বাংলাদেশে রাবার শিল্প : একটি পর্যালোচনা : ২

ড. সেলিনা আখতার | মঙ্গলবার , ১৯ নভেম্বর, ২০২৪ at ৮:৪৪ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশে সাধারণত লেটেক্সের সমপরিমাণ পানি মিশানো হয়ে থাকে। কয়েকবার নাড়াচাড়া করার পর লেটেক্সের ওপর জমাকৃত ফেনাসমূহ সরিয়ে ফেলতে হবে। দ্রবীভূত লেটেক্স জমাট বাধানোর জন্য প্রতি কেজি লেটেক্সের সাথে ১ সি: সি: হিসেবে ফরমিক এসিড মিশাতে হবে। লেটেক্সের সাথে দ্রবীভূত ফরমিক এসিড (2% W/W) এমনভাবে মেশাতে হবে যাতে পিএইচ রেঞ্জ ৪.৬ থেকে ৪.৯ এর মধ্যে থাকে) মেশানোর পর ভলভাবে নড়াচড়া করে কোয়াগুলেটিং ট্যাংক এর পার্টিশন প্লেট বসাতে হয়। লেটেক্স জমাট বেধে যওয়ার পর কোয়াগুলেটিং ট্যাংকে আবার পানি দিতে হবে। জমাট বাধা লেটেক্স ১০ ঘন্টার মধ্যে প্রসেসিংয়ের/ রোলিং উপযোগী হয়ে থাকে। জমাট বাধার জন্য এক রাত সময়ই সাধারন নিয়ম হিসেবে গন্য করা হয়ে থাকে। এরপর রোলার মেশিনের সাহায্যে ভিজা রাবার শীট থেকে পানি বের করে শীট হেংগারে ঝুলানোর (ড্রিপিং শেডে) ব্যবস্থা করতে হবে এবং শীট হেংগারে আলাদা আলাদাভাবে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। রাবার শীট ভালভাবে শুকানোর জন্য সাধারনতঃ ১৩০ ডিগ্রী ফা.- ১৫০ ডিগ্রী ফা. তাপমাত্রায় ৩৪ দিন ধুমঘরে (রাবার শিটকে শুকানোর জন্য বিশেষ ভাবে তৈরী ঘর যেখানে আগুন জালিয়ে তাপ তৈরি করা হয়) রাখতে হয়। পরবর্তীতে ধুমঘর থেকে সীট বাইরে এনে বান্ডিলকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। রাবার ৫০ কেজি ওজনের বান্ডিল করে বস্তাভর্তি করে গুদামজাত করা হয় এবং চাহিদা মতো সারাদেশে ও দেশের বাইরেও রপ্তানি করা হয়। একটি রাবার গাছ প্রায় ২৬ বছর ধরে কষ দেয় এবং উৎপাদনে অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সাধারণত ৩০ থেকে ৩৫ বছর শেষে রাবার গাছ কেটে ফেলা হয়।

রাবার শিল্পের পণ্য সামগ্রী : বাংলাদেশ রাবার চাষে নবীন হলেও এর ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, পরিবেশ সহায়ক ও আর্থসামাজিক প্রয়োজনে রাবার চাষের গুরুত্ব অপরীসিম। স্বাধীনতার পূর্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১০১৫টি রাবারভিত্তিক ছোটছোট কারখানা ছিল। স্বাধীনতাত্তোর সময়ে পর্যায়ক্রমে রাবারের উৎপাদন ও চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেসরকারি মালিকানায় বিভিন্ন সময়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের প্রায় ৪০০টির মতো রাবারভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। বর্তমানে রাবার দিয়ে বিশ্বে ১ লাখ ২০ হাজার ধরনের দ্রব্যসামগ্রী তৈরি হচ্ছে।

