বাউলেরা আধ্যাত্মিক গান করেন। এই গান সাধকের গান। বাউল দর্শনে ধর্ম সাধনার বাণী আছে। একতারা সুর ঝংকারে সেই বাণী হৃদয় থেকে হৃদয়ে অনুরণন তোলে। বাউল সাধনার আশ্রয় সংগীত, তাদের সাধনা সহজ পথের সন্ধান। সংগীতের মাধ্যমে তারা সেই পথের সন্ধানে লিপ্ত। তাই এগানের আবেদন অন্তর্ভেদী। বাউলের সাধনার তৃপ্তি বাউল গানেই প্রকাশিত। প্রকৃত পক্ষে ভাবই বাউল গানের মূল সূত্র। ড. এনামুল হক তার বই ‘মনিষা-মঞ্জুসার’ (১ম খণ্ড মুক্তধারা ১৯৭৫ এ প্রকাশিত) তার প্রবন্ধে ‘বাউল’ গান পরিচিতির মূল সূত্রে’ উল্লেখ করেছেন ‘যে ভাব লইয়া আমরা বাউল গান চিনি তাহার বাণীতে প্রধানত থাকে কূট রহস্যের অতল রঞ্জন। সে গান মর্মের, বৈরাগ্য, উদাস্য, সংসার অনিত্যতা ও তত্ত্বের। মুখ্যত এ কয়েকটি বিষয়ের এবং গৌনত ইহার আরো একটি আনুষাঙ্গিক বিষয়ের সংমিশ্রণে বাউল গানের মধ্যে যে একটি অপূর্ব যোগ সূত্রের সৃষ্টি হয় তার অস্পষ্ট মাপকাঠিই আমাদিগকে বাউল গান চেনার পক্ষে সহজ করে তোলে। সংক্ষেপে, লোকে যাকে সচরাচর ভাবের, তত্ত্বের, মারফতের গান বলিয়া পরিচয় দিয়ে থাকে তাই বাউল গান”।
বাউলরা মিলনের, বিচ্ছেদের, বিরহের ও মিনতির গান করে। মাশুকের সঙ্গে আশিকের দিদার পাওয়ার গান, প্রেমের গান। তারা ভাবেন বৈরাগী ভাবই তাদের ধর্ম। আসলে রূপে রাগ হয়ে বাউলরা পৌঁছায় ভাবে। বাউলরা যাকে খোঁজে তা হলো মরণ ফাঁদ, শ্যাম সুখপাখি, হৃদপিঞ্জর, প্রেমের শিকল, কারাবন্ধী, দেহবৃন্দাবন।
সাধক দুদ্দু শাহ বলেন, বাউল মানুষ ভজে, যেখানে নিত্য বিরাজে, বস্তুর অমৃতে মজে, নারী সংগী তাই।
বাউলরা বাস্তববাদী :
তাই, বাউল জীবন জানতে হয়, কেমন জীবন বস্তু, কিসে জন্ম? কোথায় লয়?, যে বস্তু জীবনের কারণ, তাই বাউল করে সাধন।
বাউলরা প্রধানত দেহ তত্বের গান করে। নিজের দেহকে জানা, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা, এর মধ্যদিয়ে আনন্দ স্বরূপের আস্বাদন এসবই বাউলদের লক্ষ্য। ভাবের দিক থেকে বাউলগান বাংলা গানকে নানামাত্রায় সমৃদ্ধ করেছে। ফকির লালন, পাঞ্জু শাহ্ হাউরে গোঁ সাঁই, কবির, যাদু বিন্ধু, জালাল, দীন শরৎ, রশিদ, দুদ্দু শাহ্, রাধারমন, ফুলবাস উদ্দীন, দুরবীন শাহ, পদ্মলোচন, সীতালং শাহ্, হাসন রাজা, শাহ্ আবদুল করিম, আরকুম শাহ্ সহ অনেকেই রচনায়, শব্দে, ভাবে, চিন্তায় তা প্রভূতরূপে মানব সম্মুখে প্রকাশ পেয়েছে।
বাউলরা পাখির মতন। মুক্ত ডানা যেমন পাখীর।
বাউলরা প্রেমের সাধক। সে প্রেম মানবাশ্রয়ী। মানব দেহের মধ্যে তারা মনের মানুষ, অধর মানুষ, রসের মানুষ, সোনার মানুষ, আলেক মানুষ, ভাবের মানুষ, অচিন পাখিকে খোঁজেন।
