আমাদের প্রাণের বাংলাদেশে নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে বাংলা বিদ্বেষ নিয়ে। নগরের ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যায়তনের শিক্ষার্থীরা প্রকাশ্যেই বলে- ‘আই হেইট বাংলা’। অন্য নামি বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের মুখেও শোনা যায় এমন কথা। আমরা অভিভাবকরা তাতে কিছু মনে করি না, বিব্রত হই না, কষ্টতো পাই-ইনা, বরং কেউ কেউ কিঞ্চিৎ গর্ববোধ করি। শুধু কী তাই! বাংলা থেকে নিষ্কৃতি চায় আমাদের ছেলেমেয়েরা, ক্ষেত্রবিশেষে বাবা-মায়েরাও। কারণ, বিষয় হিসেবে বাংলা মোটেই অর্থকরী নয়। উচ্চ নম্বর তোলা দুরূহ। পরিণামে সোনালি ‘এ-প্লাস’ হাতছাড়া হয়ে যাবার বিপদ সংকেত।
বাংলার প্রতি অনিহা, ঘৃণা নিয়ে বড় হওয়া আমাদের সন্তানরা বড় হয়ে বাংলা বাঁচাবে, বাংলার হাল ধরবে এমন স্বপ্নে গুঁড়েবালি। অবশ্য বাংলা বাঁচাতে ওদের বয়েই গেছে। এখানে থাকলে তো। বিদেশের মাটিতে এক পা দিয়েই আছে ওরা। বাবা মা’ও ওদের তাই-ই চান। দিন গুনছেন। দশম বড়জোর দ্বাদশ শ্রেণি পার করলেই পাঠিয়ে দেবেন উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, কিংবা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের কোন শহরে। অথবা মালয়েশিয়া, হংকং, জাপান, সিঙ্গাপুর, চীন। নিদেনপক্ষে ভারতে। ওদেরই বা দোষ কি! কিসের ভরসায় পড়ে থাকবে এই বঙ্গভূমিতে যেখানে মৃত্যু ঘোরে পায়ে পায়ে। উন্নত ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ রচনার আশায় উন্নত বিশ্বে পাড়ি জমানোতে তাই কোন অপরাধ হতে পারে না।
কিন্তু তাই বলে বাংলাকে ঘৃণা করতে হবে! কতনা দাম দিয়ে কেনা এই বাংলা! ‘কারও দানে পাওয়া নয়’। ভাষার অধিকার, ভূখণ্ড, মানচিত্র, পতাকা, আত্মপরিচয় সব এসেছে একে একে বাংলারই হাত ধরে। আমাদের ছেলেমেয়েদের এসব জানতে হবে না? জীবন যাপন ও কাজের প্রয়োজনে যেখানে খুশি যাক না ওরা, তাই বলে বাংলার প্রতি মমতা থাকবে না? বাংলাকে ঘৃণা করবে আ-কার, ই-কার, দুই ন, ড়, আর তিন শ নিয়ে বিভ্রান্তি- এসব কারণে!
আমাদের সন্তানরা বাংলা গান শোনে না, বাংলা ছায়াছবি দেখে না। ওদেরকে দেখানোর মতো, ওদের মনে জয় করার মতো বাংলা চলচ্চিত্র আজকাল তৈরিও হয় না। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য কত যে সমৃদ্ধ ওরা জানে না, জানতে চায়ও না। আর জানাবেইবা কে? আমাদেরইবা সময় কোথায়? ইচ্ছেও কী আছে? কী বিচিত্র অবহেলায় আমাদের প্রাণের বাংলা ডুবে যাচ্ছে অতল গহ্বরে!
শুধু কী বাংলা ভাষা? বাংলা চালচলন, রীতিনীতিও হারিয়ে যেতে শুরু করেছে আমাদের সমাজজীবনে থেকে। আমার মেয়ের চোখে আমি আধুনিক মা নই; ‘স্মার্ট’ হওয়ার তো কোন সুযোগই নেই, নেই কোন যোগ্যতাও। কারণ অন্য অনেক মায়েদের সন্তানদের মতো মেয়ে আমার হিন্দি ভাষাটাকে মাতৃভাষার মতো রপ্ত করতে পারেনি। এজন্য বন্ধুদের মাঝে কুঁকড়ে থাকে হীনমন্যতায়। আমার অযোগ্যতার শেষ নেই; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় নই, সাজসজ্জা তথা সৌন্দর্যচর্চা নিয়ে কোন জ্ঞান রাখি না, চৌদ্দ বছরের কন্যার হাতে নিজস্ব মুঠোফোন তুলে দেইনা, সহপাঠীদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় গিয়ে ‘পার্টি’ করতে দেইনা, যখন তখন ‘শপিং’ এ নিয়ে যাইনা মেয়েকে (‘পার্টি’ ও ‘শপিং’ শব্দ দুটির যুতসই বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাইনি; ইংরেজি শব্দ ধার করে স্বস্তি পাচ্ছি না), মেয়েকে ছেঁড়া জিন্স কিনে দেই না, চুলে রঙ করতে দেই না- কোন বিকৃত আচরণ করতে উৎসাহ দেই না। অন্য অনেক আধুনিক পরিবারের মতো সপ্তাহান্তে সপরিবারে রেস্তোরাঁয় গিয়ে চীনা, থাই, ইতালীয়, ফরাসী, আরবী, কিংবা ভারতীয় খাবার খাওয়াও হয় না। বন্ধুমহলে মেয়ের মান থাকে না। এ দুঃখ আমার একার নয়; সহকর্মী শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবীসহ নানান পেশায় নিয়োজিত মায়েরা উঠতি বয়সী সন্তানদের চোখে সেকেলে রয়ে যায় কেবল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না বলে। ছেলেমেয়েদেরই বা দোষ দেই কোন মুখে? আমরা বাবা মায়েরাইতো সন্তানদের কাছে কেবল পরীক্ষায় ভাল নম্বর আশা করি। কী হয় বাংলা একটু কম জানলে! বাংলা আদব কেতা ভুলে গেলেইবা কী এমন ক্ষতি! যেসব বাবা-মায়েরা চলতি হাওয়ায় গা ভাসাতে পারেন না, তাঁরা আতংক নিয়ে দেখছেন সন্তানদের পারিবারিক বা সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার পথ ক্রমাগত বন্ধ হয়ে আসছে। কারণ প্রচার মাধ্যম ডেকে চলেছে ওদের হাতছানি দিয়ে; ঝলমলে অথচ অন্ধকার পথে। পথ হারাতে আর বাধা কোথায়?
নামিদামি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় এগিয়ে আছে ফলাফলের সূচকে কোন সন্দেহ নেই, তবে ভাষার অপব্যবহারেও পিছিয়ে নেই সমাজের নিচুতলার মানুষদের সঙ্গে। বস্তির শিশুরা খিস্তিখেউর আওড়ালে আমরা নাক কুঁচকাই, বিরক্ত হই; এরা সমাজটাকে দূষিত করে ফেলছে; সভ্যতা ভব্যতার ধার ধারে না। অথচ একই রকম গালাগাল উঁচু তলার ছেলেমেয়েরা আজকাল উচ্চারণ করে ফেলে অনায়াসে, যেখানে সেখানে এমনকি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। খাঁটি বাংলায় দেশীয় ভঙ্গিতে না বলে অনেকে ইংরেজিতে গালি দেয়। আবার, অনেক শিক্ষকই শিক্ষার্থীরা তাঁকে অন্ধের মতো অনুসরণ করছে জেনেও ইংরেজি ‘স্ল্যাং’ ব্যবহার করে ফেলেন কথার ফাঁকে।
এসব আচরণই কিন্তু আজকাল আভিজাত্য ও আধুনিকতার পরিচয় বহন করে আমাদের সমাজে। সাধারণ আটপৌরে বাংলা চালে চলতে আমরা আর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। তাই বাঙালিয়ানা হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের নাগরিক জীবন থেকে। খাবারে, পোশাকে, কথায়, আচার-আচরণে, আনন্দ-বিনোদনে, এমনকি সামজিক ও ধর্মীয় উৎসব আয়োজনে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কী নিদারুণ ভাবেইনা উপেক্ষিত হচ্ছে! আর তাই একুশে ফেব্রুয়ারিও পরিণত হয়েছে নিছক উৎসবে যেখানে সাজসজ্জা ও আনন্দউল্লাসের কমতি থাকেনা। উৎসবের উন্মাদনায় শোকের চিহ্ন হারিয়ে যায় নাগরিক জীবন হতে।
বাংলার দুর্ভোগ ও সাংস্কৃতিক দুর্যোগ দেখে দেখে বাংলাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ও আশার বেলুনটা চুপসে যেতে থাকে। আবার সেখানে আশা ও স্বপ্নের বাতাস ভরে দিতে হবে। একুশ শতকের দু’দশক পাড়ি দিয়ে ফেলেছি আমরা। শিক্ষার সূচকে আমাদের দেশ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের তুলনায় এগিয়ে। এই এগিয়ে থাকার অর্থ যদি হয় শেকড়ের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তবে সবই অন্তঃসারশূন্য।
পৃথিবীর ইতিহাস ও অগ্রগতির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির আশীর্বাদে ভরা এই কালে সংস্কৃতির জয়গান গেয়ে হাজার বছরের সভ্যতা এগিয়ে চলেছে নারীজাতির হাত ধরে। আমরা বাঙালি মায়েরা যত আধুনিকই হইনা কেন, নওয়াব ফয়জুন্নেসা, কুসুমকুমারী দাশ, বেগম রোকেয়া, প্রীতিলতা, লীলা নাগ, সুফিয়া কামাল, ফেরদৌস আরা আলীমদের দেখিয়ে দেওয়া পথে যদি হাঁটতে পারি, তবেই আমাদের প্রাণের বাংলা গৌরবের সঙ্গে বেঁচে থাকবে পৃথিবীর বুকে। আর আমাদের সন্তানরা এবং তাদের উত্তরসূরিরা শেকড়ছাড়া পরজীবী জাতিতে পরিণত হবেনা। কেবল মুখের ভাষাতো নয়; বাংলা ভালোবাসা, বাংলা আমাদের পরিচয়। ঐতিহ্য ও মর্যাদা সবই এসেছে বাংলার হাত ধরে। আমাদের প্রাণের বাংলাকে বাঁচাতে হবে।