প্রাকৃতিক রাবারের বহুবিধ ব্যবহার বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। শিল্পকারখানা, যোগাযোগ ব্যবস্থার নির্মাণ সামগ্রী, রাস্তার কার্পেটিং, বিমান, বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, বেবি ট্যাক্সি, মোটর সাইকেল, রিক্‌শা, বাইসাইকেলের টায়ারটিউব, চপ্পল, জুতার সোল, হোস পাইপ, রাবার সোল, বাকেট, গ্যাসকেট, অয়েলসিল, পাট ও বস্ত্র শিল্পের বিভিন্ন উপকরণ, ফোম ম্যাট্রেস, ব্যাটারির বক্স, স্প্রিং, গরম পানির বোতল, সীল, কনডম, রান্নার সামগ্রী, ওয়েটস্যুট, কনভেয়র বেল্ট, প্যাড, বাম্পার, রাবার ম্যাট, পিচ্ছিলরোধী ফ্লোর ম্যাট, নৌকার ম্যাট, সার্জিক্যাল গ্লোভ, বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রী, প্যাসিফায়ার, গাম, খেলনা ইত্যাদি রাবার থেকে তৈরি হয়। শিল্পকারখানার দ্রব্যসামগ্রী, চিকিৎসাশাস্ত্রের বিভিন্ন সামগ্রীসহ গৃহস্থালি কাজের ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীও তৈরি হচ্ছে। শতকরা ৬০ শতাংশ কাঁচা রাবার দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত হয়, অবশিষ্ট শতকরা ৪০ শতাংশ রাবারভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের নিমিত্তে বিদেশে মূলত ভারত ও ভিয়েতনামে রফতানি করা হয়।

ইতোপূর্বে রাবার কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে বিএফআইডিসি রাবার শিল্প ইউনিটগুলোতে ট্রিটমেন্ট ও সিজনিং করে বিভিন্ন ধরনের উন্নতমানের আসবাবপত্র, যেমন সোফাসেট, খাট, দরজাজানালা, ডাইনিং টেবিল, চেয়ার ইত্যাদি তৈরি করে দেশে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। ট্রিটমেন্ট ও সিজনিং করা রাবার কাঠের গুণগতমান সেগুনকাঠের সমপর্যায়ের যা অতিশয় টেকসই ও সুন্দর। রাবার গাছের গড় আয়ু ৩২৩৪ বছর। প্রতিটি গাছ হতে ৫৮ ঘনফুট কাঠ পাওয়া যায়। আগে রাবার গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে বিএফআইডিসি রাবার গাছগুলো বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত মানের আসবাবপত্র যেমন, দরজাজানালা তৈরি করে যা উন্নত গুণগতমানের ও টেকসই।

রাবার শিল্পে সমস্যা ও চ্যালেঞ্জসমূহ: এককালে সাদা সোনাহিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো রাবার শিল্পকে। দেশে প্রতি বছর ৬৭ হাজার মেট্রিক টন প্রাকৃতিক রাবার উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২০২১ অর্থবছরে দেড় কোটি ডলারের রাবার রপ্তানি হয়েছে। ১ লাখ ২০ হাজার পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে রাবারের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ কড়া চাহিদা থাকলেও সম্ভাবনার এ সেক্টরের প্রতি মনোযোগ পর্যাপ্ত নয়। শিল্পটির যুগোপযোগী বিকাশে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা সংস্থা রাবার বোর্ডকে নখদন্তহীন বাঘের মতো করে রাখা হয়েছে বলে মনে করা হয়। বিংশ মতাব্দীর অষ্টম দশকে সরকারি তরফে রাবার উৎপাদনে ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করা হয়। আমাদের দেশের রাবার শিল্পে বিরাজ করছে অনেক সমস্যা। সরকারি ১৮টি বাগানসহ বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ রাবার উৎপাদন হয় তা দিয়ে দেশের চাহিদার ৬০ ভাগ মেটানো সম্ভব হলেও প্রতি বছর প্রয়োজনের তুলনায় বেশি রাবার বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। বিদেশি রাবারে বাজার সয়লাব হয়ে থাকায় দেশি রাবারের বাজারচাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে না। দেশি রাবার অবিক্রিত থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাবার চাষ করে রাবার চাষিরা ন্যায্য মূল্য পায় না। অপ্রতুল জনবল, অংশীজনদের অসহযোগিতা, আমদানিকৃত পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক সিন্থেটিক রাবারকে উৎসাহিতকরণ ও জাতীয় পর্যায়ের গবেষণা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে ডুবছে দেশীয় অর্থনীতির সম্ভাবনার খাত রাবার ও রাবার জাতীয় পণ্যের শিল্প।

২০২০২১ অর্থবছরে দেড় কোটি ডলারের রাবার রপ্তানি হয়েছে। তারমধ্যে বেশ কয়েকটি শিল্পগ্রুপ দেশেই রাবার বাগান করে নিজেদের চাহিদা মিটাচ্ছে। জানা যায় রাবার শিল্পে বাংলাদেশের যা সক্ষমতা রয়েছে, তা দিয়ে দেশের শতভাগ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। ২০১০১১ সন হতে রাবার বিক্রির উপর ১৫% ভ্যাট এবং টেন্ডারে বিক্রির ক্ষেত্রে আয়কর ও সেবা খাতে আরও ৯% সহ মোট ২৪% কর আরোপ করায় এবং বিদেশ থেকে রাবার আমদানীর ক্ষেত্রে আমদানী শুল্ক ১৫% থেকে ৫% এ কমিয়ে আনার ফলে দেশে উৎপাদিত রাবার বিক্রি হ্রাস পেয়েছে। এ নিয়ে রাবার বাগান মালিকদের মতামত হলো নিলাম থেকে রাবার নিয়ে রপ্তানি করতে গেলে ২৪ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। আবার আমদানি করলে মাত্র ৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এখানেই রাবার শিল্পের সম্ভবনাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

বিএফআইডিসির অধিকাংশ কারখানা ও এর যন্ত্রপাতি অনেক পুরাতন হওয়ায়, দুর্বল ও অপ্রতুল অবকাঠামো এবং দক্ষ জনবলের অভাব থাকায় রাবারের গুণগত মানের সীমাবদ্ধতা থেকে যাচ্ছে। উচ্চ ফলনশীল জাতের রাবার ক্লোনের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে উন্নতমানের রাবার বাগান সৃজন সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া রাবার উৎপাদন ও ব্যবহার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যউপাত্তের অভাব; প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র রাবার চাষিদের সহায়তার জন্য প্রণোদনার এবং নিরাপত্তার অভাব; প্রাকৃতিক কারণে যেমনহাতির আক্রমণ, বনে আকস্মিক আগুন প্রভৃতিতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া; ও উচ্চফলনশীল রাবার প্রজাতি না থাকায় রাবার উৎপাদনকারী দেশসমূহের তুলনায় পিছিয়ে থাকা। এছাড়া বাংলাদেশ রাবার বোর্ড নিজেই অনেক সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে রয়েছে: অপর্যাপ্ত জনবল; নিজস্বভবন/ অবকাঠামো বা জমি না থাকা; বাংলাদেশ রাবার উৎপাদন ও ব্যবহার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্তের অভাব; দৈনন্দিন কার্যক্রম ও গবেষণর জন্য প্রয়োজনীয় স্থানের অপ্রতুলতা; মানব সম্পদ উন্নয়নের সুযোগের অভাব; আধুনিক উপকরণ ও গবেষণাগারের অভাব; প্রান্তিক ও ক্ষুদ্রচাষিদের সহায়তার জন্য প্রণোদনার অভাব; ও আমদানিকৃত রাবারের আমদানি শুল্ক কম হওয়া।

রাবার শিল্পের উন্নয়নের জন্য করণীয়: আমাদের দেশের রাবারশিল্প ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে রাবারশিল্প ইতোমধ্যে বিশেষ অবদান রাখতে শুরু করেছে। দেশে উৎপাদিত রাবার দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। আমাদের দেশে রাবার শিল্পে বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যাগুলো সমাধান করা অতীব প্রয়োজন। তা না হলে এ শিল্পটি ধীরে ধীরে অধো:গতির দিকে। অবিলম্বে রাবার উৎপাদনকারী বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো রাবারকে কৃষিপণ্য ঘোষণা করা দরকার। দেশের উৎপাদিত রাবার বিক্রির ক্ষেত্রে ১৫% মূল্য সংযোজন কর (মূসক), % আয়কর এবং ৪% সেবা চার্জ অরোপ করায় দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত রাবার বিক্রি আশংকাজনক হারে হ্‌্রাস পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ রাবার আমদানির ক্ষেত্রে মাত্র ৫% শুল্ক ধার্য থাকায় বেসরকারি পর্যায়ে রাবার ব্যবহারকারীগণ দেশীয় রাবার আন্তর্জাতিক মানের হওয়া সত্তেও তা ক্রয় না করে আমদানিকৃত রারার ব্যবহারে উৎসাহী হচ্ছেন। এর ফলে দেশীয় রাবার চাষীরা ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছে। রাবারকে ১০০% কৃষ পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হলে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষিত বর্তমান প্রযোজ্য আয়কর আমদানি ও রপ্তানি, বিনিয়োগ ও ঋণ সুবিধা লাভ করবে। প্রাকৃতিক রাবারের চাষ একটি বিকাশমান শ্রমঘন কৃষি পণ্য হিসেবে দেশের প্রত্যন্ত পাহাড়ী অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের আর্থসাাজিক অবস্থা ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রাখছে। এহেন বিকাশমান শ্রমঘন রাবার চাষের বিকাশে সরকা রের কাছ থেকে যথোপযুক্ত সহযোগিতা পাওয়া গেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রকৃতিক রাবার রপ্তানি করে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রাবার চাষ, উৎপাদন, ব্যবহার, আমদানি ও রফতানির প্রকৃত তথ্য সম্বলিত কোন ডাটাবেজ নেই। বাংলাদেশ রাবার বোর্ড বাংলা দেশের প্রাকৃতিক রাবার সম্পর্কিত সকল তথ্য সম্বলিত একটি ডাটাবেজ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ লক্ষে ইতোমধ্যে বান্দরবান জেলার ফাসিয়াখালী মৌজায় ডাটাবেজ তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অন্যান্য জেলার রাবার বাগানগুলো চিহ্নিত করার লক্ষ্যে ডাটাবেইজ তৈরির কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে রাবার সম্পর্কিত দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ANRPC ও IRRDB এর সদস্যপদ গ্রহণ করেছে। এর ফলে উক্ত সংস্থা দুটির সদস্য দেশসমূহের সাথে বাংলাদেশের সহযোগিতা ও সমন্বয়ের পথ প্রসারিত হবে। ফলে আন্তর্জাতিক মানের রাবার নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বাংলাদেশের প্রকৃতির জন্য উপযুক্ত উচ্চ ফলনশীল রাবারের জাত অনুসন্ধান, সংগ্রহ ও চাষের মাধ্যমে দেশে প্রাকৃতিক রাবারের মোট উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে। বাংলাদেশ রাবার বোর্ড প্রাকৃতিক রাবারের উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য উন্নত জাতের রাবার ক্লোন সরবরাহ, ট্যাপিং প্রশিক্ষণ, মধু চাষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক রাবার উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।

রাবার গাছ হতে ল্যাটেক্স (রাবারের কষ) সংগ্রহ করা এবং ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাওয়াটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ল্যাটেক্স সংগ্রহ করার জন্য গাছ ট্যাপিং করা হয় সূর্য উঠার আগে। এর ৩৪ ঘণ্টা পর ল্যাটেক্স সংরহ করা হয়। ট্যাপাররা ব্লক অনুসারে সব গাছ কেটেছে কিনা তা তদারকি করা কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ। আর এই সুযোগে ল্যাটেক্স চুরিও হয়ে যায়। বাগানে ল্যাটেক্স এবং শীট চুরি রোধ করার জন্য মনিটরিং জোরদার করতে হবে।

রাবার বাগান মালিকরা রাবার উৎপাদনে আগ্রহী হওয়ার জন্য বাংলাদেশ রাবার বোর্ড রাবার চাষীদের স্বার্থ সংরক্ষণ, উৎপাদিত রাবারের মান উন্নয়ন, বিপণন, ভবিষ্যতে রফতানির সুযোগ সৃষ্টি করা এবং রাবারের আন্তর্জাতিক মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশীয় রাবারের বাজার মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা; রাবার বাগান মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা দরকার।

এক জরিপে দেখা গেছে, বেসরকারি বাগানগুলোতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে সফল বাগান সৃষ্টি ও উন্নত মানের কাঁচা রাবার উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই সফল রাবার বাগান সৃষ্টি ও রাবারগাছ থেকে লেটেক্স (রাবারের কষ) আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের নিমিত্তে ও সব বাগানে সব কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের রাবারের ওপর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন তথা দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকা একান্ত আবশ্যক। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের অধীন স্থগিত কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রটি রাবারের ওপর অভিজ্ঞ, দক্ষ প্রশিক্ষক দ্বারা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করে সারা দেশে রাবার বাগানগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে এ শিল্পের প্রভূত উন্নতি সাধন করা যেতে পারে। রাবার চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক, কর্মচারী, কর্মকর্তা ও মালিকদেরকে দেশে এবং বিদেশে (যেমন: মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত) প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

রাবার শিল্পের উন্নয়নে রাবার গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করা প্রয়োজন। বর্তমানে প্রতি বাগানে ২৫ একর জায়গায় রাবার চাষ করা হচ্ছে। সেখানে এর পরিধি বৃদ্ধি করে ১০০ একর করতে হবে। তাছাড়া আমাদের দেশের যেসব স্থানে এখনো পর্যন্ত রাবার চাষ করা হয়নি সেসব স্থানে রাবার বাগান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে।

রাবারের বহুমুখী ব্যবহার যেমনরাস্তা নির্মাণে বিটুমিনের সঙ্গে রাবারের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করাসহ অন্যান্য ব্যবহার নিশ্চিতকরণ; রাবার বাগান এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুতের ব্যবস্থা এবং বাগান এলাকায় আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা; ভূমিদস্যু কর্তৃক রাবার বাগান দখলের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। রাবার বাগান এলাকার সব বাগানে সরকারি খরচে টিউবওয়েল স্থাপন করতে হবে। রাবার চাষিদেরকে স্বল্পমূল্যে সার বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশে উৎপাদিত রাবার রফতানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা ও জটিলতা দূর করাসহ বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিদেশ থেকে রাবার আমদানির ওপর ৫০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করাসহ রাবার আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের অনুমোদন গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা দরকার। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো শূন্য শতাংশ থেকে তিন শতাংশ হারে সুদে দীর্ঘমেয়াদি রাবার ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে। শ্রীলঙ্কা, ভারত এবং থাইল্যান্ডে রাবার চাষে বিশেষ ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সেসব দেশের মতো আমাদের এখানেও রাবার চাষে বিশেষ ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ভর্তুকির ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। কারণ একটি রাবার গাছ পরিবেশ থেকে বছরে প্রায় ১৪৪ দশমিক ৫ কেজি কার্বনডাইঅক্সাইড শোষণ করে থাকে। ফলে পরিবেশবান্ধব উপকারী এই রাবার চাষে বিশেষ ভর্তুকি সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। (চলবে)

লেখক: শিক্ষাবিদ; সাবেক সভাপতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি,

সাবেক উপাচার্য, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিবাহ বিচ্ছেদের মতো চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে হাজারবার চিন্তা করা উচিত
পরবর্তী নিবন্ধঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির মাঠ মহড়া