কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মাণাধীন বহুল প্রত্যাশার বঙ্গবন্ধু টানেল যান চলাচলের জন্য অচিরেই খুলে দেয়া হচ্ছে। ডিসেম্বরের মধ্যে টানেল চালুর কথা থাকলেও আরো আগে যান চলাচল শুরু করার জন্য নিরলস চেষ্টা চলছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ বিস্তৃত এলাকার জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, যান চলাচলে গতিশীলতা, শিল্পায়ন এবং পর্যটনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত উন্নয়নের জন্য দশ হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম টানেলটি চালু করা নিয়ে রাতে দিনে কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক ১০টি মেগাপ্রকল্পের একটি হিসেবে বঙ্গবন্ধু টানেল দেশের সার্বিক অর্থনীতি এবং প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, চীনের সাংহাই শহরের আদলে চট্টগ্রামকেও ওয়ান সিটি টু টাউন হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বহুদিন ধরে চেষ্টা চলছিল। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ের বিস্তৃত জনপদকে শহরের মূল স্রোতে নিয়ে আসার জন্য কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু নির্মাণ করা হয়। কিন্তু তাতে লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ায় ২০০৮ সাল থেকে নদীর তলদেশে একটি টানেল নির্মাণের প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হয় সরকার। বিভিন্ন সময় টানেল নির্মাণের ব্যাপারে বহু কথাবার্তা হলেও মূলত কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। ওই সময় সরকার চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) এবং হংকংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অভি অরূপ এন্ড পার্টনারস হংকং লিমিটেডকে দিয়ে টানেলের ব্যাপারে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করায়। উক্ত সমীক্ষা রিপোর্টে টানেল নির্মাণ অর্থনৈতিকভাবে খুবই সফল একটি প্রকল্প হবে বলে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয় যে টানেলটি দিয়ে প্রথম বছরেই ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে। বছর কয়েকের মধ্যে গাড়ি চলাচলের পরিমাণ ১ কোটি ৪০ লাখে গিয়ে ঠেকবে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়ার পাশাপাশি দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে এই টানেল বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। আর ওই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয় টানেল নির্মাণ প্রকল্প।
একনেকের অনুমোদনসহ নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ’ প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ মেগাপ্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তবে পুরোদমে কাজ শুরুর জন্য আরো প্রায় এক বছর অপেক্ষা করতে হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। পরবর্তীতে ব্যয় বাড়িয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই ব্যয় ইতোমধ্যে আরো অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে নির্মাণ সামগ্রির মূল্যবৃদ্ধি এবং করোনাকালের ধাক্কায় প্রকল্পের খরচ বেশ বৃদ্ধি পায় বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। চীন সরকারের সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। চীনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসিএল) টানেলটি নির্মাণ করছে। নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণকে অত্যন্ত কঠিন এবং এদেশে নতুন প্রযুক্তি বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রকৃতপক্ষে এটি একটি ব্রিজ বা রাস্তা বানানোর মতো কাজ নয়। অনেক কঠিন একটি কাজ। নদীর বহু গভীরে গিয়ে টানেল বোরিং করা হচ্ছে। বোরিং এর পর চীন থেকে আনা সেগম্যান্ট স্থাপন করে টিউব তৈরি করা হচ্ছে। টানেলে সর্বমোট ১৯ হাজার ৬১৬টি সেগমেন্ট বসানো হয়েছে। এর প্রত্যেকটি জাহাজে বোঝাই করে চীন থেকে আনা হয়েছে। এরমধ্যে কিছু সেগম্যান্ট নষ্ট হয়েছিল। সেগুলোও চীন থেকে পুনঃনির্মাণ করে আনা হয়। কঠিন এবং বিশাল এক কর্মযজ্ঞ মোটামুটি একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
চার লেইনের ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল টানেলের সাথে উভয় প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং ৭২৭ মিটার লম্বা একটি ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর ১৮ থেকে ৩১ মিটার (৬০ ফুট থেকে ১০২ ফুট) গভীরে টানেলের দুইটি টিউব স্থাপন করা হয়েছে। একটি টিউব ১০ দশমিক ৮ মিটার বা ৩৫ ফুট চওড়া এবং উচ্চতায় হবে ৪ দশমিক ৮ মিটার বা প্রায় ১৬ ফুট। এর একটি টিউব দিয়ে দুই লেনে গাড়ি যাবে, অপরটি দিয়ে দুই লেনে গাড়ি আসবে। নগর প্রান্তে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমির পাশ থেকে টানেল কর্ণফুলীর তলদেশে প্রবেশ করবে। নদীর অপর পাড়ে কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) এবং চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) মাঝখানে দিয়ে টানেল আনোয়ারার সাথে যুক্ত হয়েছে।
বহুল প্রত্যাশার প্রকল্পটির কাজ ৯০ শতাংশেরও বেশি শেষ হয়েছে বলে উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের আড়াইশ’রও বেশি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ছাড়াও এক হাজারের মতো শ্রমিক টানেল নির্মাণে নিরলসভাবে কাজ করছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে টানেল চালু করে দেয়ার জন্য আমরা নিরলসভাবে কাজ করছি। এই ব্যাপারে সরকারেরও নির্দেশনা রয়েছে। আমরা আমাদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন করতে পারবো ইনশা আল্লাহ’। তবে অপর একজন কর্মকর্তা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই প্রকল্পটি চালু করে দেয়ার চেষ্টা চলছে বলেও উল্লেখ করেন।
টানেল নির্মাণের পর চট্টগ্রামে ওয়ান সিটি টু টাউন মডেল বাস্তবায়ন অনেক সহজ হয়ে উঠবে বলে উল্লেখ করে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেছেন, ‘এতে শুধু দক্ষিণ চট্টগ্রামের আবাসন শিল্পায়ন এবং পর্যটনেই বড় ভূমিকা রাখবে না, সার্বিক জীবনযাত্রা এবং অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দেবে। চট্টগ্রামের মীরসরাই এবং আনোয়ারা ইকোনমিক জোনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই টানেল অভাবনীয় বিপ্লবের সৃষ্টি করবে।
তিনি বলেন, চীনের সাংহাই নগরীর আদলে চট্টগ্রামকে ‘ওয়ান সিটি টু টাউনে’র আদলে গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে চট্টগ্রাম শহর এবং নদীর অপরপাড়ের আনোয়ারা নতুন শহর হিসেবে গড়ে উঠবে। টানেলের একপ্রান্তে আনোয়ারায় ভারী শিল্প এলাকা এবং অন্য প্রান্তের চট্টগ্রাম নগরী, বিমান ও সমুদ্রবন্দর। কর্ণফুলী নদী দিয়ে বিভক্ত দুই প্রান্তকে যুক্ত করার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতেও বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। যা দেশের প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী