বঙ্গবন্ধু : অসমাপ্ত জীবনের এক মহানায়ক

জসীম চৌধুরী সবুজ | বুধবার , ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৯:২৩ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়। ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি নতুন রাষ্ট্র গঠিত হল। শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলনের একজন একনিষ্ট সংগঠক। কিন্তু বাংলা ভাগকে তিনি মেনে নিতে পারেন নি। কলকাতা হবে আমাদের রাজধানী মুসলিম লীগ নেতাদের মত এমন স্বপ্ন মুজিবও দেখতেন। এখানে ষড়যন্ত্রের আভাষ তিনি পেয়েছেন। কংগ্রেসতো পাকিস্তান দাবির সাথেই একমত ছিল না। বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ হবে তাই তারা রাজী হয়। বাংলার কলকাতা ও আশেপাশের জেলাগুলোও ভারতেই থাকছে। আসামের সিলেট ছাড়া কিছুই পাকিস্তানে আসছে না। কলকাতা কেন আমরা পাব না? শেখ মুজিবও সভা সমাবেশ করে জনমত গঠনে অংশ নিলেন- বাংলাদেশ ভাগ হতে দেব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রুখতে পারলেন না। তাই ক্ষোভের সাথে তিনি বলেন, ” আমরা কর্মীরা কি জানতাম যে, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ মেনে নিয়েছে এই ভাগের ফর্মুলা? দিল্লী বসে যে অনেক পূর্বেই কলকাতাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে একথা তো আমরা জানতামও না, আর বুঝতামও না।”
বইটিতে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিহার ও কলকাতার হিন্দু- মুসলিম দাঙ্গার মর্মস্পর্শী বিবরণ আমরা পাই। দেশ ভাগের পর ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার রাজনীতির চিত্র উঠে আসে। যে পাকিস্তানের জন্য এত আন্দোলন সংগ্রাম করলেন সেই পাকিস্তান যে আমাদের জন্য নয় তা তখনই উপলব্ধি করেছেন তরুন নেতা শেখ মুজিব। তাই পাকিস্তানী শাসকদের রোষানলে ছিলেন তিনি। অধিকাংশ সময় তাকে জেলে কাটাতে হয়েছে। মা- বাবা, স্ত্রী -সন্তানদের থেকে তাঁকে দূরে থাকতে হয়েছে। মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন, তারপর আওয়ামী লীগ গঠন সবখানেই অপরিহার্য ভূমিকায় আমরা দেখতে পাই শেখ মুজিবকে।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভ, মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিবের যোগদান, কয়েকদিনের মধ্যে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয় শাসন জারির বর্ণনা যখন আমরা পাই শেখ মুজিবের জবানিতে তখনই আমরা বুঝে যাই আমরা কোনদিকে এগুচ্ছি। স্বাধীকার ছাড়া আমাদের পথ নাই। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের বীজ তো তখন থেকেই অংকুরিত হয়ে ৬ দফার মাধ্যমে মহীরুহে রূপান্তরিত হয়। শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতায়। শেখ সাহেব থেকে তিনি হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৫৪ সালের মে মাসে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুলভাব জয়লাভ করে একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্টের শরীক। মন্ত্রিসভা গঠন করা হলে শেখ মুজিবুর রহমান কেবিনেট মন্ত্রী হিসেবে স্থান পেলেন। তাঁকে দেওয়া হল কো-অপারেটিভ ও এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট দফতর। মুজিবের বয়স তখন মাত্র ৩৩। মন্ত্রিসভায় কনিষ্ঠ সদস্য। শপথ নিয়ে মুজিব মিন্টো রোডে সরকারি বাসায় পরিবার নিয়ে উঠলেন। যুক্তফ্রন্টের বিজয় পাকিস্তানি শাসকরা ভালভাবে মেনে নিতে পারেন নি। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্য মন্ত্রিসভা বাতিল করে জারি করা হয় কেন্দ্রীয় শাসন। করাচী তখন পাকিস্তানের রাজধানী। শপথ নেওয়ার দিনই আদমজী জুট মিলে দাঙ্গা। এরজন্য যুক্তফ্রন্টের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা চলছে। হক সাহেবকে ডাকা হয় করাচীতে। তিনি মুজিবসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়েই পান ষড়যন্ত্রের আভাষ। গ্রেফতারের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় ফিরলেন। শেখ মুজিব এ প্রসঙ্গে লিখেন, “বাসায় এসে দেখলাম, রেনু এখনও ভাল করে সংসার পাততে পারে নাই। তাকে বললাম, ” আর বোধহয় দরকার হবে না। কারন মন্ত্রীত্ব ভেঙে দিবে, আর আমাকেও গ্রেফতার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধহয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা, ঢাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ হবে, তা বোধহয় হল না। নিজের হাতের টাকা পয়সাগুলোও খরচ করে ফেলেছ।” রেনু ভাবতে লাগল, আমি গোসল করে ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম করছিলাম। বেলা তিনটায় ফোন এল, কেন্দ্রীয় সরকার ৯২(ক) ধারা জারি করেছে। মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করা হয়েছে।”
ওইদিন রাতেই শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার বিবরণ দিয়ে বলছেন,” রেনু আমার সকল কিছু ঠিক করে দিল এবং কাঁদতে লাগল। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদের ওঠাতে নিষেধ করলাম। রেনুকে বললাম, ‘তোমাকে কি বলে যাব, যা ভাল বোঝ কর, তবে ঢাকায় থাকলে কষ্ট হবে, তার চেয়ে বাড়ি চলে যাও।’
৪.
বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করতে গিয়ে যে সীমাহীন কষ্ট, দুর্ভোগ, দুর্দশা সহ্য করেছেন তা কি এই জমানায় কল্পনা করা যায়।
এখনতো দলে কোন কর্মী নেই। সবাই নেতা। রঙ্গীন ব্যানার ফেস্টুন টাঙ্গিয়ে তারা নিজেদের জাহির করে, শক্তি ও ক্ষমতার প্রচার চালায়। জনগণের সাথে তাদের সম্পর্ক নেই। জনগণের কথা ভাবার সময় তারা পায় না। নিজেদের নিয়েই তারা ব্যস্ত। দলের নাম ভাঙিয়ে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার এক অশুভ প্রতিযোগিতায় উন্মত্ত সবাই। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জমি দখল, বালুমহাল দখল যেন তাদের রায়তী স্বত্ব। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এখন দেশের রাষ্ট্রক্ষমতার হাল শক্ত হাতে ধরেছেন। এখন কোন দাতা দেশ বা সংস্থার চোখ রাঙানিকে বাংলাদেশ ভয় পায় না। নিজস্ব অর্থে প্রমত্তা পদ্মার বুকে দীর্ঘতম সেতু নির্মাণ করে শেখ হাসিনা দেখিয়ে দিয়েছেন আমরাও পারি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ যখন তিনি শুরু করলেন অনেকে তখন ভীত ছিলেন। এ কাজ এখন করার কি দরকার এমন মন্তব্যও অনেকে করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যার দৃঢ় পদক্ষেপে এই দেশের পবিত্র মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, তাদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার কাজও অনেক পরাশক্তির চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে তিনি শেষ করেছেন। খুনিদের ফাঁসির দণ্ডও কার্যকর হয়েছে। সার্বিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা এখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
এসব কিছুর মাঝেও কিছু অস্বস্তির কথা না বললেই নয়। একসময় প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল এমন লোকজন ঢুকে পড়েছে আওয়ামী লীগে। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছে এমন লোকজন এখন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে ভাতাসহ নানা সুবিধা ভোগ করছে। জামায়াত শিবির করা লোকজন এসে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা বনে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু জুলিও কুরি পদক পাওয়ার পর যারা স্লোগান দিয়েছিল ‘মুজিবের গলায় জুলিও কুরি, আমরা সবাই ভাতে মরি’ তারা এখন বঙ্গবন্ধুর নামে গলা ফাটায়। মুজিব কোট তাদের গা থেকে এখন নামে না। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সময়ে যারা গণবাহিনী গঠন করে পাটের গুদামে আগুন, থানা লুট, এমপি খুন, ভারতীয় দূতাবাসে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছিল- যাদের পেছনে যুদ্ধাপরাধী ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতাকর্মীরা ভিড় জমিয়েছিল- যাদের কারণে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুকে বুলেটের নির্মম শিকার হতে হয়েছিল তারাই দেখি এখন বঙ্গবন্ধুর নামে মায়া কান্না করে। ভয়টা কাজ করে এখানেই। আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ভিড়ে এখন রাস্তা ঘাটে চলাচল করা দায়। এদের অধিকাংশই সুবিধাভোগী। সুসময়ে ভিড় জমিয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় ‘কাউয়া’। এই কাউয়ারা দুঃসময়ে ভোল পাল্টাতে এতটুকু সময় নেবে না। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, এদের অনেকের হাতে ও ড্রইং রুমে দেখা যায়। অনেককে বলতে শুনি এই বইয়ের কয়েক শ’ কপি কিনে বিলি করেছেন। তাদের অনেকের কাছে জানতে চেয়েছি, বইটি তিনি পড়েছেন কিনা। উত্তর পেয়েছি, ব্যস্ততার কারণে আসলে পড়ে ওঠা হয়ে ওঠেনি। জরিপ করলে দেখা যাবে সারাদেশে এটিই বাস্তবতা। যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির কথা বলেন, তারা বঙ্গবন্ধুকে পাঠ করবেন না, বঙ্গবন্ধুকে জানবেন না এটা হওয়াটা উচিত না। রাজনীতি করবেন শিষ্টাচার শিখবেন না তাও হয় না। সভা সমাবেশে চড়া গলায় কিছু মুখস্থ বুলি আওড়ানো আর বঙ্গবন্ধুকে সত্যিকার অর্থে জানা এবং হৃদয়ে ধারন করা এক জিনিষ নয়। বঙ্গবন্ধুকে জানতে হলে তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ অবশ্যই পড়তে হবে। পড়ে বুঝতে হবে কত ত্যাগ আর তিতিক্ষায় এই স্বাধীন বাংলাদেশটি আমাদের এনে দিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। টুঙ্গিপাড়ার একজন মুজিব কিভাবে পরিনত হলেন মহানায়কে।
লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি ও ব্যুরো প্রধান, দৈনিক সময়ের আলো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘ভ্যাকসিন পাওয়ার আগ পর্যন্ত মাস্ক একমাত্র ভরসা’
পরবর্তী নিবন্ধযুদ্ধদিনের গল্প