বেশ ক’দিন ধরে তাপদাহে পুড়ছে দেশ। অসহনীয় গরমে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডায়রিয়া রোগের প্রকোপ। গত কয়েকদিনে চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এর মাঝে ১২ এপ্রিল ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ১৩ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে।
চিকিৎসকরা বলছেন, প্রচণ্ড তাপদাহে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে শরীরে অতিমাত্রায় পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে, যার কারণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই পানিবাহিত এ রোগ নিয়ে সতর্ক থাকা, লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া এবং গরমে বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের আলাদা যত্ন নিতে পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৫ এপ্রিল ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ৫৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছে চমেক হাসপাতালে। এর মাঝে শিশু ওয়ার্ডে (৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডে) ২৪ জন এবং মেডিসিন ওয়ার্ডের তিনটি ইউনিটে ৩২ জন রোগী ভর্তি হয়। ১৪ এপ্রিল ভর্তি হওয়া ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪৯ জন। ১৩ এপ্রিল ভর্তি হয় ৩২ জন। হাসপাতালের সেবা তত্ত্বাবধায়কের অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২৮ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ২২ জন। মার্চ মাসের শেষ দিকেও এ সংখ্যা বেশি ছিল না। ৩০ মার্চ হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২৮ জন। তবে সপ্তাহখানেক ধরে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ ১৫ এপ্রিল ৫৬ জন রোগী ভর্তি থাকার তথ্য জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হিসেবে বর্তমানে ভর্তি থাকা এই রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিকের সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। আর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত দুজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে এ হাসপাতালে। এর মাঝে একজনের মৃত্যু হয় ১২ জানুয়ারি। ১৩ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে ১২ এপ্রিল। চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান আজাদীকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি হাসপাতালে ৭১ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয় ১৫ এপ্রিল। অথচ ৬ এপ্রিল ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা ছিল ২৫ জন। ১০ এপ্রিল ভর্তি হয় ৪১ জন। ১২ এপ্রিল ৫২ জন এবং ১৪ এপ্রিল ভর্তি হয় ৬৭ জন। সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ/তিনগুণ হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিআইটিআইডির সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. মামুনুর রশীদ। ১২০ শয্যার হাসপাতালে ৭১ জনই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রয়েছে বলে জানান তিনি। এছাড়া চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল এবং আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালেও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে বলে হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডায়রিয়া মূলত পানিবাহিত (ব্যাকটেরিয়াজনিত) রোগ। পানির কারণেই এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। শিশু থেকে শুরু করে তরুণ–বয়স্ক কম–বেশি সবাই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। গরমে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের হার বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ডা. মামুনুর রশীদ বলছেন, গরমে পানি পানের তৃষ্ণাটা বেড়ে যায়। অর্থাৎ প্রচুর পরিমাণে পানি পান করে। এক্ষেত্রে যেখানে যেমন পানি পাওয়া যায়, তাই পান করে বসে। অনেকাংশে দেখা যায়, এমন পরিস্থিতিতে মানুষ বিশুদ্ধ পানি বাদ দিয়ে অস্বাস্থ্যকর পানিও পান করছে।
এই সময়ে রোজার একটি বিষয় আছে। ইফতারের সময় হলে মানুষ যে কোনো স্থানে (পথে–ঘাটে) খাবার–পানি গ্রহণ করছে। এখানে সবসময় স্বাস্থ্যকর খাবার–পানি নিশ্চিত হচ্ছে না। এটাও একটা বড় বিষয়। আর অনেককে বলতে শুনেছি, তরমুজ খেয়ে তার পেট খারাপ হয়েছে। এর কারণ হিসেবে এই চিকিৎসক বলেন, তরমুজ কেটে যদি ফ্রিজে রাখা হয়, তবে সেখানে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া জমে যেতে পারে। সেটি খাওয়ার পর ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিতে পারে। তাই তরমুজ কেটে ফ্রিজে রাখা উচিত নয়। গোটা তরমুজ ফ্রিজে রাখা যায়। কিন্তু কাটার পর যেন তরমুজ ফ্রিজে রাখা না হয়।
পানিবাহিত এ রোগ থেকে রক্ষা পেতে করণীয় বিষয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, যেখানে–সেখানে যা–তা খাওয়া যাবে না। স্বাস্থ্যকর খাদ্য ও পানীয় নিশ্চিত করতে হবে। রাস্তায় বিক্রি করা শরবত খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। খাওয়ার আগে অবশ্যই হাত–মুখ সাবান দিয়ে ধুতে হবে। পানি একশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ফুটিয়ে পান করতে হবে। অর্ধসিদ্ধ মাংস ও রাস্তার খাবার (স্ট্রিট ফুড) খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রয়েছে জানিয়ে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, রোগীর সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বাড়ছে। আমরাও প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি। পর্যাপ্ত স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুদ রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছি। যাতে কোনো সংকট দেখা না দেয়। তবে এই গরমে খাবার ও পানি পানের ক্ষেত্রে মানুষকে আরো বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।