তাদের শিক্ষা : আপন ভজন কথা, না কহিবে যথাতথা, আপনাতে আপনি হইবে সাবধান।
বাউলের ঘর বাড়ি নেই। বেশভূষা ও সামাজিক রীতিনীতিতে চরম স্বৈরাচারী। লোকাচার বর্জনকারী, নিজের ভাবে নিজের ভাবনায় মশগুল তারা সর্বক্ষণ।
বাউলগন থাকে ভাবে উদাসীন। চালচুলো ছাড়া, কিন্তু ব্যবহারে সধানন্দ ও সদাসংগীতময়।
তাদের মন্ত্রঃ লোক মধ্যে লোকাচার, সৎ গুরুতেই একাকার।
বাউলরা গান করেন সাধনমার্গীয়, ভাবনা নির্ভর ও আত্মমগ্ন, গভীর ও জটিল বিষয়ে। তারা বহিরঙের দিক থেকে নিতান্ত সরল অথচ ভাবব্যঞ্জনার দিক থেকে রীতিমত দুরূহ ও রহস্যময় জগতের মানুষ গান করেন সুরে সুরে অনির্বাণ কিছু শব্দ ও রূপকল্পের আদলে।
সৃষ্টি তত্ব ও দেহ তত্ব, নিগুঢ়তত্ত্ব, চারিচন্দ্র সাধনা, যোগতন্ত্র, কুন্ডলিনী শক্তি, দ্বি-দল, সহস্ত্র দল, ব্রহ্মজ্ঞান, দশমীদ্বার, পাক পাঞ্জাতন, চার লতিফা, মোরাকাবা, মোশাহেদা, ফানাফিল্লাহ্, বাকাবিল্লাহ্ ইত্যাদি শব্দ ও রূপকল্পের ব্যবহার বাউলদের সংগীত জীবন প্রণালীতে দৃষ্ট হয়।
বাউল মতবাদ ভোগমোক্ষবাদ। শিবশক্তি, রাধাকৃষ্ণ, পুরুষপ্রকৃতি তত্ত্ব ও নানা লৌকিক তত্ত্ব সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাউল তত্ত্ব। এখানে গুরু, মৈথুন ও যোগ তিনটি বিষয় সমগুরুত্বপূর্ণ।
বাউল মতে আত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন। তাদের কাছে আল্লাহ পরমাত্মার শ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা। আত্মাকে জানলে পরমাত্মাকে জানা যায়। দেহস্থিত আত্মাই মনের মানুষ, রসের মানুষ, অলক সাই।
বাউলদের রসস্বরূপ হচ্ছে সাকার দেহের মধ্যে নিরাকার আনন্দ স্বরূপ। আত্মাকে স্বরূপে উপলব্ধি করার প্রয়াস। এটাই অটল মানুষ তথা আত্মতত্ত্ব। এ হচ্ছে অরূপের কামনায় রূপ সাগরে ডুব দেয়া। স্বভাব থেকে ভাবে উত্তরণ।
বৌদ্ধ সহজিয়া, বৈষ্ণব সহজিয়া, নাথ পন্থ তন্ত্র ও সূফিবাদ মিলে মিশে এক অদৃশ্য দ্রবণে জন্মেছে বাউল দরবেশ, ফকিরদের রহস্য সংকুল রূপময় জগৎ।
বাউলরা নিজেরদের মধ্যে গুটিয়ে থেকে কায়া সাধনা ও গান গেয়ে এসেছেন। নীড় হাড়া পাখির মতন বন্ধনহীন জীবনে পথ চলাতে সমধিক আনন্দ তাদের।
বাউল জীবনের কবোষ্ণতাপ, তার পোশাকের মন্ডনধর্ম, তার গানের উদার মানবিকতা, তার বন্ধনহীন পথ চলা এক অলক্ষ অন্বিষ্টের মত।
বাউল গানের শব্দ রূপকল্প, ভাবের রসিক ছাড়া কেউ সহজে বুঝে না। বাউল গানের ভিতর আকুতি ও ক্রন্দন যিনি ধরে রাখেন তিনি মুরশীদ।
বাউলের মাঝে থাকে প্রেম, বিশ্বাস, সংশয়, অনুরাগ, অনুযোগ ও সমর্পণ। তারা মুরশিদ খোদা অভেদ ভাবে।
মানব দেহকে বাউলরা কোরান ভাবে। তারা বলে, যাহা নেই ভান্ডে অর্থাৎ মানবদেহে, তাহা নেই ব্রহ্মাণ্ডে। এই ভাণ্ড ব্রহ্মাণ্ডই মানবদেহ মানব জীবন। তারা ভাবে আল্লাহ, আদম, সাই, নিরজ্ঞন সকলি এক। তারা গানে গানে প্রশ্ন তোলে, কে আমি? কি আমার পরিচয়, কে সৃজিল আমায়? যে আমায় সৃজক তাকে কে সৃজন করেছে? বাউলরা গানে গানে মিনতি করেন মানুষ ভজ পরম তত্ত্ব জান। দৃশ্যমান জগতে সবই সত্য বলে বাউলদের কাছে স্বীকৃত।
ভক্তি বাউলগণের প্রধান বিষয়। নিজের ভিতর জিজ্ঞাসার সূত্রপাত করেন বাউলরা। বাউলদের অন্তর্নিহিত দর্শন একরৈখিক। তারা অচিরস্থায়ীত্বের বেদনাকে সম্বল করে করেন আত্মবিচার ও আত্মবিচার থেকে আত্মনির্মোহোতায় উপনীত হতে চায়।
তাদের তত্ত্ব ভোগ নয় ত্যাগেই মুক্তি। পৃথক ভোগবাসনা নয় চিত্ত শুদ্ধিই আসল বাসনা। পথের শেষে যাকেই পায় নিশ্চিত জেনে তার নিকট পৌঁছানোর কথাই রূপকল্পের আবরণে প্রকাশ করেন বাউলরা। সৃষ্টির নিগুঢ় তত্ত্বই বাউল গানের প্রকাশ পায়।
বাউল গানের রচয়িতা বাউল হলেও তার গানের ভিতরের ক্রন্দন ও আকুতি যিনি ধরে রাখেন তিনি মুরশিদ। মুরশীদকে যে চিনতে পারে সেই বাউলকে চিনে। আমরা মুরশীদকে উচ্ছারিত হতে শুনি বাউলের কন্ঠে, বাউলের আলাপে ও দীর্ঘশ্বাসে। আর বাউল তাকে চিনে নেন প্রেমে বিশ্বাসে, সংশয়ে, অনুরাগে ও সমর্পণে।
বাউলে আছে সূফি প্রভাব, বৈষ্ণ প্রভাব, বৌদ্ধ প্রভাব, যোগতন্ত্র কুণ্ডলিনী শক্তির প্রভাব। তা সত্ত্বেও বাউল একক, উন্মুক্ত।
লক্ষ্যণীয়: বাউলের গানে শব্দের তাৎপর্য ব্যাপক।
বাউলেরাতো মনে করেন সৃষ্টি লীলা অনুধাবন করতে হলে শব্দ ধরতে হয়। শব্দের মানে বুঝতে হয়, শব্দ রহস্য ভেদ করে যেতে হয়।
যিনি শব্দ আত্মস্থ করতে পারে একমাত্র তারই ব্রহ্মজ্ঞান জন্মে। শব্দ যে ধরতে পারল না তার কাছেই আত্মজ্ঞান অজানা থেকে গেল।
সূফি বা বাউলরা উভয়ে শব্দ ধরে শব্দের সাধনা করে। শব্দের সাকার দেওয়া থেকে শব্দ যেখানে গিয়ে নিরাকার সর্বত্র তারা অন্বেষণ করেন। তাদের বিশ্বাস পরম নূর নিজের বৈশিষ্ট প্রকাশ করবার অভিপ্রায়ে এক থেকে দুই হন, যুগলরূপে নূরে কারে লীলা করেন আর লীলা শেষে দুই মিলে এক হন। এক নৈঃশব্দে সুপ্ত থাকেন আবারো শব্দের পুনঃ আগমনের জন্য অপেক্ষা করেন।
সূফি সাধকদের এরকম একটি বিশ্বাস লালন করতে দেখা যায় যে, পরম সত্তা অর্থাৎ আল্লাহ হলেন নূর বিশেষ। এই নূর সকল কার্যকারণ ও শব্দের আধার। বস্তু রাশির মধ্যে নূরের অবস্থান অত্যন্ত সূক্ষ্ম। যে এই সূক্ষ্মের মর্মভেদ করতে পারে সেই ইহকালে পায় মোক্ষ ও মুক্তিও। সূফিরা এই নূরকে পরম নূর হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।
