মানসম্পন্ন হওয়ায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) উৎপাদিত বিটুমিনের চাহিদা দেশজুড়ে। বিপিসির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি “৬০-৭০” ও “৮০-১০০” দুই গ্রেডের বিটুমিন উৎপাদন করে। সরকারি সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণে আগে থেকেই অপরিহার্যভাবে বিপিসির উৎপাদিত বিটুমিন ব্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মেগাপ্রকল্পে বাল্কে বিটুমিন সরবরাহের কারণে, ড্রামে সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিপিসির বিটুমিন সরবরাহে সংকট তৈরি হয়।
বিপিসির বিটুমিন সংকটে চট্টগ্রামে সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে স্থবিরতা শুরু হয়। বিশেষত সরকারের ফার্স্ট ট্র্যাক (অগ্রাধিকার) প্রকল্পের কয়েকটি নির্ধারিত সময়ে শেষ করা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়। অভিযোগ উঠেছে, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিটুমিন বাজারে আনার প্রক্রিয়া সহজতর করতে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে সংশ্লিষ্টরা।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) চট্টগ্রাম বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জুলফিকার আহমেদ গতকাল বৃহস্পতিবার দৈনিক আজাদীকে বলেন- বিপিসির বিটুমিনের মান উন্নত। যে কারণে সড়ক ও জনপথের প্রত্যেকটি কাজে বিপিসির “৬০-৭০” গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহারের নির্দেশনা থাকে। এখন বিটুমিনের সংকট চলছে। মেগাপ্রকল্পগুলো যেমন- চট্টগ্রামে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সড়কগুলো সরকারের। বিটুমিনের কারণে আমাদের প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ৫টি প্রকল্পে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল সরকারের একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প। রাঙামাটি ফোর লেন, হাটহাজারি-ফটিকছড়ি-খাগড়াছড়ি, বড়তাকিয়া-আবু তোরাব ইকোনমিক জোন, ফটিকছড়ি থেকে হেঁয়াকো আঞ্চলিক মহাসড়ক যথাযথ মানে উন্নীতকরণ এবং জেলার সড়ক যথাযথ মানে উন্নয়ন প্রকল্পের ৫টি সড়ক রয়েছে। তিনি বলেন, মাঝে-মধ্যে অল্প কিছু বিটুমিন পাওয়া যায়। সেগুলোর কাজ শেষ করে আবার বসে থাকতে হয়। শুধু চট্টগ্রাম মহানগর নয়, সড়ক জনপথের প্রায় সবগুলো প্রকল্পেই স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। এলজিইডি চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ওয়াহিদুজ্জামান গতকাল বৃহস্পতিবার দৈনিক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামে বিটুমিনের সংকট চলছে। যেসব সড়কের ম্যাকাডাম (ইটের কাজ) হয়ে গেছে, সেগুলোতে নির্ধারিত সময়ে কার্পেটিং করা না গেলে ম্যাকাডামগুলো নষ্ট হয়ে পড়বে। আমাদের প্রায় ৭শ থেকে ৮শ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। তন্মধ্যে এই অর্থবছরেই একশ কোটি টাকার সড়ক মেরামত কাজ চলমান রয়েছে। যেগুলো বিটুমিন সংকটে নির্ধারিত সময়ে করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, বছরে প্রায় ৬০-৭০ হাজার মেট্রিক টন বিটুমিন উৎপাদন করে ইস্টার্ন রিফাইনারি। যার সবগুলোই বিপণন করে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, এসএওসিএল। বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ জানুয়ারি ইস্টার্ন রিফাইনারিসহ চার বিতরণ কোম্পানিতে সবমিলিয়ে বিটুমিনের মজুদ ছিল প্রায় ১৭৩৮ মেট্রিক টন। তথ্য অনুযায়ী, ইস্টার্ন রিফাইনারিতে “৬০-৭০” এবং “৮০-১০০” মিলে বাল্কে ও ড্রামে ১৩শ টন বিটুমিন মজুদ ছিল। তবে ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে “৬০-৭০” গ্রেডের বিটুমিন সরবরাহ বন্ধ থাকায় বিতরণ কোম্পানিগুলোতে মজুদ থাকা সবই “৮০-১০০” গ্রেডের ড্রামভর্তি বিটুমিন। তন্মধ্যে পদ্মা অয়েল কোম্পানিতে ২৩ টন, যমুনা অয়েল কোম্পানিতে ১১২ টন, মেঘনা পেট্রোলিয়ামে ৫৩টন এবং স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডে (এসএওসিএল) সর্বোচ্চ ২৫০ টন বিটুমিন মজুদ ছিল।
বর্তমানে ড্রামের ক্ষেত্রে “৬০-৭০” গ্রেডের ১৫০ কেজির প্রতি ড্রামের মূল্য ৭২০০ টাকা, “৮০-১০০” গ্রেডের মূল্য ৬৮০০ টাকা। চাহিদার কারণে বিতরণ কোম্পানিগুলো থেকে ড্রামপ্রতি আরো এক হাজার টাকা দাম বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে বলে জানিয়েছে বিপিসি। অথচ একই সময়ে ২০২০ সালের শুরুতে ৬০-৭০ গ্রেডের মূল্য ৮৯০০ টাকা এবং ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিনের দাম ছিল ৮৫০০ টাকা।
বিটুমিন সংকটের কথা স্বীকার করেন বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিতরণ) মোরশেদ হোসাইন আজাদ। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বর্তমানে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিনের কিছু সংকট রয়েছে। কারণ বাজারে চাহিদা বেড়ে গেছে। তাছাড়া দেশে বড় বড় মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব প্রকল্পেও বিটুমিন সরবরাহ দিতে হচ্ছে বিপণন কোম্পানিগুলোকে। মেগাপ্রকল্পের জন্য বাল্কে বিটুমিন সরবরাহ দেয়া হচ্ছে। যে কারণে ড্রামে সরবরাহ বন্ধ রেখেছে ইস্টার্ন রিফাইনারি।’
এদিকে একটি বেসরকারি কোম্পানির বিটুমিন বাজারজাত করতেই কৃত্রিম সংকটের অভিযোগের বিষয়ে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) সৈয়দ মেহদী হাসান বলেন, ‘এ বিষয়টি সম্পর্কে আমি জ্ঞাত নই।’ অন্যদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘একটি বেসরকারি কোম্পানি ইতোমধ্যে বিটুমিন উৎপাদন শুরু করেছে। তারা বিটুমিন বাজারজাত করার জন্য বিপিসি থেকে এখনো অনুমতি পায়নি। তাদের অনুমতি পাওয়ার বিষয়টি সহজতর করতে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হতে পারে। অন্যথা মেগাপ্রকল্পগুলোতে বাইরে থেকে উন্নতমানের বিটুমিন আমদানি করে ব্যবহার করা যেতো। এতে সড়ক জনপথ এবং এলজিইডির সড়কগুলোর উন্নয়ন ও মেরামত কাজে বিটুমিন সরবরাহ সহজ হতো। সড়কগুলোও টেকসই হতো।’