি মঈন ফারুক। তিনি গতকাল প্রতিবেদককে জানান, সারাদিনে কম্পিউটারে বসলে ৩ ঘণ্টাও কাজ করতে পারি না। একবার কম্পিউটার চালু করলে আধ ঘণ্টাও কাজ করা যায় না। এটা আমাদের মৌসুম। সারা বছর আমরা বই মেলার দিকে তাকিয়ে থাকি।
মোগলটুলী এলাকার বাসিন্দা নারী উদ্যোক্তা লিপি বড়ুয়া বিদ্যুতের ভেল্কিবাজিতে বিরক্তি। তিনি বলেন, এখন গরমের তীব্রতা বেড়েছে। ঘন ঘন বিদ্যুতের আসা-যাওয়াতে টিভি-ফ্যান-ফ্রিজ নষ্ট হচ্ছে। পিডিবি বলছে, লোডশেডিং নেই। কিন্তু সারাদিনে অসংখ্যবার বিদ্যুৎ আসা যাওয়া করছে।
এই ব্যাপারে রাউজান তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া আজাদীকে জানান, রাউজানের ৪২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ২টি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। অপরদিকে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫টি ইউনিটের মধ্যে ১ থেকে ৩ ইউনিট মেরামত কাজের জন্য বন্ধ রয়েছে। ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিটে ৩৫ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানের পরপর থেকে বন্ধ রয়েছে। এখন ইটিপির কাজ চলছে। ইটিপি চালু হলে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হবে।
শিকলবাহার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সলিল কান্তি দাশ আজাদীকে জানান, শিকলবাহা সরকারি ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেরামতের জন্য বুধবার (গতকাল) বন্ধ করা হয়েছে। সরকারি ১৫০ মেগাওয়াট চালু আছে। দোহাজারী ১০০ মেগাওয়াটি পিকিং পাওয়ার চালু আছে। শিকলবাহা ও জুলধা এলাকায় প্রাইভেট অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো বিদ্যুতের চাহিদার উপর নির্ভর করে চালু করা হয়। চাহিদা না থাকলে বন্ধ থাকে। কারণ ফার্নেস অয়েল দ্বারা চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি। একারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেশি থাকলে প্রাইভেট বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু রাখতে বলা হয়।
কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সলিল কান্তি দাশ আজাদীকে জানান, শিকলবাহায় ২টি পাওয়ার প্ল্যান্টের উৎপাদন ক্ষমতা ২১৬ মেগাওয়াট (১টি ১০৮ মেগাওয়াট করে), কনফিডেন্সের জডিয়াক পাওয়ার প্ল্যান্টের উৎপাদন ক্ষমতা ৫৪ মেগাওয়াট, এনার্জি প্যাক পাওয়ার প্ল্যান্টের উৎপাদন ক্ষমতা ১০৮ মেগাওয়াট, শিকলবাহা আনলিমা পাওয়ার প্ল্যান্টের উৎপাদন ক্ষমতা ১১৬ মেগাওয়াট, মালঞ্চ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৫৯ মেগাওয়াট, বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার প্ল্যান্টের উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ মেগাওয়াট, ইউনাইটেড (আনোয়ারা) কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৩৩০ মেগাওয়াট, জুলধা ১০০ করে তিনটি পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের উৎপাদন ক্ষমতা ৩০০ মেগাওয়াট।