বাউলরা মনে করেন মনের মধ্যে একটি পরম মন আছে, বাউলের আদর্শ হচ্ছে সেই মনের মানুষ। মনের মানুষকে বাউলরা খোঁজ করেন আপন মনের গহন আনন্দে, গুরুবন্দনায়, বাউলদের কথায় মনসাধনা হতে হবে পরম মানুষ।
বাউলদের নিকট বিশ্ব, বিশ্বমানব ও বিশ্বপ্রকৃতির চৈতন্য জাগরণের আনন্দাগার।
সূফি ও বাউলদের ব্যাখ্যায় সৃষ্টির আদিতে শুধু ‘পরমনূর’ ছিলেন। ‘পরমনূর’ রূপে তিনি অখন্ড নিরাকার হয়ে নৈঃশব্দে বিরাজ করছিলেন। নৈঃশব্দে বিরাজ কালেও তার মধ্যে শব্দ এ সাকার দেওয়ার বাসনা গুপ্ত ছিল। সহসা বাসনা গতি পেল শব্দিত হওয়ার ইচ্ছায়। নৈঃশব্দকে শব্দ দিয়ে ভাবিয়ে তোলবার আকাঙ্ক্ষায় তিনি উচ্চারণ করলেন শব্দ। বল্লেন কুন বা হও। অতপর নৈঃশব্দ ধীরে ধীরে শব্দ এ ব্যাপ্তি পেল, পৃথিবী শব্দের কলতানে মুখরিত হয়ে উঠলো। এতোদিন যে অপার নৈঃশব্দে তিনি স্থির অচঞ্চল ছিলেন তা ছিলো শূন্যকার, শূন্যকারে ‘পরমনূর’ শব্দের শরীর নিলেন। অতপর অন্ধকার, ধন্ধকার, হুংকার, দীপ্তিকার, কুয়াকার হয়ে শব্দ ভাসলেন নীর সাগরে।
প্রথমে শুধু আমির অস্তিত্ব ছিলো নীর সাগরে ভেসে। আমি খণ্ডিত হলেন শব্দ শরীরে। আমি বা পরমাণুর এইবার ভিন্নরূপে নরেকারে নেহার করে আকার ও শব্দায়মান হলেন- মানুষ জন্ম নিলো।
এ গান এক ব্যক্তির গান। নির্জনের গান, গুরুমুখী সাধনা। গুরু বা সদগুরু তিনি যিনি শিষ্যের ভিতর সৎতর্ক উদ্বোধন করে তাকে সঠিক পথে চালিত করেন এবং নিরবচ্ছেদ মুক্তির পথের সন্ধান দেন।
বাউল- সাধনা সূফি এবং বৈষ্ণব-সাধনার মতোই প্রেমমূলক সাধনা। প্রেম সাধনা ছাড়া বাউলদের পক্ষে প্রকৃত সিদ্ধিলাভ সম্ভব নয়। প্রেম তত্ত্ব জানতে হলে গুরুর সান্নিধ্য প্রয়োজন। আবার কৃষ্ণই বাউলের পরম বন্ধু কালা বাউলের কালাচাঁন, প্রেমনাথ। বাউলের মন প্রবন কাষ্ঠের নৌকার কাণ্ডারী একজনই। তিনি কৃষ্ণ, কানাই।
রাধারমণ তাই গেয়ে উঠেন ‘মুইরাধা মরিয়া যাইমু কৃষ্ণ হারা হইয়ারে ভমর কইয়ো গিয়া’। কৃষ্ণ বিনে যার একদিনই চলে না। একমাত্র প্রাণনাথের বিরহে বাউল গাইতে পারে এ রকম মর্মস্পর্শী গান।
প্রেম ধর্মে আজন্ম বিশ্বাসী বাউল তাই সর্বদা কৃষ্ণ প্রেমে আকুল। সর্বদা তার হৃদয়পুরে রাধা বোল, সর্বদা তার ত্বন, মন, চিত্ত রসের বৃন্দাবন। আপ্ততত্ত্বই বাউলের মতে সিদ্ধি অর্জনের আসল মন্ত্র। তন মনে তারা ভজনা করেন। আপ্তবাক্য সম্বল করে তন-পথে হাঁটা দেন বাউল। বাউল ধর্মে লোভ, মোহ, মাৎসর্য পরিত্যাজ্য।
ফানা সূফীদের মতো বাউলদেরও অভিষ্ট। বাউলরা ভাবের বৈরাগী, ভাবুব-ভাব তার ধর্ম, এতেই ব্রহ্মত্ব। ভাব ও তন সাধনায় প্রাণিত করে মৃত্যু ও ক্ষনিকতা বাউলকে আত্মানুসন্ধানে ব্রতী করে।
তাদের সাধনা গুরুমুখী, চলেন আপন খেয়ালে।
‘গু’ শব্দটি আলো
‘রু’ শব্দটি আধার
গুরু সেই অন্ধকার ভেদ করে শিষ্যকে আলোর পথে উত্তরণ ঘটান। স্থ্থূল, প্রবর্ত, সাধক, সিদ্ধ এ চার স্তর বাউল তার সাধনায় অতিক্রম করে।
জীবনে কর্মে গানে নির্বাধ ভালোবাসায় বাউলরা নিজস্ব প্রতিকৃতি নিয়ে রচনা করেছেন এক অলৌকিক ভুবন যা একই সংগে লৌকিকও, উদাসী মুক্ত বিহঙ্গতার একটি কল্পরূপ। যারা রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণ, শব্দ, স্পর্শের মাধ্যমে দেহের ভিতর দিয়ে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি মানুষ লীলার বিচিত্র রহস্যের সন্ধানে মগ্ন হয়ে আছে।
বাউলরা গান গেয়ে সাধনা করেন বলে তারা দালান-কোঠা, ঝারি-লোটা, ধুতি-চাদর সবই ত্যাগ করে। বাউল গানের চিত্তাকর্ষক ছন্দ, সুর এবং প্রকাশ ভঙ্গি সরল অথচ সুগভীর অর্থ সম্পন্ন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন: অনেককাল পর ক্ষিতিমোহনসেন মহাশয়ের অমূল্য সঞ্চয় থেকে এমন বাউলের গান শুনেছি ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের ছন্দে যার তুলনা মিলে না। (হারামনি পৃষ্ঠা-৫-৬) বিস্ময়, মুগ্ধতা, ক্ষোভ, কৌতুক, সমস্ত বৃত্তি ও ভাব ব্যক্ত করে গানের মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে সাধন পদ্ধতির পর্যায় বা স্তর নির্দেশ করেন বাউলরা।
বাউলরা যে পথের ধুলার পথিক। কোন কোন বাউলের সুরে আমরা লোকজীবনের ভাষা বাগ্বিধি, বাগধারা, অনুষঙ্গ, পুরান প্রসঙ্গ, আদির কিছু না কিছু উপাদান পেয়ে যাই। আর পাই গানের সুরে, উচ্চারণে, গায়কীতে আঞ্চলিকতার প্রকট। অচিন পাখি, মানবতরী, মায়ার ফাঁদ, ভাবের প্রদীপ, চিত্তাকাশ, অধরা, দমের খেলা, ঘরের চাবি, পারের কর্তা, জীবন দেবতা, জীবন নৌকা, মনের মানুষ, অন্তর্যামী, পরমাত্মা, মাটির সারিন্দা, বন্ধে, প্রাণবন্ধু দয়াল, দয়াময়, সুয়াচান পাখী, নিরঞ্জন, মাটির পিঞ্জিরা, দেহ তরী, মনমহাজন, হাওয়ার পাখী, খাকের পিঞ্জর, সুজন কান্ডারী, সুজন বন্ধু, তিবেণীর ঘাট, ত্রিকাল, ত্রিকূল, ত্রিলোক, প্রকৃতির তিন ধর্ম, স্বত: রজ: তম, জীবনের তিনরূপ, সজিবতার তিন গতি, সপ্তলোক, ত্বণ, অন্তরা, রসিক নটবর, বারিতালা, ফানাফিল্লাহ্, অফস্, লতিফ, লাহুত দেশ, সছিফ, ফানা, বকা, মনকা, ফলক, ছিরা, তকি আকদা, নফি, এজবত, জজব, রূপের ঘর অটলরূপ, ফনি মনি জিনি, রূপের বাখানি, রাগেরদেশ, রাগের তালা, রূপের দরজা, রূপের তালা, কামনদী, মুলের মানুষ, অধর মানুষ, কাজলকৌটার মর্ম ও শব্দার্থ খুঁজতে খুঁজতেই বাউলের জীবনের বিনাশ হয়।