স্কুল জীবনে রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী রচিত একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম। প্রবন্ধটির নাম ছিল ‘সুখ না দুঃখ’। এই প্রবন্ধটি সাধু ভাষায় রচিত। প্রবন্ধের মুখ্য আলোচ্য বিষয় ছিল বাস্তব জীবনে সুখের মাত্রা অধিক, নাকি দুঃখের মাত্রা অধিক। এ বিষয়ে লেখক সাধু ভাষায় সুন্দর সুন্দর যুক্তি তুলে ধরেছেন। লেখকের মতে, বাস্তব জীবনে কোনটির মাত্রা অধিক তা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিতর্ক আছে। প্রবন্ধটির ভাষা অনুসারে ‘জীবনের সুখ অধিক, জীবনের অস্তিত্ব তাহার প্রমাণ। জীবনে সুখ না থাকিলে অর্থাৎ সুখের মাত্রা অধিক না হইলে, মানুষ বাঁচিতে চাইবে কেন? মানুষ যে বাঁচতে চায়, অবশ্য দুই চারিটা আত্মঘাতীকে বর্জন করিয়া ইহাই সুখের মাত্রাধিক্য প্রমাণ করিতেছে। মানব জীবনে দুঃখের ভাগ অধিক হইলে মানবের জন্য দড়ি কলসী যোগান এতদিন ‘বিরাট’ ব্যাপার হইত, বসুধা এতদিন জীবহীন মরুভূমিতে পরিণত হইত’।
চমৎকার সাধু রীতিতে ব্যাপক যুক্তি তর্ক উপস্থাপনের পর লেখক বাস্তব জীবনে সুখের আধিক্যকে বেশি যেমন বলেননি তেমনি দুঃখের আধিক্যকেও অধিক বলেননি। অবশেষে উক্ত প্রবন্ধ থেকে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে সুখ হচ্ছে একটি অলিখ বস্তু। যে ব্যক্তি যে অবস্থায় নিজের মধ্যে সন্তুষ্টি অর্জন করে সেই ব্যক্তির নিকট তাহাই সুখ এবং উক্ত ব্যক্তি সুখী। আর না পাওয়ার আশাটাই হলো দুঃখ। যে কারণে দরিদ্র ব্যক্তিও নিজকে সুখী মনে করতে পারে। আবার ধনী ব্যক্তিও বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে নিজকে সুখী মনে নাও করতে পারে। এজন্য প্রবন্ধটির সর্বশেষে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, কোন ব্যক্তি যা পেয়ে বা অর্জন করে নিজকে সুখী মনে করে তাহাই সুখ।
কিন্তু বাংলাদেশ কি সুখী দেশ? জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক সুখ দিবসে ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট বা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২০২৪ সালের মার্চ মাসেও তা প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য ২০১২ সালের পূর্বে ইউরোপের কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সকল দেশের ওপর সুখের জরিপ পরিচালনা করতো। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব ইকোমিক সারা বিশ্বের সুখের ওপর এক জরিপ পরিচালনা করে। উক্ত জরিপে দেখা যায়, সেই সময়কালে বাংলাদেশ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের দেশ। সেই জরিপে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল ৪৬তম আর যুক্তরাজ্যের অবস্থান ছিল ৩২তম এবং ভারতের অবস্থান ছিল ৫ম। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ মনে করে অর্থ ও সম্পদ থাকলে সাধারণত মানুষ সুখী হয়। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জিডিপির হার বেড়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, দারিদ্র্য কমেছে আয়ুষ্কাল বেড়েছে। অথচ ২০২৪ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় সুখী দেশের যে তালিকা প্রকাশিত হয় তাতে দেখা যায়, সারা বিশ্বে ১৪৩ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯ তম। ২০০৬ সালে যেখানে সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ছিল প্রথম সেখানে ১৮ বছরের ব্যবধান বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ১২৯ তম। তাহলে কী সুখী দেশের তালিকায় ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে? দেশ আস্তে আস্তে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় এদেশের জনগণের আয়ুষ্কাল বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে। এদেশের জিডিপি (Gross Domestic Product) যেমন বেড়েছে তেমনি মাথাপিছু আয়ের পরিমাণও বেড়েছে। তাহলে কি উন্নয়নের সাথে সুখী দেশের বিপরীত সম্পর্ক।
প্রকৃতপক্ষে অর্থ আয় সম্পদ থাকলে মানুষ সুখী হতে পারে, এ কথা সত্য নয়। সুখের পরিমাপে জরিপ করার সময় যে বিষয়গুলো দেখা হয় তা হলো, ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক, সুস্বাস্থ্য ও পেশাগত সন্তুষ্টি ইত্যাদি। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে পারস্পারিক আন্তঃসম্পর্ক, সামাজিক ও আত্মীয়তার সম্পর্ক, সামাজিক মূল্যবোধ ছিল গভীর যা এখন ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। তাছাড়া ২০০৬ সালের দিকে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে তেমন ব্যবধান না থাকলেও বর্তমানে এ ব্যবধান প্রকট। ২০০৬ সালের তুলনায় প্রাপ্তির পরিমাণ বাড়লেও প্রতিটি মানুষের প্রত্যাশার পরিমাণ বেড়েছে এর চেয়ে বহুগুণ বেশি। ফলে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিশাল ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিস্কার হয়। ২০০৬ সালের সময়কালে একজন ভিক্ষুককে চার আনা বা সর্বাধিক আট আনা ভিক্ষা দিলে বেশ খুশি হয়ে তা গ্রহণ করতো। আর বর্তমানে যে কোন ভিক্ষুককে পাঁচ টাকার কম ভিক্ষাতো দেয়া যায় না, বরং কোন কোন সময় পাঁচ টাকা নেয়ও না। কারণ ভিক্ষুকদের প্রত্যাশা বেড়েছে বহুগুণ। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির এই ব্যবধানের কারণে সুখ নামক বস্তুটি তিরোহিত।
এবার আসা যাক প্রত্যাশা বৃদ্ধির কারণ। মানুষ মাত্রই সামাজিক জীব। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ সামাজিকভাবে বসবাস করে। সমাজে যখন দুর্নীতি, ঘুষ, চৌর্যবৃত্তি এবং সামাজিক অপরাধ বেড়ে যায় তখন একই সমাজ ব্যবস্থার কিছু মানুষের আয়, দুর্নীতি, চুরি, চাঁদাবাজী বেড়ে যাওয়ার কারণে এসব চোরগুলোর আয় বেড়ে যায়। সন্ত্রাসী, চোর দুর্নীতবাজরা হয়ে উঠে প্রচুর সম্পদের মালিক। বিশাল বিশাল বাড়ি, গাড়ী ও অন্যান্য সম্পদের মালিক বনে যায় তারা। তারই পাশে বসবাসরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তখন নিজকে অসহায় মনে করে ও নিজের অজান্তে সমাজ ব্যবস্থার কাছে অপরাধী হয়ে যায়। পারিবারিকভাবেও অসহায় হয়ে যায়। এ অবস্থায় যে যে পদে দায়িত্বরত সেই ব্যক্তিদের প্রত্যাশা বাড়তে থাকে। আর এ প্রত্যাশ্যা পূরণ করার জন্য তিনিও হয়ে উঠেন দুর্নীতিবাজ পদস্থ ব্যক্তি। এ অসম সামাজিক ও মানসিক প্রতিযোগিতার কারণে প্রতিটি অফিসে বা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে বা সর্বক্ষেত্রে চালু হয় ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও বেহায়াপনা। এ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে মিল না থাকার কারণে সমাজ ব্যবস্থা হয়ে উঠে অসুখী। এ পরিস্থিতি থেকে রেহায় পাওয়ার জন্য আয়ের অসম বন্টনকে প্রথমে নজরে আনতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কখনো শতভাগ আয়ের সমবন্টন হয় না। এ কথা সত্য। তবে এও সত্য যে, বিশ্বের বহুগণতান্ত্রিক দেশে এই অসম বন্টনকে অনেকাংশে হ্রাস করতে পেরেছে। এ অসম বন্টনকে হ্রাস করার দুইটি প্রক্রিয়া আছে। প্রথমত উচ্চ আয় সম্পূর্ণ ব্যক্তি বা দুর্নীতিবাজদের লাগাম শক্ত হাতে টেনে ধরতে হবে। তাদের ওপর অধিক হারে কর আরোপ করে সরকারকে সেই অর্জিত কর দরিদ্রদের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে ব্যাপক হারে কর্মে নিয়োজিত করে তাদের আয় বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে। ব্যাংকের ঋণ খেলাপির মাধ্যমে ধনীরা যাতে আরো ধনী হতে না পারে এবং ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই বাংলাদেশ আস্তে আস্তে অধিকতর সুখী দেশে পরিণত হতে পারবে। মানুষকে সুখী করার পেছনে রাষ্ট্রের ভূমিকা যেমন রয়েছে, তেমনি একটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিতেও থাকতে পারে সুখী হওয়ার উপাদান।
২০২৪ সালের মার্চে প্রকাশিত সুখী দেশের তালিকায় প্রথম চারটি দেশ হয় ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড ও সুইডেন। এ দেশেগুলোর মানুষ সুখী হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রকৃতির সাথে তাদের নিবিড় সান্নিধ্য, স্বাস্থ্যসম্মত কর্মজীবন, সুখ নিয়ে বেশি চিন্তা না করা, হতাশাবাদী না হওয়া, সাদামাটা জীবন যাপন করা। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ ও সামাজিক আচার ও বিধি ব্যবস্থার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক সম্পর্কের গভীরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী হয়ে পড়ছে প্রযুক্তি নির্ভর। এ প্রযুক্তি বাঙালির জনমনে আবেগ ও অনুভূতিতে প্রভাব ফেলেছে। ক্রমাগত আমরা এক মাত্রিক চিন্তাধারায় আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছি, সর্বপরি পরপর আর্থিক প্রতিযোগিতা, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান এবং যে কোন প্রকারে ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতা হ্রাস করতে পারলেই তবে সুখী বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ; পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি